জিহাদের রিজার্ভ ফোর্স মাঠে নামানোর কথা রিমান্ডে স্বীকার করেছেন তাহের!

 জিহাদের জন্য রিজার্ভ ফোর্স মাঠে নামিয়েছে জামায়াত-শিবির। দেশব্যাপী নাশকতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করে অচল করে দেবে সরকার। রিজার্ভ ফোর্স গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও স্পর্শকাতর স্থানে হামলা চালাবে। এ জন্য তৈরি করা হয়েছে হিটলিস্ট।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনাল বাতিল, যুদ্ধাপরাধীদের ও নেতাকর্মীদের মুক্ত করার জন্য জিহাদের ডাক দিয়েছে জামায়াতÑশিবির। জামায়াতের সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের জিজ্ঞাসাবাদে এই ধরনের তথ্য দিয়েছেন। তাকে ৭ দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। বুধবার জামায়াতÑশিবিরের কর্মী ও ক্যাডারদের গাড়ি ভাংচুর ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় জামায়াতের সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরকে গ্রেফতারের পর তার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছে দ্রুত বিচার আইনেসহ দু’টি মামলা। বৃহস্পতিবার পুলিশ এই মামলায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালত থেকে রিমান্ড পেয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে তাকে। জিজ্ঞাসাবাদে জামায়াত নেতা বলেছেন, জামায়েতের শক্তি আছে, সময় হলে সরকারের বিরুদ্ধে এ শক্তি প্রয়োগ করা হবে, যথাসময় যথাযথ ব্যক্তির ওপর আমাদের শক্তি প্রয়োগ করা হবে।
জামায়েতের সাবেক এমপি ডা. আবদুল্লাহ তাহের প্রায় আড়াই বছর আগে ২০০৮ সালের আগস্ট মাসে
জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে বলেছিলেন, ‘তাদের রিজার্ভ ফোর্স রেডি আছে। যে কোন সময়ে তারা মাঠে নামবে।’ তার এই বক্তব্য নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে তাকে। বুধবার মালিবাগে জামায়াতÑশিবিরের পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার ঘটনায় তার নেতৃত্ব দেয়ার সঙ্গে আগের বক্তব্যের সম্পৃক্ততার সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছে পুলিশ।
রাজধানীর রামপুরায় পুলিশের ওপর হামলা ও ভাংচুরের ঘটনায় দ্রুত বিচার আইনেসহ দু’টি মামলায় জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নেতা সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরসহ ৭ জনকে রিমান্ডে দেয়ার আবেদন জানায় রামপুরা থানার পুলিশ। তদন্তকারী অফিসারের আবেদনের প্রেক্ষিতে তাদের ৭ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে আদালত। ঢাকার দ্রুত বিচার হাকিম হারুনুর রশিদ ও মহানগর হাকিম সাইফুর রহমান রিমান্ডের আবেদন মঞ্জুর করেছেন। রামপুরা থানায় তাদের বিরুদ্ধে দু’টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। রামপুরা থানার এসআই আরিফ হোসেন আসামিদের আদালতে হাজির করে রিমান্ডের আবেদন জানান।
তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশের এক উর্ধতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জামায়াতের সাবেক এমপি ডা. তাহেরের উস্কানি ও নির্দেশ পেয়ে জামায়াতÑশিবিরের রিজার্ভ ফোর্সের সদস্যরা এখন নাশকতা, ধ্বংসাত্মক কর্মকা- চালানোর কৌশল হিসেবে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের বেছে নিয়েছে। একাত্তরের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল বাতিল ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আটক ও বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধীর মুক্তির জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ করে পুলিশের ওপর হামলা ও আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা তাহের এসব নাশকতা ও নৈরাজ্য পরিস্থিতির সৃষ্টির ঘটনার নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। এ ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
কে এই তাহের
জামায়াতের সাবেক সাংসদ ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের ’০৭ সালের ওয়ান ইলেভেনের সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর তার বিরুদ্ধে জঙ্গী সম্পৃক্ততা, খুন, সন্ত্রাস, টেন্ডার, জমি, বালু, জলমহল দখল, দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগ পায়। তাহের ছিল চৌদ্দগ্রামের ত্রাস। তাহের কিভাবে রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে মামলা ও তদন্ত হয়েছে। চৌদ্দগ্রাম উপজেলার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আওলাদ হোসেন বাদী হয়ে বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে পৃথক দু’টি মামলা দায়ের করেছেন। দু’টি মামলাতেই তাহের, তার ভাই সৈয়দ একরামুল হক হারুনসহ ১২ জামায়াতÑশিবির ক্যাডারকে আসামি করা হয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। তদন্ত প্রতিবেদন পাঠানো হয় দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। ডা. তাহেরের বিরুদ্ধে জলমহাল ও বাজার লুটের আরও দু’টি মামলা দায়ের করা হয়। জলমহালে মাছ লুট, জাল লুট ও চাঁদাবাজির মামলায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটের প্রার্থী হিসেবে চৌদ্দগ্রাম (কুমিল্লা-১২) আসনের সাংসদ হয়ে যাওয়ার ঘটনা মনে হলে এখনও এলাকার মানুষজনের চোখে ভেসে ওঠে এক বিভীষিকাময় অত্যাচারের চিত্র। নির্বাচনের দিন সব ক’টি কেন্দ্র দখল করতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্নস্থান থেকে তার এলাকায় নিয়ে আসে ১০ সহস্রাধিক সশস্র ক্যাডার বাহিনীর সদস্য। এলাকার মসজিদ, মাদ্রাসা ও সমর্থকদের বাসায় রাখা হয় তাদের। গ্রামবাসীকে বলে দেয়া হয় তারা ‘মেহমান।’ মেহমানরা ছিল সশস্ত্র। ভোটারদের জানিয়ে দেয়া হয় তারা যেন ভোট কেন্দ্রে না যায়। এই ক্যাডার বাহিনীরা ছিল সেনাবাহিনীর মতো পোশাক পরিহিত। সেনাবাহিনীর মতো পোশাক পরিহিত এক ক্যাডার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার কাশীনগরে উত্তেজিত জনতার হাতে ধরা পড়ে। উত্তেজিত জনতা তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। কয়েকদিন জেলে থাকার পর জামিনে মুক্ত হয়ে আসে সেই জামায়াত-শিবির ক্যাডার। মেহমানরাই ভোট দেবে এবার। নির্বাচনে তাহের জয়ী হওয়ার পর তাকে মেহমানের এমপি বলা হতো। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর মেহমানের এমপি অত্যাচার, নির্যাতনের ভয়াবহ ঘটনা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে মনে করিয়ে দেয়।
তাহের বাহিনীর সশস্ত্র ক্যাডাররা আলকরা ইউনিয়নের কুলসার গ্রামের ছাত্রলীগ নেতা জসিম (২৫) খুন করেছে। খুন করেছে একই ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামের যুবলীগ কর্মী আনোয়ারকে (৩০)। ইউনিয়ন শাখা ছাত্র লীগের সাধারণ সম্পাদক আলমগীর (২২), সোনাইছা গ্রামের আওয়ামী লীগ কর্মী আবুল (৪০), কুলসার গ্রামের ছাত্রলীগ নেতা বাদল (২৫), আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা হাজী আবদুল মালেক (৬০), চিওড়া ইউনিয়নের শাকতলা গ্রামের যুবলীগ নেতা হেদায়েত উল্লাহসহ (৩৪) আরও অনেককে হত্যা করেছে তারা। তাহের বাহিনীর সন্ত্রাসে পঙ্গু হয়েছে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী। এর মধ্যে লক্ষ্মীপুর গ্রামের যুবলীগকর্মী হেলানের বোমার আঘাতে পা ওড়িয়ে দেয়া হয়েছে। একই গ্রামের ছাত্রলীগ কর্মী মোহাম্মদ আলীর পা কেটে নেয়া হয়েছে। কুলসার গ্রামের ছাত্রলীগ কর্মী জানুর চোখ তুলে নেয়া পর সে এখন অন্ধ। তাহের বাহিনীর বিভৎসতার ইতিহাস ও সংখ্যা অনেক দীর্ঘ। চৌদ্দগ্রাম থানা সূত্রে জানা গেছে, জামায়াত নেতা ও সাবেক এমপি হওয়ার কারণে তাহেরের বিরুদ্ধে তখন কোন হত্যা মামলা দায়ের করা হয়নি। তবে তার ভাই সৈয়দ একরামুল হক হারুন, হেদায়েত, বাদল ও জামায়াত-শিবিরের অন্য ক্যাডারদের আসামি করা হয়েছে।
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার পশ্চিম ডেকরা গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম তাহেরের। তাহেরের পরিচিতি ছিল খন্দকার। খন্দকার তাহের থেকে হঠাৎ সৈয়দ তাহের বনে যায়। তার বাবা তাবিজ-কবজের ব্যবসা করত। রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার সুবাদে নারায়ণগঞ্জে হায়দারী টেক্সটাইল মিলস্ ও গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানের মালিক বনে যায়। তার তিন ভাই সাদেক, হারুন ও সারোয়ার পরিচালনা করছে। কুমিল্লার বেসরকারী সেন্ট্রাল মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে চেয়ারম্যান বনে যায় তাহের। কুমিল্লার সার্কিট হাউসে এক সংবাদ সম্মেলনে দম্ভোক্তি করে সাবেক এমপি তাহের বলেছিলেন, ‘এখন থেকে আমি না বললে চৌদ্দগ্রামের পাতাও নড়বে না।’ জামায়াতের সাবেক এমপি ডা. আবদুল্লাহ তাহের জাতীয় প্রেসক্লাবে ২০১০ সালের ৪ আগস্ট গোলটেবিল বৈঠকে বলেছিলেন, ‘তাদের রিজার্ভ ফোর্স রেডি আছে। যে কোন সময়ে তারা মাঠে নামবে।’ জামায়াত নেতার তখনকার বক্তব্যের সঙ্গে এখনকার নাশকতা ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততার সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.