সংকলন ও ভূমিকা- আবুল হুসেনের অপ্রকাশিত গল্প by আবুল আহসান চৌধুরী

আবুল হুসেন ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’-এর উজ্জ্বল শিখা, ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজের’ প্রাণপুরুষ। ৬ জানুয়ারি তাঁর জন্মদিন স্মরণে এই আয়োজন
আবুল হুসেনের (১৮৯৭-১৯৩৮) প্রধান পরিচয় সমাজভাবুক হিসেবে।
১৯২৬ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজ’-এর ‘প্রাণপুরুষ’ হিসেবেও কেউ কেউ তাঁকে বিবেচনা করেছেন। তাঁর অসাধারণ সাংগঠনিক শক্তির পরিচয় মেলে এই প্রতিষ্ঠানের কাজে। ‘সাহিত্য-সমাজ’-এর মূল লক্ষ্য ছিল ‘বুদ্ধির মুক্তি’। যার বার্ষিক মুখপত্র শিখায় মুদ্রিত হতো ‘সাহিত্য-সমাজে’র মূলমন্ত্র—‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি যেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’। কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন ও আবুল হুসেনই ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান ব্যক্তিত্ব। এর পরের ধাপে নাম করতে হয় আবুল ফজল, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, আবদুল কাদির, শামসুল হুদা ও প্রবীণ কাজী আনোয়ারুল কাদীরের। তাঁদের মধ্যে চিন্তা-চেতনায় সবচেয়ে বেশি সাহসী ও বলিষ্ঠ ছিলেন আবুল হুসেন। তাঁর বক্তব্য একসময় সমাজে তুমুল আলোড়ন তুলেছিল। বিশেষ করে ধর্ম সম্পর্কে তিনি যে মত পোষণ করতেন, তা মৌলবাদীদের এতটাই ক্ষুব্ধ করে তোলে যে এর জন্য তাঁকে সামাজিক বিচারের মুখোমুখি হতে হয়। তীব্র প্রতিক্রিয়ার মুখে, হয়তো তাঁর সংগঠন-সহকর্মীদের পরামর্শে, তাঁকে মার্জনা চেয়ে মুচলেকা দিয়ে রেহাই পেতে হয়। শোনা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের চাকরিও ছাড়তে হয়। যে চেতনার অঙ্গীকার নিয়ে ‘সাহিত্য-সমাজ’-এর জন্ম হয়েছিল, বলতে গেলে একমাত্র আবুল হুসেনের চিন্তা-কর্ম ও রচনাতেই তা যথার্থভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল। অন্যেরা তুলনামূলকভাবে মধ্য ও নরমপন্থী এবং মত প্রকাশে সামাজিক প্রতিক্রিয়ার প্রশ্নে কিছুটা সতর্ক ছিলেন। ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজ’-এর কেউ কেউ তো উত্তরকালে নিষ্ঠাবান ধার্মিক হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন—ধর্মীয় প্রসঙ্গ তাঁদের সাহিত্যচর্চার কিছু অংশও দখল করেছিল। এসব বিষয় বিবেচনায় আনলে আবুল হুসেনকে ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের’ উজ্জ্বল ‘শিখা’ই বলতে হয়।
২.
আবুল হুসেন স্বল্পজীবী ছিলেন। পেশা হিসেবে প্রথম জীবনে স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা এবং পরে জজকোর্ট ও হাইকোর্টে আইন ব্যবসায় যোগ দেন।
আবুল হুসেন মূলত সমাজমনস্ক মননশীল প্রাবন্ধিক। তাঁর প্রকাশিত বই বা অগ্রন্থিত-অপ্রকাশিত রচনার সংখ্যা প্রচুর ছিল না বটে, তবে তাঁর মননচিন্তার পরিধি-পরিসরের বলয় ছিল যথেষ্ট বড়—সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতি-রাষ্ট্র-ধর্ম-শিক্ষা-ইতিহাস পর্যন্ত প্রসারিত। তাঁর মননচর্চার বৈশিষ্ট্য এই যে, তা যুক্তি-তথ্যে সমৃদ্ধ—গোছানো সিদ্ধান্তে গুরুত্ববহ। বাংলা ও ইংরেজি—দুই ভাষাতেই তিনি লিখেছেন। বাংলার বলশী (১৩৩২), এই প্রবন্ধ-সংকলনকেই তাঁর প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে প্রধান ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা যায়। তাঁর অন্যান্য প্রকাশিত বই ও পুস্তিকার এবং সন্দর্ভের মধ্যে আছে: বাঙ্গালী মুসলমানের শিক্ষা-সমস্যা (১৯২৮), মুসলিম কালচার (১৯২৮), খোঁয়াড় ও খেয়ার আইন (১৩৩৯), ‘The Problem of Rivers in Bengal’ (১৯২৫), The History of Development of Muslim Law in British India (১৯৩৪) প্রভৃতি। তাঁর অনেক লেখা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হলেও তা বই হয়ে বের হয়নি। আবুল হুসেন নানা বিষয়ে বেশ কয়েকটি স্কুলপাঠ্য বইও লিখেছিলেন। তাঁর সামান্য কিছু অপ্রকাশিত লেখার হদিসও পাওয়া যায়।
মূলত মননসাহিত্যের চর্চা করলেও সৃজনধর্মী সাহিত্য রচনায়ও ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজ’-এর কেউ কেউ আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। কাজী আবদুল ওদুদ গল্প-উপন্যাস-নাটক-কবিতা লিখেছেন, তাতে কিছু খ্যাতি-পরিচিতি এলেও তাঁর প্রকৃত সিদ্ধির ক্ষেত্র ছিল প্রবন্ধ ও আলোচনামূলক রচনাই। কাজী মোতাহার হোসেনও কয়েকটি গল্প-কবিতা লেখেন। মোতাহের হোসেন চৌধুরী অনেক কবিতা ও গান লিখেছেন, যার বেশ কিছু পত্রপত্রিকায় ছাপাও হয়েছে। আবুল ফজলকে চিন্তাশীল প্রাবন্ধিক হিসেবেই মান্য করতে হয়, তবে গল্প-উপন্যাস-নাটক লিখে ওদুদের মতোই পাঠক-সমালোচকের মোটামুটি মনোযোগ পেয়েছেন। প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখলেও আবদুল কাদির কবি হিসেবেই মূলত প্রতিষ্ঠা ও খ্যাতি পেয়েছেন। ‘সাহিত্য-সমাজে’র লেখকদের কবিতাচর্চার নিদর্শন পাওয়া যাবে শামসুল হুদা সম্পাদিত কয়েকটি কবিতা বইয়ে। এঁদের মতো প্রবন্ধ-নিবন্ধের পাশাপাশি আবুল হুসেন কয়েকটি গল্প ও নাটিকাও লিখেছিলেন।
৩.
সৃজনপ্রতিভা ও শিল্পমানসতার যে বৈশিষ্ট্য থাকলে একজন ব্যক্তি গল্প-উপন্যাস-কবিতা-নাটক রচনা করে যশ-খ্যাতি-প্রতিষ্ঠা-পরিচিতি পেতে পারেন, তা শিখাগোষ্ঠীর বেশির ভাগ লেখকেরই ছিল না—সেই অর্থে আবুল হুসেনেরও ছিল না। মূলত মননশীল রচনারই উপযোগী ছিল তাঁদের প্রতিভা ও প্রবণতা। তবু অন্যদের মতো আবুল হুসেনও সৃষ্টিধর্মী রচনায় হাত দিয়েছিলেন। বিশেষ করে ছোটগল্প রচনা ও আলোচনায়। এর স্বাক্ষর মিলবে ‘বঙ্গীয়-মুসলমান-সাহিত্য-পত্রিকা’য় (মাঘ ১৩২৬) প্রকাশিত তাঁর ‘ছোটগল্পের ধারা’ নামের একটি বড় প্রবন্ধে। কিন্তু হয়তো অনধিকারচর্চার সংকোচের কারণে নিজের লেখা গল্প প্রকাশের তেমন তাগিদ অনুভব করেননি। তবু তাঁর অন্তত তিনটি গল্প পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল: ‘রুদ্ধ ব্যথা’ (‘বঙ্গীয়-মুসলমান-সাহিত্য-পত্রিকা’, মাঘ ১৩২৬), ‘নেশার ফের’ (‘বার্ষিক সওগাত’, ১৩৩৪) ও ‘পেটের দায়’ (‘শান্তি’, শারদীয় ১৩৩৫)। তাঁর মৃত্যুর তিরিশ বছর পরে কবি আবদুল কাদির যখন আবুল হুসেনের রচনাবলি (১ম খণ্ড: ঢাকা, ১৫ অক্টোবর ১৯৬৮) সংকলন-সম্পাদনা করেন, তখন আবুল হুসেনের পূর্বপ্রকাশিত দুটি এবং পাণ্ডুলিপি থেকে বেছে নিয়ে চারটি গল্প (‘স্নেহের টান’, ‘মিনি’, ‘গোঁয়ার গাদু’, ‘প্রীতির কুঁড়ি’) প্রকাশ করেন। তাঁর ও আমার গল্পপ্রাপ্তির অভিন্ন সূত্র থেকে এখানে আবুল হুসেনের একটি অপ্রকাশিত গল্প (‘সফল শ্রম’) সংকলিত হলো। গল্পটি অপ্রকাশিত যেমন, দুঃখের বিষয়, তেমনি অসম্পূর্ণও—কেননা, কাগজের দুই পিঠে লেখা গল্পটির অন্তত দুটি পৃষ্ঠা ছিন্ন। তাই মাঝখানে কাহিনিসূত্রের পরম্পরা অদৃশ্য। পাঠকের কল্পনার দায়ের ওপর ছেড়ে দিয়ে তাই এখানে সম্পাদনার নামে কৃত্রিম যোগসূত্র রচনার চেষ্টা করা হয়নি।
মানবকল্যাণ, সমাজহিত, নীতিবোধ, স্বাবলম্বন ও সুন্দর মনের পরিচর্যা আবুল হুসেনের মানস-বৈশিষ্ট্যের অন্তর্গত ছিল। তাঁর পূর্বপ্রকাশিত গল্পগুলো এবং বর্তমান গল্পটির কাহিনিতেও এই মনোপ্রবৃত্তির পরিচয় কম-বেশি প্রতিফলিত। যে বক্তব্য প্রবন্ধে প্রকাশের উপযোগী, তা তিনি গল্পে রূপ দিয়েছেন ‘সফল শ্রম’-এ। এই গল্পের গুরুত্ব শিল্পমূল্যে নয়, আবুল হুসেনের মানসচিন্তার পরিচয়ে—এই কথাটুকু স্মরণে রেখেই গল্পটির সঙ্গে পরিচিত হওয়া প্রয়োজন।

No comments

Powered by Blogger.