সফল শ্রম by আবুল হুসেন

পুওরফণ্ডের বোর্ডে সংগতিপন্ন ছাত্রের নামের মধ্যে তার নাম না দেখিয়া রহিম বক্্স বিষণ্ন বদনে বাসায় ফিরিয়া পরদিন বাড়ী চলিয়া আসিল। দুইচার দিনের মধ্যেই পূজার অবকাশ হইবে কিন্তু তার মেজাজ এমন খারাপ হইয়া গেল সে আর অপেক্ষা করিতে পারিল না।
পথে আসিতে আসিতে ভাবিল “কেন তাহাকে এক টাকাও সাহায্য করিল না—যারা পাইয়াছে তারা বড় বড় খাঁনবাহাদুর নবাব অনারেবলদের দারিদ্র্যের সার্টিফিকেট যোগাড় করিয়াছিল—বোধহয় সে সেইজন্যে বঞ্চিত হইয়াছে।” কিন্তু সে এইরূপ তার গরীবত্ব প্রমাণ করিবার জন্য ঐরূপ বড় বড় ছাপান দলীল কোথায় পাইবে? সে আরও ছোট হইয়া গেল।
আশ্বিন মাসে বাংলার বুকে প্রকৃতি বেশ টলটল করিতে থাকে। রৌদ্রের রমণীয়তা, রজনীর চাঁদিমা, খালবিলপুকুরের প্রস্ফুটিত নলিনীকমলের হাসি রহিম বক্স বড় ভালবাসিত। সে একদিন তার বাড়ীর পাশের খালের ধারে বৈকালে বসিয়া [...] খালের জলে দামশেওলার মধ্যে নাড়ুলের খেলা দেখিতেছিল। নির্নিমেষ নয়নে স্বচ্ছ প্রকৃতির মধ্যে বালক রহিম ডুবিয়া গিয়াছিল। এমনি সময়ে আবদুল হালিম বেড়াইতে বেড়াইতে সেখানে গিয়া উপস্থিত হইল। হালিম তন্ময় রহিমকে বাধা না দিয়া চলিয়া যাইতেছিল—হঠাৎ রহিম ধড়ফড় করিয়া উঠিয়া পড়িয়া দেখিল হালিম চলিয়া যাইতেছে। ব্যস্তসমস্ত হইয়া রহিম হালিমকে আদাব করিয়া দাঁড়াইতেই মোবারক [হালিম] তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল “কেমন চলেছ? পুওরফন্ডের দরখাস্ত করেছিলে? ... তা কি হইল?”
হালিম রহিমের নিকট সমস্ত শুনিয়া বেশ একটু চিন্তায় পড়িল সে আর কোন কথা না বলিয়া রহিমকে সঙ্গে লইয়া খালের ধার ও শস্যমুক্ত শূন্য মাঠে বহুক্ষণ ভ্রমণ করিবার পর খালের কাল জলে অজু করিয়া মগরেব পড়িয়া বাড়ী ফিরিল। ভ্রমণের মাঝে হালিম কলেজে ও ইউনিভারসিটিতে অর্জ্জিত আজকালকার শিক্ষার ফলাফল লইয়া খুব আলোচনা করিল। সে বলিল, “দেখ রহিম, এম.এ. বি.এ পাশ করার লোভে আমরা জ্ঞানার্জ্জন করিবার উদ্দেশ্যে কত টাকা ব্যয় করি ও কত কষ্ট করি। কিন্তু প্রকৃত জ্ঞান কি লাভ করিয়া থাকি? কেবল ফাঁকি দিতেই শিখি। আমাদের মানসিক শক্তি খর্ব্ব হইয়া যায়—শারীরিক স্বাস্থ্য ধ্বংস হয়। পরিশ্রম করিতে লজ্জা করি—শিক্ষা আমাদিগকে সাহায্য করিবার পরিবর্ত্তে আমাদিগকে আরও অসহায় পঙ্গু করিয়া ফেলে। কেবল চাকুরীর আশা বুকে বাঁধিয়া পরীক্ষায় পাশ করিবার জন্য রাত্রিজাগরণ ও অতিরিক্ত মন ও মস্তিষ্কের পরিচালনা করিতে প্রবৃত্ত হই—আর দশবিশ টাকার একটা চাকুরী না পাইলে জীবন বিফল মনে করিয়া চতুর্দ্দিক অন্ধকার দেখি। আমাদের মধ্যে যে বিপুল শক্তি সুপ্তনিহিত আছে তাহা আমরা দেখিতেই শিখি না। দেখ, ক্লাশে যখন আমরা বসি তখন আমরা কোন কোন প্রফেসরের ঘন্টায় পিছনের বেঞ্চে ঘুমাইয়া পড়ি আর যদি জাগিয়াও থাকি তাহা হইলে অন্যমনস্ক হইয়া কেবলই ঘন্টা কাভার হওয়ার মুহূর্ত্ত প্রতীক্ষা করিয়া কাটাই। ইহাতে আমাদের জ্ঞানোৎকর্ষ কি করিয়া হইবে। আমাদের মনোযোগ—ভ্রষ্ট উচ্ছৃঙ্খল হইয়া পড়ে—মন এদিক ওদিক ঘুরিবার কুঅভ্যাস আয়ত্ত করে। আমরা ইউনিভরসিটির কড়া নিয়মের দাস হইয়া উচ্চশিক্ষার শিখরে গিয়া আত্মব্যক্তিত্বের স্বাধীন সচল স্ফূর্ত্তিকে বিকাশলাভ করিতে সুযোগ না দিয়া তাহাকে সবলে ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ করিয়া ফেলি—ফলে আমাদের অন্তরের আসল মানুষটি রুদ্ধশ্বাস হইয়া লোকচক্ষুর গোপনেই বিনষ্ট হইয়া যায়। এরূপ শিক্ষার কি ফল হইতেছে? আমাদের দেশে অকর্ম্মার সংখ্যা দিন দিন বাড়িয়া চলিয়াছে। আবার যাহারা গরীব তাহাদের দুর্দ্দশা আরো হূদয়বিদারক। শিক্ষার অবয়ব আজ যেমন শতমুখী হইয়া বাড়িয়া চলিয়াছে—তেমনি তাহা আয়ত্ত করিবার জন্য বহু অর্থেরও আবশ্যক হইতেছে। গরীব পথ না পাইয়া “চাকুরে”র বাবুজীবনের আয়েশের মোহে পরের কাছে ভিক্ষা করিয়া কলেজে ঢুকিতেছে। শেষে চাকুরী না পাইয়া তাহার অন্তরধন বিলুপ্ত করিয়া যখন সে দেখিতে পাইতেছে যে, সে কোন কর্ম্মেরই হয় নাই—কেবলমাত্র “গজেক কারণ” খানিকটা লেখাপড়া শিখিয়াছে তখন তাহার হাহুতাশের অবধি থাকে না। তাই বলি তুমি এখনই ভিক্ষায় প্রবৃত্ত হইয়া নিজকে ছোট করিয়া এমন লেখাপড়া শিখিবে যাহা তোমার পেটের দুটা ভাত সুন্দর প্রচুররূপে আনিয়া দিতে পারিবে না। তুমি “ছোট” হইয়া “বড়” হইতে পারিবে না— কারণ তোমার মন বড় হইবে না, টাকাপয়সার মানুষ হইলেও। আর তিন বৎসর পরে কষ্টেসৃষ্টে ম্যাট্রিকুলেশন পর্য্যন্ত উঠিতে উঠিতে তুমি অনেক জিনিষ হারাইয়া ফেলিবে। তুমি তখন শারীরিক পরিশ্রম করিতে লজ্জাবোধ করিবে। হাতে করিয়া হাট হইতে বেশাতিটা পর্য্যন্ত আনিতে তোমার কত ইতস্তত করিতে ইচ্ছা হইবে—তুমি এদিক ওদিক তাকাইবে পাছে যেন কোন পরিচিত লোক তোমাকে বোঝা বহিতে না দেখে। তুমি পরের কাছে চাহিতে অভ্যস্ত হইয়া স্বাবলম্বন ও আত্মনির্ভরতা হারাইবে। দারুণ অভাবের মধ্যে তুমি শারীরিক কষ্ট পাইয়া জীবনের উপর অন্তরে অন্তরে ধিক্কার করিতে শিখিবে। ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করিবার পর তুমি আবার পরের সাহায্যে আরও উচ্চস্তরে উঠিবার চেষ্টা করিবে কিন্তু খরচের পরিমাণে সাহায্য অভাবে পড়া ছাড়িয়া দশ টাকার এপ্রেন্টিস কিংবা ১৫ টাকার মাষ্টারীর জন্য আকাশপাতাল করিয়া বেড়াইবে। এই ত ব্যাপার শেষকালে গড়াইবে। আমার মতে তুমি বর্ত্তমানে বাড়ী পড়িয়া ম্যাট্রিকুলেশন দেওয়ার চেষ্টা কর আর ঐ গাঁয়ের বোর্ড স্কুলে মনিটরীর কাজে লাগ—চার মাস অন্তর বার টাকা করিয়া সাহায্য পাইবে—তাহা দ্বারা ব্যবসা ট্যাবসা একটা জুড়ে দিয়ে পেট চালাইবার জোগাড় করিতে পারিতে। পরের কাছে আর হাত পাতিতে হইবে না। যে এক আনা আধ আনা লাভ হবে তা তুমি “আমার বলিয়া—” বেশ মনে বল ও সাহস পাইবে। এতক্ষণে রহিম পুতুলের মত নির্ব্বাক হইয়া অনন্যমনে শুনিতেছিল। হালিম শেষ করিবা মাত্র সে জিজ্ঞাসা করিল “কি ব্যবসা করিব, আমি যে ছেলেমানুষ।”
তখন মগরেব হইয়া গিয়াছিল। বাড়ীর কাছে আসিয়া হালিম বলিল “আচ্ছা যাও, কাল সকালে আর একবার এস।” রহিম ভাবিতে ভাবিতে ঘরে চলিয়া গেল।

পরদিন দুপুর বেলার আহারান্তে হালিম বসিয়া তার পড়িতেছিল ভোলা আসিয়া ডাকিল ‘ভাইজি রহিমকে মা আপকে ডাকচে’ ভোলা পশ্চিম থেকে আসার পর এই পাঁচ বৎসরের মধ্যে মোটে—ঐটুকু বাংলা বলিতে শিখিয়াছিল— হালিম রগড় করিয়া ভোলার বাংলাবুলি শুনিত— এখনও সে সেই উদ্দেশ্যে চেয়ারে দুলিতে দুলিতে জিজ্ঞাসা করিল ‘কিরে ভোলা! কে ডাকচে্্?” রহিমকে মা— কেন? “তা হামি জানে না” ‘কখন এসেছে?’—“বহত দেরীছে বৈঠে অছে...বুবুজানকে সাত বাত করতাছে। আপেন জলদী তাড়ে আসে।” হালিম উঠিয়া রহিমের মাকে গিয়া বলিল “কি বলেছা?”... “আপনি কাল কি বলেছেন আমার বিশুকে— সে যে কাঁদছে তার পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যাবে বলে। সে আর স্কুলে পড়তে পাবে না— সব ছেলে তাকে ছাড়ায়ে যাবে এই ভাবনায় সে গেল।” আমি আর কি বলবো— লেখাপড়া শিখে আজকাল আমাদের ফলটা হচ্ছে কি তাই বলিছলাম। বিশেষতঃ গরীবের দশা কি দাঁড়ায় সেইটী দেখাচ্ছিলাম। আমি ত তাকে পড়াশুনা ছাড়বার কথা বলিনি। সে যদি চালাতে পারে তাতে আমার আপত্তি কি। আর একটা কথা তার বাপ আমাকে অনেক নিন্দেমন্দ করেছে—তার বড়মিয়া নাকি কোথায় কোন্্ স্কুলে ফ্রি করে দিতে চেয়েছিলেন আমার জন্য তা হ’ল না—আমার জন্যই রহিমের পড়া বন্ধ হইতেছে আর তার উপর এত কষ্ট হ’ল। “গত বৎসর বড়মিয়ার কথা শুনেল আমার সবদিক ঠিক হ’ত—অত দুঃখ পাতাম না” এই বলে সে আমার উপর ঝাল ঝেড়েচে। তাই আমি আর ওর পড়াশুনার মধ্যে থাকেত চাচ্ছি না—সে এখন তাকে নিয়ে বড়মিয়ার কথামত যা ইচ্ছে তাই করুক। অবশ্য আমি একথাটা স্পষ্ট করে তাকে বলিনি তাকে ভবিষ্যতের ফলাফল কেমনধারা হতে পারে— এবং এখন কি করলি দুটা অন্নের সংস্থান কারুর কাছে হাত না পেতে জুটাতে পারে তার একটা ব্যবস্থা নিয়ে বলাকহা কচ্ছিলাম—তাতে তার এত কাঁদাকাটি করার কারণ কি?
এতক্ষণ রহিমের মা ধীর হ’য়ে হাতে একটা কাটি নিয়ে হালিমের কথার দিকে মনটা দিয়ে, অনর্থক মাটি খুঁটিতেছিল। হালিম কথা শেষ করিয়া যাইতে উদ্যত; সে বলিতে লাগিল, “না আপনি ছাড়লে হবে না—উনার কথা আপনি ছেড়ে দেন—ওসব “গরগোবিন্দ” মানেষর কথা আমি ধরিনে—আর বড়মিয়া কেবল মুখে ওরূপ কন। যখন কাজটা হয়ে যায় তখন যে করে দেয় তার ভুল ধরেন আর নিজি কত কি হাতীঘোড়া মারতি পাত্তেন তাই শুনুন দিয়ে অবুঝ লোকের মনে ধাঁধা ধরিয়ে দেন। এতকাল যে স্কুলে পড়লে—তা আমি ত জানি—আপনি না হ’লে সেই পাঠশালার তালপাতার ওবাড়ে আর হ’ত না। বাড়ী ছেড়ে সহরের স্কুলে যাওয়ার পরও ত আপনি গোপনে গোপনে কত সাহায্য করেছেন— তা না করলি কি এই একবৎসরও চল্ত— উন্ডা কি তা জানেন। আপনি যা বলেবন আমি সেইমত কাজ করবার জন্যি বিশেকে বলবানে। আপনি ছাড়বেন না”—হালিম দেখিল রহিমের মার মুখ নীরব কৃতজ্ঞতায় লাল হইয়া উঠিয়াছে। নিজের গোপনদানের কথা তাহার কানে উঠিয়াছে ও প্রকাশ পড়িয়াছে দেখিয়া—হালিম বেশ একটু লজ্জা পাইল—তার অন্তর যেন ঝিলিক মারিয়া উঠিল—সে আর বেশী কথা শুনিতে অনিচ্ছুক হইয়া ছোট্ট করিয়া ‘না আমি ওকে বসিয়ে না দিয়ে ছাড়ছি না’ বলিয়া দ্রুতপদে “ভোলা” “ভোলা” করিতে করিতে বাহিরে গিয়া আবার কাগজ পড়িতে বসিল।
ভোলা ছুটিয়া আসিলে হালিম তাহাকে রহিমকে ডাকিয়া আনিতে পাঠাইয়া দিলেন। ভোলা এক দৌড়ে রহিমের বাড়ী গিয়া তাহাকে না পাইয়া পশ্চিমমাঠের কলাইয়ের ভুঁই হইতে তাহাকে ডাকিয়া আনিল। ভোলা এত কর্ম্মপটু ছিল যে তাহাকে কাজ করিতে বলিলে কখনও ওজরআপত্তি দেখাইয়া তাহা অসম্পূর্ণ রাখিত না। তার এমনি রীতি ছিল যে, ধরিয়া... [পৃষ্ঠা ছিন্ন] তরকারী হাটা একাই জুড়িয়া লইয়াছ। অবশ্য কেহ কেহ তোমার নিকট বেচিবে না—কিন্তু যাহাদের হাটে যাওয়ার লোক নাই, যারা বহিয়া লওয়ার কষ্ট এড়াইতে ইচ্ছা করিবে নিশ্চয়ই তাহারা গ্রাম হইতে তোমার নিকট বিক্রয় করিয়া ফেলিবে। আর এক কাজ করিতে পার অন্য হাট হইতে ক্রয় করিয়া এ হাটে আবার এ হাটের সস্তা আমদানী জিনিষ অন্য হাটে লইয়া বিক্রী করিতে পার। প্রথম প্রথম তোমাকে কায়িক মাথায় মোট করিতে হইবে কিন্তু হাতে দু পয়সা হইলে আর মনিটারী পদের বেতন একত্র করিয়া গ্রামে যে সব অভাব আছে—তাহা নিবারণ করিবার জন্য সহর হইতে জিনিষ আনিয়া ছোটখাট একটা দোকানে সাজাইতে পার। আবার এই টাকা দিয়া তুমি ধীরে ধীরে দু এক বিঘা জমি ক্রয় করিয়া কৃষিকার্য্যের উন্নতি করিতে পার। এই সঙ্গে সঙ্গে পড়াশুনার আমলটা রাখিয়া চেষ্টা করিয়া অনায়াসে ম্যাট্রিকুলেশনটী পাশ করিতে পার। জ্ঞানচর্চার সঙ্গে সঙ্গে অর্থাগম হইতে থাকিবে—তোমার মনে স্বাধীনতার সাহস ও স্ফূর্ত্তি বাড়িবে।”
অভিনিবেশ সহকারে রহিম বেশ করিয়া বুঝিয়া শুনিয়া গেল। পরদিন হালিম কলিকাতায় রওয়ানা হওয়ার সময় বলিয়া গেল “ভেবেচিন্তে দেখে যেটা ভাল বিবেচনা হয় করিও—পত্রটত্র দিও আর দরকার হইলে ভোলাকে সাথেসঙ্গে ডাকিও”—ভোলা বলিল “হাঁ ভাইজি হামিভি খুব সকেব—”

হালিম এম.এ. বি.এল পাশ করিতে করিতে সব ডেপুটী হইয়া একদিন কাঁথির ডাকবাংলায় বসিয়া গরীবদের টাকা বিলাইতেছে এমন সময় রহিমের একখানা চিঠি “ঠিকানাবদল” হইয়া কলিকাতা হইতে ঘুরিয়া আসিল। চিঠির মর্ম্ম বুঝিল যে, সে আর ভোলা দুই টাকা লইয়া চারহাট কেনাবেচা করিয়া দুই টাকা লাভ করিয়োছে। ভোলা তাহাকে ছালাম পাঠাইয়াছে। সে বৈকালে বাংলার ইজীচেয়ারে পড়িয়া কাগজ পড়িতে পড়িতে রহিমের কথা অনেক ভাবিল। উত্তরের কার্ডে অল্প কয়টা কথা ছিল। “আমার অভাববশতঃ আমি এই চাকরী লইতে বাধ্য হইয়াছি—তোমাদের লাভ হইয়াছে শুনিয়া বেশ খুশী হইলাম। তোমাদের লাভ আরও হইবে। ভোলার কথা আমার বেশ মনে আছে।”
যথাসময়ে রহিম পত্র পাইয়া একটু ভাবিল— ভোলাকে বলিল “আরে তোমার সাহেব যে হাকিম সাহেব হয়েছেন।” “তাতে কি? চল ঐ কলমগাজীর পটল নিয়ে আসি” ক্ষেতে সে তুলে লিতে হোবে—একঝুড়ি হোবে...”
এর মধ্যে ভোলার সঙ্গে বিশুর বড় মিল হইয়া গিয়াছে। ভোলা খুব দৌড়ঝাপ দিয়ে কাজ করিত। দেড়মণ দুইমণ মাথায় করিয়া যাইতে সে একটুও হেলিত দুলিত না। এইরূপে বোঝা বহিয়া ব্যবসা করিতে করিতে প্রায় সাত আট বৎসর পার হইয়া গেল। ইহার মধ্যে বিশু ও ভোলা গ্রামের মধ্যে একটা বড় দোকান খুলিয়াছে তরকারীর কেনাবেচা বন্ধ করিয়া—দোকানের জিনিষ হাটে গ্রামে বিক্রী করিতে লাগিল। সঞ্চিত অর্থ দিয়া ঋতুবিশেষে পাট, ধান, কলাইমুশড়ী, গুড় প্রভৃতি গ্রাম হইতে কিনিয়া কলিকাতায় চালান দিতে লাগিল। অন্যলোক গ্রামে আসিয়া কিনিতে পারিত না।
ওদিকে হালিম হাকিম হইয়া এ সহর হইতে ও সহর, ও সহর হইতে আরেক সহর করিয়া বেড়াইতে লাগিল—মাসের পয়লায় বেতন পাইয়া দেনাশোধ করিয়া শূন্যহাতে পুনরায় পরের কাছে ঋণ করিয়া দিন কাটাইতেছে। দশ বারো বৎসর পর হালিমের মোটে দুইশত টাকা মাহিনা হইল। ম্যালেরিয়ার আবাসভূমি পূর্ব্ববঙ্গের কোন মহাকুমায় বদলী হইয়া হালিম স্বাস্থ্য হারাইল। ছুটী লইয়া কলিকাতা ও পুরী, নৈনীতাল ও রাঁচি প্রভৃতি তামাম জায়গায় হাওয়া বদলাইয়া কোন ফল না পাইয়া বাড়ী আসিল। ভোলা ষ্টেশনে যাইয়া হালিমকে বাড়ী আনিল। বাড়ীতে আসিয়া সে ভোলা ও বিশুর ব্যবসার ফল যাহা দেখিল তাহাতে অনেকটা সুস্থ হইল। বিনাবেতনে ছুটী লইতে বাধ্য হইয়া হালিমের হাত খালি হইয়া গিয়াছে। অসুস্থ হালিমকে প্রাণপণে বিশু ও ভোলা শুশ্রূষা করিতে লাগিল। তাহারা এই কয় বৎসরের মধ্যে দোকান, ভুসোমাল ও ধানপাটের ব্যবসার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামে চা’ল ও তেলের কল পাতিয়া বহু অর্থ সঞ্চয় করিয়াছিল—ষ্টেশনের ধারে ঐ খোলামাঠে তাহারা চিনির কল খুলিবে বলিয়া আমেরিকা হইতে সব পুস্তক আনিয়া রহিম পড়িতেছিল। তাহা শুনিয়া হালিম রহিমের নিকট তার প্ল্যানের বর্ণনা শুনিয়া অতীব প্রীত হইলো। সে গুড় হইতে চিনি করিবার ব্যবস্থা করিবে আগে, কারণ গুড়ের আমদানী একা তাদের সহর মহাকুমার হাটগুলিতে যাহা হয় তাতেই একটা মিল চলিতে পারে—সেগুলি গাড়ীতে বাহিরে চালান হইতে দিবে না। হাটে লোক নিযুক্ত করিয়া গুড় আটকাইয়া নিজের মিলে আনিবে। এই ব্যাপারে গ্রামের অনেক অকেজো লোক কাজ পাইবে। তেলের ও চালের কল চালাইতেও দু চার জন নিযুক্ত হইয়াছিল। ভোলা ও বিশু এখন কর্তা হইয়া কাজে পোক্তা হইয়া উঠিয়াছে। বিশু বাংলা সাহিত্য খুব চর্চ্চা করে—সংবাদপত্র পড়ে ও বিদেশ হইতে ব্যবসা সম্পর্কে অনেক কাগজ মাসিক আনিয়া পড়ে। হালিম যেন রুগ্নদেহে একটা সবল স্ফূর্ত্তি অনুভব করিল।
বিশু হালিমের বারংবার নিষেধে পিতামাতার অনুরোধ সত্ত্বেও বিয়ে করে নাই। ভোলাও অবিবাহিত। এখন পূর্ণস্বাস্থ্য বিশু ও ভোলাকে বেশ অবস্থাপন্ন হইতে দেখিয়া রোগবিছানা হইতে সম্বন্ধ করিয়া বিবাহ দিয়া সংসারী করিয়া হালিম একটু নিশ্চিন্ত হইল। ভোলা এখন পুরা বাঙ্গালী তার কথার আড় ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। সে বাংলাকাগজ পড়িতে শিখিয়াছে। হালিমের স্বাস্থ্য আর ভালপথে আসিল না। সে এখন ঔষধ খাওয়া বন্ধ করিয়া পীরের পড়া-পানি ও মাদুলির উপর নির্ভর করিয়া শেষবাতাসের অপেক্ষা করিতে লাগিল। হালিমের দুইটী কন্যা হইয়াছিল। সে তাহাদিগকে একদিন বুকের উপর করিয়া নীরবে কত কি চিন্তা করিতে ছিল, শিয়রে হালিমের প্রিয়ার গন্ড-বহিয়া মৌনবেদনার অশ্রু ঝরিতেছিল, হঠাৎ ভোলা সেখানে গেল ভোলা আসিবামাত্র হালিমের চক্ষু হইতে পড় পড় অশ্রু কয়েক ফোটা তাড়াতাড়ি কামিজের উপর পড়িয়া বিলীন হইয়া গেল—কিন্তু ভোলা তাহা দেখিল। সে তার বুবুকে অশ্রু ফেলিতে দেখিয়া ঘরের মধ্যে উঠিয়া অনেক কথা বুঝাইল। হালিম ভোলার হাত ধরিয়া রহিল—কিন্তু কোন কথা বলিতে পারিল না—সব কথা প্রকাশ হইয়া আসিল তার অশ্রুধারার মধ্য দিয়া। ভোলা ভেউ ভেউ করিয়া কাঁদিতে লাগিল। মা বাপ ও ভোলাকে কাঁদিতে দেখিয়া মেয়ে দুটীও চীৎকার করিয়া ভয়ে কাঁদিয়া ফেলিল। পাড়ার লোক ঐ কান্না শুনিয়া ছুটিয়া আসিল। আসিয়া দেখে হালিমের অবস্থা তত সুবিধা নয়। পলকের মধ্যে গ্রামময় রাষ্ট্র হইয়া গেল। বিশু ছুটিতে ছুটিতে হাঁপাইয়া আসিয়া উম্মাদের মত লোক ঠেলিতে ঠেলিতে হালিমের বিছানার পাশে গিয়া উপস্থিত হইল। তার তাক উড়িয়া গেল। সে অবুঝ জ্ঞানবুদ্ধিহীন বালকের মত রোদন করিতে লাগিল। সারা বাড়ী ক্রন্দনের রোলে ভরিয়া গেল। কে কাহাকে বুঝায়, সান্ত্বনা করে! সকলেই হালিমের হাল দেখিয়া কাঁদিল সুদূর বিদেশে একটা সামান্য চাকরীতে জীবনযাপন করিয়াও সে গ্রামের লোকের এত স্নেহভালবাসা বজায় রাখিয়াছিল। হালিমের জীবন বিফল হইয়া গেল। অকালে চিররোগী হইয়া প্রাণময়ী প্রেয়সীকে বিধবা ও বাচ্ছাদুটীকে অনাথ করিয়া সে আজ মৃত্যুর পথে উঠিয়াছে। সে পেটের দায়ে এত লেখাপড়া শিখিয়াও কারু কোন কাজে লাগিল না—এই নিদারুণ চিন্তার নিষ্ঠুর নিষ্পেষণে মর্ম্মাহত হইয়া একবার বিশুর দিকে আর একবার ভোলার দিকে অতি দীন ও শান্ত নয়নে তাকাইয়া শেষপ্রশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে সে চক্ষু মুদ্রিত করিল।
বিশু ও ভোলার চামচের পানি চামচেই রহিল।

No comments

Powered by Blogger.