শেয়ারবাজারে দরপতনের পেছনে সক্রিয় জুয়াড়ি চক্র চিহ্নিত- সহায়তায় কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউস by রাজু আহমেদ

 গুজব ছড়িয়ে শেয়ারের দর কমিয়ে মুনাফা হাতিয়ে নিতে সক্রিয় একটি জুয়াড়ি চক্রকে চিহ্নিত করেছে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা। গত ১৩ জানুয়ারি আতঙ্ক ছড়িয়ে শেয়ারবাজারে হঠাৎ ধস নামানোর পেছনে এই চক্রটি মূল ভূমিকা পালন করে।
মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিভ্রানত্ম করে ধস নামিয়ে সর্বনিম্ন মূল্যে কয়েকটি কোম্পানির কোটি কোটি টাকার শেয়ার কিনে নিয়েছে এরা। এ কাজে সহায়তা করেছে কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউসের অসাধু কর্মকর্তা। ফেসবুক ও মোবাইল ফোনের কললিস্ট যাচাই-বাছাইয়ের পর এ চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারে অভিযান চালানো হবে বলে সংশিস্নষ্ট সূত্রে জানা গেছে। যোগাযোগ করা হলে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশন (এসইসি)'র একজন উর্ধতন কর্মকর্তা জানান, শেয়ারবাজারে সাইবার অপরাধ শনাক্ত করার চলমান প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই তদনত্ম কাজ চালানো হচ্ছে। ফেসবুক ও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে বাজারকে প্রভাবিত করার সঙ্গে জড়িতদের বিরম্নদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কমিশনের সার্ভিল্যান্স বিভাগ কাজ করছে। এ বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তা নেয়া হচ্ছে বলেও তিনি নিশ্চিত করেছেন।
গত ১৩ জানুয়ারি ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জে (ডিএসই)'তে শেয়ার-দরে ব্যাপক ধস নামে। ওইদিন সকাল থেকে স্বাভাবিক লেনদেন অব্যাহত ছিল। এক পর্যায়ে ডিএসই সাধারণ সূচক আগের দিনের তুলনায় ৫০ পয়েন্ট বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু বেলা ১২টার দিকে হঠাৎ করেই মার্জিন ঋণের হার কমিয়ে দেয়ার গুজব ছড়িয়ে পড়ে। পাশাপাশি কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউসে এসইসি কর্মকর্তারা হানা দিয়েছেন_ এমন খবরে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ফলে প্রায় সব কোম্পানির শেয়ারের দরে ব্যাপক ধস নামে। এই সুযোগে একটি চক্র বিপুল পরিমাণ শেয়ার কিনে নেয়। এ কারণেই ওই দিন ডিএসই'র লেনদেনে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়।
সংশিস্নষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রেকর্ড লেনদেন সত্ত্বেও সূচকে বড় ধরনের ধসের কারণ অনুসন্ধানে এসইসি'র পৰ থেকে একটি তদনত্ম কমিটি গঠন করা হয়। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টিকারীদের চিহ্নিত করতে তদনত্ম কমিটি সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার শরণাপন্ন হয়। এরপরই জুয়াড়ি চিহ্নিত করতে মাঠে নামে গোয়েন্দা সংস্থাটি। ইতোমধ্যেই ওই ঘটনার পেছনে একটি শক্তিশালী চক্রের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে গোয়েন্দারা।

যেভাবে ধস নামানো হয়
বাজারে বড় ধস নামার দু'দিন আগে থেকেই এ নিয়ে তৎপর হয়েছিল জুয়াড়ি চক্রটি। মতিঝিল, পল্টন, মিরপুর ও উত্তরাকেন্দ্রিক কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউসের কয়েক কর্মকর্তা ফেসবুকের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কয়েকটি শেয়ারের দরপতন হবে বলে তথ্য ছড়িয়ে দেয়। এর মাধ্যমে শেয়ারবাজারের কয়েকজন সাধারণ বিনিয়োগকারীর কাছে এ তথ্য পেঁৗছে যায়। ফেসবুকে শেয়ার দরপতনের তথ্য পড়ে তাদের অনেকেই বিচলিত হয়ে পড়েন। ফেসবুকের মাধ্যমে পাওয়া এসব তথ্য নিয়ে তারা অন্য বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেন।
অন্যদিকে ১৩ জানুয়ারি সকাল ১১টার দিকে হঠাৎ করেই কোন কোন বিনিয়োগকারীর মোবাইল ফোনে অপরিচিত নম্বর থেকে কল আসতে থাকে। নিজেদের এসইসি কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে জানায়, শেয়ার কেনার জন্য মার্জিন ঋণের হার কমিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন থেকে আর কোন কোম্পানির শেয়ার কেনার জন্য ১:১ হারে মার্জিন ঋণ দেয়া হবে না। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে জানানো হয়, মার্জিন ঋণের হার ১:৭০ করা হয়েছে। এর পরপরই একটি শেয়ার বিক্রি করে ওই পরিমাণ টাকায় অন্য শেয়ার কেনার (আর্থিক সমন্বয়) সুবিধা বন্ধে বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসে এসইসি কর্মকর্তারা হানা দিচ্ছেন বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। কিছুৰণের মধ্যে অধিকাংশ ব্রোকারেজ হাউসে অবস্থানরত বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এসব তথ্য ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক আতঙ্ক তৈরি হয়। অধিকাংশ বিনিয়োগকারী হাতে থাকা শেয়ার দ্রম্নত বিক্রি করে দিতে থাকেন। এর প্রভাবে ওইদিন লেনদেন হওয়া ২০২টি কোম্পানির শেয়ারের দর কমে যায়। ডিএসই সাধারণ সূচক এক লাফে ২০৭ পয়েন্ট কমে যায়।
শেয়ার কিনেছিল কারা
আতঙ্কের কারণে বাজারে ধস নামলেও সর্বনিম্ন দরে শেয়ার কিনতে তৎপর হয়ে ওঠে একটি চক্র। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা যখন মূলধন তুলে নেয়ার জন্য দ্রম্নত শেয়ার বিক্রি করতে সচেষ্ট তখন কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউসের কর্মকর্তার সহায়তায় বিপুলসংখ্যক শেয়ার কিনে নেয় ওই চক্রটি। এ কারণেই ব্যাপক দরপতন সত্ত্বেও ওইদিন ১ হাজার ৪শ' ১৮ কোটি টাকার রেকর্ড লেনদেন হয়েছিল। মূলত সংঘবদ্ধ চক্রটিই মোবাইল ফোনে বিভ্রানত্মিকর তথ্য ছড়িয়ে বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত করে তোলে।
জানা গেছে, ১৩ জানুয়ারি এবং এর আগে ফেসবুক ও মোবাইল ফোনে শেয়ারবাজার সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য প্রচারকারীদের শনাক্ত করছে গোয়েন্দারা। ওইদিন কোন কোন ব্রোকারেজ হাউস থেকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কেনা হয়েছে_ তার একটি তালিকা করা হয়েছে। ওইসব ব্রোকারেজ হাউসের মাধ্যমে কারা কী পরিমাণ শেয়ার কিনেছে_ সেই তথ্যও নেয়া হয়েছে। বাজার ধসের পেছনে এদের ভূমিকা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এজন্য ওই ব্রোকারেজ হাউসগুলোর কর্মকর্তা ও বড় লেনদেনকারীদের মোবাইল ফোনের কললিস্ট যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
তদনত্ম প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত একজন কর্মকর্তা জানান, পরিকল্পিতভাবে শেয়ারবাজারে ধস নামানোর সঙ্গে জড়িত চক্রকে শনাক্ত করা খুবই দুঃসাধ্য কাজ। কারণ যেসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে দরপতন ঘটানো হয়েছে_ তাতে এ সংক্রানত্ম জোরালো প্রমাণ পাওয়া কঠিন।

No comments

Powered by Blogger.