এত বছর পর পুরস্কার!

১৯৫৮, ১৯৬২ ও ১৯৭০ বিশ্বকাপ জিতে জুলে রিমে ট্রফি চিরতরে নিয়ে গেছে ব্রাজিল। এত দিন পর ব্রাজিলিয়ান সরকার সেই তিনটি বিশ্বকাপজয়ী খেলোয়াড়দের পুরস্কৃত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে বিস্ময়ের সঙ্গে জন্ম দিয়েছে বিতর্কেরও।
বিশ্বকাপ ফুটবলজয়ী ব্রাজিল দলকে পুরস্কৃত করতে যাচ্ছে ব্রাজিল সরকার। বিশ্বকাপজয়ী দল...নিশ্চয়ই ধন্দে পড়ে যাচ্ছেন? ব্রাজিল সর্বশেষ ফুটবল বিশ্বকাপ জিতেছে তো সেই ২০০২ সালে! এত দিন পর পুরস্কার! বিস্ময়ের বাকি আছে আরও। ২০০২ তো নয়ই, নয় ১৯৯৪ বিশ্বকাপজয়ী দলও; ব্রাজিল সরকার পুরস্কৃত করছে ১৯৫৮, ১৯৬২ ও ১৯৭০ বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিল দলকে! এককালীন এক লাখ ব্রাজিলিয়ান রিয়াল (প্রায় ৫০ হাজার মার্কিন ডলার) অর্থ পুরস্কারের পাশাপাশি মাসিক ৩৯১৬ রিয়াল বৃত্তি দেওয়া হবে ওই তিন বিশ্বকাপে খেলা ৫৪ ফুটবলার বা তাঁদের উত্তরাধিকারীকে।
আধুনিক সময়ের তারকা ফুটবলারদের মতো অর্থের সাগরে ভাসা হয়ে ওঠেনি সেই সময়ের ফুটবলারদের। ফুটবল মাঠ কাঁপিয়ে বেড়ানো অনেকে হিমশিম খেয়েছেন জীবনযুদ্ধে। দেশের ফুটবল ইতিহাসের নায়কদের সম্মান জানানোর পাশাপাশি এত দিন পরে হলেও কিছুটা আর্থিক সহায়তা করার জন্যই এই উদ্যোগ। অনেক ব্রাজিলিয়ানের মতে, বিশ্বকাপজয়ই বিশ্ব মানচিত্রে ব্রাজিলকে আলাদা করে চিনিয়েছে এবং ব্রাজিলকে ফুটবল পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ১৯৭০ বিশ্বকাপজয়ী পেলে-জেয়ারজিনহো-রিভেলিনো-টোস্টাওদের ব্রাজিল তো সর্বকালের সেরা দল হিসেবে মোটামুটি সর্বজনীন একটা স্বীকৃতিই পেয়ে গেছে।
ব্রাজিলের সামাজিক নিরাপত্তামন্ত্রী গ্যারিবলদি আলভেস ফিলহো এই পুরস্কারকে বলছেন, ‘ন্যায়বিচারের পদক্ষেপ।’ ক্রীড়ামন্ত্রী আলদো রেবেলের কাছে এটা ঋণ স্বীকার, ‘আমার ধারণা, দেশের মানুষ জানে এই ফুটবলারদের কাছে আমাদের কত ঋণ। এটা বলতেই হবে, আজকের মতো আকাশছোঁয়া বেতন ও স্পনসরশিপ চুক্তি সেই সময়ের ফুটবলাররা পেতেন না। ওই ফুটবলাররা ছিলেন শিল্পীর মতো। একসময় দেশকে যাঁরা উঁচুতে তুলে ধরেছিলেন, তাঁরা কতটা কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, দেশের মানুষ কল্পনাও করতে পারবে না।’
পেলের মতো দু-একজন ছাড়া বিশ্বজয়ীদের বেশির ভাগই জীবনে স্বাচ্ছন্দ্যের ছোঁয়া পাননি। এর মধ্যে আছেন সেই সময়ের অনেক মহাতারকাও। ১৯৫৮ ও ১৯৬২ বিশ্বকাপজয়ী দলের গোলরক্ষক গিলমারের ছেলে মার্সেলো নেভেস এখন সাবেক ফুটবলারদের একটি সংস্থার সভাপতি। এই অর্থ পুরস্কারের ঘোষণা শুনে তিনি বলছেন, এটি অনেকের জীবন বদলে দেবে, ‘ওই ফুটবলারদের প্রায় ৮৫ শতাংশই মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত। এই অর্থ হয়তো অনেকের জন্য জীবনমরণের পার্থক্য গড়ে দেবে। গত বছর মারা যাওয়া ফেলিক্স (১৯৭০ বিশ্বকাপজয়ী দলের গোলরক্ষক) উপযুক্ত চিকিৎসা পাননি। ভালো হাসপাতালেও যেতে পারেননি। অর্থ থাকলে তিনি হয়তো আজও বেঁচে থাকতেন।’
পঞ্চাশ-ষাটের দশকে ফুটবল খেলা একটি পেশা হিসেবে স্বীকৃত ছিল না। এ কারণে সেই সময়ের অনেকেই সামাজিক নিরাপত্তা পেনশন পান না জানিয়ে নেভেস বলেছেন, ‘এই ফুটবলারদের বেশির ভাগেরই বয়স ৬৫-র বেশি। বাকি জীবনটা মর্যাদা নিয়ে বাঁচা নিশ্চিত করবে এই অর্থ।’
তবে সবাই কিন্তু এমন আবেগে ভেসে যাচ্ছেন না। এত দিন পর হঠাৎ এই পুরস্কার ঘোষণা নিয়ে সমালোচনার ঝড়ও উঠেছে। রেডিও ধারাভাষ্যকার আতিলা নুনেসের চোখে এটা চরম অন্যায়, ‘সারা জীবন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও যাঁরা এই পরিমাণ অর্থ আয় করতে পারেন না, সেই মেহনতি ব্রাজিলিয়ানদের গালে এটা বড় এক থাপ্পড়।’ নুনেসের প্রশ্ন, ব্রাজিলিয়ন ফুটবল কনফেডারেশনস (সিবিএফ) সাবেক ফুটবলারদের পাশে দাঁড়াতে পারে, সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকায় কেন তাঁদের সহায়তা করতে হবে?
প্রশ্ন তুলেছেন পুরস্কার পেতে যাওয়াদের দু-একজনও। নুনেসের সঙ্গে অনেকটাই একমত যেমন ১৯৭০ বিশ্বকাপজয়ী ও ফোলহা ডি সাও পাওলো পত্রিকার কলামিস্ট টোস্টাও, ‘শিরোপার জন্য সেই সময় আমাদের খুব ভালোভাবেই পুরস্কৃত করা হয়েছিল। যেসব বিশ্বজয়ী কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, অন্যসব নাগরিকের মতোই সামাজিক নিরাপত্তা এবং সাবেক অ্যাথলেটদের জন্য সরকারের বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা দিয়েই সরকার তাদের সহায়তা করতে পারে। সিবিএফ ও ক্লাবগুলোরও দায় আছে সাবেক ফুটবলারদের সাহায্য করার।’
পঞ্চাশ-ষাটের দশকে অন্য বেশির ভাগ শ্রমজীবীর চেয়ে ফুটবলাররা বেশি আয় করতেন জানিয়ে একজন ইতিমধ্যেই অস্বীকৃতি জানিয়েছেন অর্থ পুরস্কার নিতে! যৌক্তিক প্রশ্ন তুলছেন আরও অনেকেই। শুধু বিশ্বকাপজয়ীরাই কেন পুরস্কার পাবেন, আরও যাঁরা তাঁদের মতোই জাতীয় দলে খেলেছেন, অনুশীলনে ঘাম ঝরিয়েছেন তাঁরা কেন নয়! শুধু ফুটবলই-বা কেন, অন্য খেলার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা কেন নয়! শেষ প্রশ্নের উত্তর হয়তো একটিই—ফুটবল আর ব্রাজিল যে সমার্থক! রয়টার্স।

No comments

Powered by Blogger.