প্রাণের ফকির লালন by সিরাজ প্রামাণিক

কুষ্টিয়া শহরের অদূরে একটি ছায়াঘেরা নিবিড় গ্রাম ছেঁউড়িয়া। এক পাশে শান্ত নদী গড়াই, অন্য পাশে কালীগঙ্গা নদী। এখানেই বাউলসম্রাট লালন শাহের সমাধি। এই মাজারকে ঘিরে প্রতি বছর বসে লালন মেলা। ফকিরদের কণ্ঠে সুরের মূর্ছনা তৈরি করে লালনের গান। লাখো ভক্তের হৃদয়নিংড়ানো ভালোবাসায় সিক্ত হয় লালন আখড়া।প্রায় ২১৭ বছর আগে একদিন ভোরবেলায় ষোলো-সতেরো বছর বয়সের অচেতন অবস্থায় কিশোর লালন ভাসতে ভাসতে কালীগঙ্গা নদীর তীরে


আসেন। ওই দিন ভোরবেলা মাওলানা মলম শাহ ফজরের নামাজ পড়ে কালীগঙ্গা নদীর দিকে সকালের মৃদু বাতাসে শরীর জুড়ানোর জন্য গিয়েছিলেন। হঠাৎ দেখতে পেলেন এক অচেনা সংজ্ঞাহীন কিশোর অর্ধজলমগ্ন অবস্থায় পড়ে আছে। ছেলেটির মুখে ও শরীরে বসন্ত রোগের দাগ। তিনি কাছে গিয়ে দেখলেন ছেলেটি বেঁচে আছে। খুব ধীরলয়ে চলছে শ্বাস-প্রশ্বাস। মলম শাহ ও মতিজান দিনরাত সেবাযত্ন করতে লাগলেন। দিন দিন অচেনা যুবকটির মুখে জীবনের আলো ফিরে এলো। মতিজান জিজ্ঞেস করলেন, বাবা, তোমার নাম কী?
ফকির লালন।
লালনের জীবন-বৃত্তান্ত বিস্তারিতভাবে খুঁজে পাওয়া যায় ফকির আনোয়ার হোসেন মন্টু শাহ সম্পাদিত 'লালন সংগীত' নামক গ্রন্থে। তবে এসব তথ্য সর্বজনগ্রাহ্য নয়। কথিত আছে, গঙ্গাস্নান সেরে ফেরার পথে লালন বসন্ত রোগে গুরুতরভাবে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। রোগের প্রকোপে অচেতন হয়ে পড়লে সঙ্গী-সাথীরা তাকে মৃত মনে করে রোগ সংক্রমণের ভয়ে তাড়াতাড়ি নদীতে ফেলে দেয়। রোগমুক্তির কিছুদিন পর লালন ফকির বিদায় চাইলেন। বললেন, 'আমি সংসারত্যাগী মানুষ; এই ভবসংসারে আমার ঠাঁই নেই।' কথিত আছে, লালন অলৌকিকভাবে হেঁটে ওই সময়কার প্রমত্ত কালীগঙ্গা পার হয়ে যান। পরে মলম শাহ ডিঙি নৌকা নিয়ে পার হয়ে প্রায় দৌড়ে গিয়ে লালনকে ধরে ফেলেন এবং ছেঁউড়িয়া ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যথিত হৃদয়ে অনুরোধ করেন। লালন কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলেন, 'যেতে পারি তবে আমার জন্য আলাদা জায়গার ব্যবস্থা করতে হবে।' নিঃসন্তান মলম তার প্রিয় সন্তানের কথা রাখলেন। কালীগঙ্গা নদীর তীরে শ্যামল বৃক্ষমণ্ডিত মলমের বাগানে তৈরি হলো চৌচালা ঘর আর আখড়াবাড়ি। চৌচালা ঘরটি লালন সাধনকক্ষ হিসেবে ব্যবহার করতেন। অপরিসীম ভক্তি ও অনুপ্রাণিত হয়ে এক সময় মলম ও মতিজান লালনের কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেন।
লালনের মুখে বসন্তের দাগ ছিল। তার হাত দুটি এত লম্বা ছিল যে, দাঁড়ালে আঙুলগুলো হাঁটুর নিচে পড়ত। উঁচু নাক, উন্নত কপাল আর গৌর বর্ণের লালনের ছিল গভীর দৃষ্টিসম্পন্ন চোখ। কাঁধ বরাবর চুল, লম্বা দাড়ি, হাতে ছড়ি, পায়ে খড়ম, গায়ে খিলকা, পাগড়ি, আঁচলা_ সব মিলিয়ে লালন যেন এক সিদ্ধপুরুষ, পরিপূর্ণ সাধক। তবে প্রচলিতভাবে লালনের যে স্কেচ এখন বিভিন্ন স্থানে রক্ষিত, লালন সে রকমটি ছিলেন না।
ছেঁউড়িয়ায় কয়েক বছর থাকার পর লালন তার শিষ্যদের ডেকে বললেন, আমি কয়েক দিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি। তোমরা আমার সাধনকক্ষটার দেখাশোনা করো। সপ্তাহ তিনেক পর তিনি এক অল্পবয়স্কা সুশ্রী যুবতীকে নিয়ে ফিরলেন। মতিজান ফকিরানী জিজ্ঞেস করলেন, মেয়েটা কে বাবা? জানান, তোমাদের গুরুমা। এ কথা শোনার পর আখড়াবাড়ির সবাই গুরুমাকে ভক্তি করলেন। বিশখা নামের এই মেয়েটি সারাজীবন লালনের সঙ্গে ছিলেন। লালনের মৃত্যুর ৩ মাস পর তিনি মারা যান। বিশখা ফকিরানী প্রায় একশ' বছর ছেঁউড়িয়ায় ছিলেন। কিন্তু তার প্রকৃত নাম-পরিচয় জানা যায়নি।
লালন ফকিরের বয়স তখন ১১৬ বছর। একদিন তিনি শিষ্যদের ডেকে বললেন, এই আশ্বিন মাসের শেষের দিকে তোমরা কোথাও যেও না। কারণ পহেলা কার্তিকে গজব হবে। গজবের বিষয়টি শিষ্যরা কেউ সঠিকভাবে অনুমান করতে না পারলেও আসন্ন বিপদের আশঙ্কা করতে লাগল। মৃত্যুর প্রায় এক মাস আগে তার পেটের ব্যারাম হয়। হাত-পায়ের গ্রন্থিতে পানি জমে। পীড়িতকালেও তিনি পরমেশ্বরের নাম সাধন করতেন। মধ্যে মধ্যে গানে উন্মত্ত হতেন। এ সময় দুধ ছাড়া অন্য কিছু খেতেন না। তবে ইলিশ মাছ খেতে চাইলে শিষ্যরা বাজার থেকে ইলিশ মাছ নিয়ে আসে। দুপুরে সাধন ঘরের সামনে শামিয়ানা টানিয়ে খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করা হয়। বিকেল থেকে শুরু করে সারা রাত লালন তার শিষ্যদের শাশ্বত বাণী শোনান। মাঝে মাঝে গাওয়া হয় তার গান। রাতে আলোচনা শেষ করে লালন সাধন ঘরে ফিরে গেলেন বিশ্রাম নিতে। শিষ্যদের বললেন, আমি চললাম। লালন চাদর মুড়ি দিয়ে বিশ্রাম নিলেন, শিষ্যরা মেঝেতে বসে থাকলেন। এক সময় লালন কপালের চাদর সরিয়ে বললেন, তোমাদের আমি শেষ গান শোনাব। লালন গান ধরলেন। গভীর অপরূপ সুন্দর গান_ 'পার কর হে দয়াল চাঁদ আমারে/ক্ষম হে অপরাধ আমার/এই ভব কারাগারে।'
গান শেষ হলো। চাদর মুড়ি দিয়ে চিরদিনের জন্য নীরব হয়ে গেলেন ফকির লালন। ফকির লালনের জন্ম সাল জানা যায়নি। তিনি ১ কার্তিক ১২৯৭ বঙ্গাব্দ মোতাবেক ১৭ অক্টোবর ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে মারা যান এবং তিনি বেঁচে ছিলেন ১১৬ বছর। সে হিসাবে তিনি জন্মেছিলেন ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে। ছেঁউড়িয়াতে ফকির লালনের সঙ্গে তার পালক মা মতিজান ফকিরানী, পালক বাবা মলম শাহ, ফকির মানিক শাহ, শীতল শাহ, ভোলাই শাহ, বিশখা ফকিরানী এবং ফকির মনিরুদ্দিন শাহসহ আরও অনেক ভাবশিষ্যের সমাধি আছে। প্রতি বছর ১ কার্তিক এখানে দেশ-বিদেশের হাজার হাজার বাউল সমবেত হয়ে উদযাপন করেন তার মৃত্যুবার্ষিকী।
seraj.pramanik@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.