আকাশভরা সূর্য তারা by ওয়ালিউল মুক্তা

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশতজন্মবর্ষ উপলক্ষে গত ২৯ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হয় তিন দিনের 'রবীন্দ্র উৎসব : সুরের ধারা'। এই মহাআয়োজন পরিণত হয়েছিল রবীন্দ্র অনুরাগীদের মিলনমেলায়। উৎসবের নানা দিক নিয়ে নন্দনের এবারের প্রচ্ছদ রচনা রবীন্দ্রসঙ্গীতের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সুরের ধারা ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিল। তখন রঙিন শাড়িতে মেয়েরা গেয়েছিলেন কবিশ্রেষ্ঠর গান।


২০০০ সাল থেকে সুরের ধারা জামকজমকভাবে চৈত্র সংক্রান্তিতে উৎসব করেছে। সেই সব অনুষ্ঠানেও মেয়েরা একই রঙের শাড়ি পরেছিলেন। এসব অনুষ্ঠানে তাদের পরা একটি করে শাড়ি শোভা পেলো বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের করিডোরে। ২৯ থেকে ৩১ ডিসেম্বর 'রবীন্দ্র উৎসব : সুরের ধারা' উপলক্ষে সেখানে বসানো হয়েছিল একটি স্টল। এর একটিতে দেখা গেলো শাড়িগুলো। আরও ছিল সুরের ধারার মগ ও স্মৃতিবিজড়িত স্থিরচিত্র। গান, নৃত্যনাট্য, সেমিনার উপভোগের পাশাপাশি দর্শক আগ্রহ নিয়ে দেখেছেন সেগুলো। কেন্দ্রের মিল্কিওয়েতেও ছিল আরও কিছু স্টল। এগুলোতে দেখা গেছে সিডি, পোশাক, হস্তশিল্প, পানের দোকান ইত্যাদি। সবই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতবিতান থেকে নেওয়া ২ হাজার ২২২টি গানের ডিভিডি প্রকাশ উপলক্ষে। স্বল্প পরিসরে শুরু করা সুরের ধারা আজ দেশের রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা ও এর প্রসারে আস্থা ও বিশ্বাসের আশ্রয়স্থল। দীর্ঘ পথচলায় স্বপ্ন দেখেই আজ বিশ্বকে জানান দেওয়া আয়োজন করতে পারলেন বিশ্বকবিকে জীবনের অনিবার্য ধরে নেওয়া সুরের ধারার শিল্পীরা।
নবদিগন্তের কথা
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সাজসাজ রব। সম্মেলন কেন্দ্রের বাইরে বসানো হয়েছে প্রকাণ্ড এক মঞ্চ। খোলা প্রান্তরে অতিথিরা একে একে বসছেন চেয়ারে। টানা কয়েকদিনের রোদহীন আকাশে নীলবর্ণ আর উষ্ণ রোদের অভ্যর্থনা। যেন প্রকৃতিও নীরবে স্বাগত জানাচ্ছে সুরের ধারার রবীন্দ্র উৎসবকে। ঘড়ির কাঁটা সবে সাড় ৩টার ঘর পেরিয়েছে। এর মধ্যেই মাইকে ঘোষণা দেওয়া হলো_গান গাইতে মঞ্চে আসবে হাজারো শিল্পী। অনুষ্ঠান শুরু হবে বিকেল ৪টায়। অনুষ্ঠান যেন সময়ের কাঁটা বেয়ে চলে এজন্য আগেই মঞ্চে দাঁড় করানো হচ্ছে শিল্পীদের। অনুশীলনের সময় মঞ্চে ওঠানামার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। সুশৃঙ্খল মানুষের ধারায় পরিপূর্ণ হচ্ছে মঞ্চ। শুরু তো শুরুই, শেষ হওয়ার নামগন্ধ নেই! মঞ্চের বাম দিকে সামনের সারিতে বসলেন বাংলাদেশে রবীন্দ্রসঙ্গীত আঙিনায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে আসা শিল্পীরা। কে নেই! সোহরাব উদ্দীন, সাদি মহম্মদ, তপন মাহমুদ, মিতা হক, লিলি ইসলামসহ রবীন্দ্রসঙ্গীতকে জীবনের অংশ করে নেওয়া এ প্রাণগুলো এক মঞ্চে। মেয়েরা বাসন্তী আর গেরুয়া রঙের মিশেলে শাড়ি চড়িয়েছেন গায়ে। ছেলেদের পাঞ্জাবির নকশায় গেরুয়ার ছাপ। পুরো মঞ্চে একই রঙের ছড়াছড়ি। হাজার জনের রঙ আর বোধ্য গানের উপস্থাপনায় তুলে আনা অবোধ্য ভালোবাসা। প্রধানমন্ত্রীর আগমনের কিছুক্ষণের মধ্যে শুরু হলো জাতীয় সঙ্গীত 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি...'। হাজারো শিল্পীর সঙ্গে দাঁড়িয়ে থেকে দর্শকও কণ্ঠ মেলাল। বিশালকায় মঞ্চের সামনে পাতা হয়েছিল ছোট মঞ্চ, সেখানে নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন মাউসে ক্লিক করে উন্মোচন করেন গীতবিতানের আধুনিক রূপ 'শ্রুতি গীতবিতান'। অমর্ত্য সেনের নির্দি্বধায় বলে দেওয়া কথাটি যেন আনন্দের মাত্রা উসকে দেয়_ 'রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে যে এমন কাজ করা যায়, তা আমার মাথায় ঢোকেনি। রবীন্দ্রনাথের গানের ভাবনার যে রূপ রয়েছে, শ্রুতি গীতবিতানের মাধ্যমে তা সবার কাছে পেঁৗছে যাবে।' এরপর প্রধানমন্ত্রীর উৎসবের ঘোষণা আর ভারতীয় সঙ্গীত পরিচালক দেবজ্যোতি মিশ্রর নির্দেশনায় শুরু হয় উৎসবের মূল আকর্ষণ সহস্র কণ্ঠের গান। দেবজ্যোতি মিশ্রের পাশে দাঁড়িয়ে কণ্ঠ মেলান রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাও। পাশ্চাত্যের যন্ত্রানুষঙ্গ সিম্ফনির সঙ্গে ভেসে আসে 'প্রথম দিনের দিগঙ্গনে', 'কান্না হাসির দোল', 'আগুনের পরশমণি', প্রথম আদি তব শক্তি', 'ও আমার দেশের মাটি', গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ', 'আকাশভরা সূর্য তারা', 'প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে' এবং 'ওই মহামানব আসে' গানগুলো।
শ্রুতি গীতিবিতানের টানে
উৎসবে বিশ্ব্বের প্রায় ২০টি দেশ থেকে রবীন্দ্রশিল্পীরা এসেছিলেন। তাদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনার কমতি ছিল না। উৎসবস্থলে ডিভিডির জন্য অনেকে নাম নিবন্ধন করেছেন। এখন পর্যন্ত মোট কতজনের নাম নিবন্ধিত হয়েছে তা নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। তবে উৎসব চলাকালে প্রায় ৭ লাখ টাকা জমা পড়েছে বলে আয়োজকরা জানান। এটি শুধু উৎসবে আসা দর্শকের নিবন্ধনের অর্থ। এতেই উপলব্ধি করা যায় সংগ্রহশালা নিয়ে সবার মধ্যে প্রচুর আগ্রহ। 'শ্রুতি গীতবিতান' বিপণন করবে ইমপ্রেস অডিও ভিশন। শিগগির বিষয়টি বিস্তারিতভাবে জানা যাবে।
সম্মোহনী সুর
সাঝের বেলায় মিল্কিওয়েতে সুরের ধারার শিশু বিভাগ সম্মেলক গান পরিবেশন করে। এরপর গেয়েছেন বাংলাদেশের ফাহমিদা খাতুন, অদিতি মহসিন, মহুয়া মঞ্জরী সুনন্দা ও প্রতীক বাবু। এদিন ছোটদের জন্য 'বীরপুরুষ' কবিতা আবৃত্তি করেন পশ্চিমবঙ্গের ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়। তার বচনভঙ্গি আর সাবলীল পরিবেশনা ছোটদের পাশাপাশি বড়রাও উপভোগ করেন। আবৃত্তির পর শ্রীকান্ত আচার্য গানের ফাঁকে ফাঁকে তুলে ধরেন বিশ্বকবির সৃষ্টিকর্ম নিয়ে তার জানা কথাগুলো। দ্বিতীয় দিন সকালে শান্তিনিকেতনের সপ্তক ও শাশা ঘোষালের গান মুগ্ধ করেছে দর্শককে। তবে এদিন সন্ধ্যায় ১৭ দেশের ৩৫ শিল্পীর দল গান্ধর্বলোক অর্কেস্ট্রার গাওয়া রবীন্দ্রনাথের গান ছিল মূল আকর্ষণ। এদের সঙ্গে ছিলেন সুরের ধারার ৪০ জন সদস্য। ইংল্যান্ড ভ্রমণ, জার্মানি সফরসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশে বসে লেখা কবিগুরুর নানা সৃষ্টিকর্মের কথা নিয়ে তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় কবিতা ও গানে পরিবেশন করা হয় 'বিলাতে রবীন্দ্রনাথ'।
নৃত্য জালের মায়া
কবিগুরুর গানে নাচের ছন্দে পা দুলিয়েছেন বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন নৃত্যশিল্পীরা। নৃত্যনাট্য, গীতিনাট্য ছাড়াও রবীন্দ্র-নৃত্যধারা নিয়ে শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনায় নৃত্যালেখ্য 'আলোকের এই ঝর্ণাধারা' ও তামান্না রহমানের পরিবেশনায় কবিতার নাট্যরূপ 'বিদায় অভিশাপ' অনেকদিন আলাদাভাবে মনে পড়বে দর্শকের। উৎসবের প্রথম দিন রাতে হল অব ফেমে ভারতের জলপাইগুড়ি থেকে আসা ইমনের পরিবেশনায় ছিল 'চণ্ডালিকা'। দেশের বাইরের দল বলে আলাদা আগ্রহ ছিল এই নৃত্যনাট্যকে ঘিরে। তাদের পরিবেশনা শুরুর পর গানের সঙ্গীতায়োজন এবং উপস্থাপনা ভিন্নতার স্বাদ দেয় দর্শকদের। সুরের ধারার শিশুদের পরিবেশনায় গীতিনাট্য 'কালমৃগয়া' মঞ্চস্থ হওয়ার পর বিদেশি অতিথিদের মধ্যে সাড়া দেখা গেছে বেশি। শেষ দিন শান্তিনিকেতনের পরিবেশনায় নৃত্যনাট্য 'চিত্রাঙ্গদা' নৃত্য আর অভিনয় দক্ষতায় ছাড়িয়ে যায় প্রত্যাশার মাপকাঠি।
আলোচনার মঞ্চে রবি ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু সাহিত্যের মাঝেই নিজেকে আটকে রাখেননি, তার চিন্তা ও মননে স্থান পেয়েছিল শিক্ষা, মানব উন্নয়নের মতো কাজ। কবিগুরুর কাজের নানা দিক নিয়ে আটটি সেমিনার হয় উৎসবে। এগুলোতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শফি আহমেদ [রবীন্দ্রনাথের নাটক], বিশ্বজিৎ ঘোষ [ছোটগল্প], রামকুমার মুখোপাধ্যায় [উপন্যাস], আতিউর রহমান [উন্নয়ন ভাবনা], স্বপন মজুমদার [শিক্ষা চিন্তা], অমিয় দেব [কবিতা], আল্পনা রায় [গান], সোমেন বন্দ্যোপাধ্যায় [সাহিত্য ও চিত্রকলার সম্পর্ক] এবং কেতকী বুশরী ডাইসন ও সুশোভন অধিকারী [চিত্রকলা]। এই আটটি বিষয়ে বিভিন্ন দেশের বক্তারা আলোচনায় অংশ নেন।
ভাঙলো যখন মিলনমেলা
দেশের সব রবীন্দ্রসঙ্গীত সংগঠনের
স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে তিনদিনের এ উৎসব পরিণত হয় মহাউৎসবে। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সম্মেলন কেন্দ্রের ইতিউতি ঘুরে বেড়িয়েছেন অনেকে। 'শ্রুতি গীতবিতান'-এর মোড়ক উন্মোচন, হাজার শিল্পী গান গাওয়া, সঙ্গে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান_ নিরস এ তিন বাক্যে তিন দিনের অনুষ্ঠানের মাহাত্ম্য তুলে ধরা সম্ভব নয়। কবিগুরু গীতবিতানের ২ হাজার ২২২টি গানকে ডিভিডিতে আনতে গত বারো মাস দৈবতুল্য পরিশ্রম করেছেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা আর তার রবীন্দ্রসঙ্গীতের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সুরের ধারার সদস্যরা। তাদের সব পরিশ্রম সার্থক হয়েছে হাজার হাজার দর্শকের উপস্থিতিতে। ৩১ ডিসেম্বর রাতে রবীন্দ্র উৎসবের মিলনমেলা ভেঙেছে। শিল্প ও সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিশীল কাজ যেন আকাশভরা, সেগুলোকে ঘিরে সূর্য-তারার মতো জ্বলজ্বলে শিল্পীদের এই অংশগ্রহণ মনে থাকবে অনেকদিন।

No comments

Powered by Blogger.