বাংলাদেশের ইতিহাসের হৃদয়ে -শিখা চিরন্তন ও জাতীয় স্মৃতিস্তম্ভ by শেখর দত্ত

প্রাতঃভ্রমণে রমনা পার্কে প্রতিদিন যাই, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানও আকর্ষণ করে। এ উদ্যানে ৭ মার্চ স্মৃতিস্তম্ভটি উদ্বোধন হয়। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে 'ক্রিয়েশন আনলিমিটেড' ও 'গৌরবের প্রান্তর'-এর যৌথ উদ্যোগে 'বাংলাদেশের হৃদয় হতে' লাইট অ্যান্ড সাউন্ড অনুষ্ঠানের প্রান্তস্থিত একজন সংগঠক ও দর্শক হিসেবে সেখানে যাওয়ার ফলে আকর্ষণ বেড়ে গিয়েছিল। সর্বোপরি সুদীর্ঘ ৫০ বছরের রাজনৈতিক জীবনের মূল্যবান সব স্মৃতি রয়েছে ওই পার্ককে ঘিরে। বাংলাদেশের


ইতিহাসের পথপরিক্রমায় এই স্থানটি তাৎপর্যপূর্ণ পবিত্রতম স্থান হিসেবে চিরঞ্জীব থাকবে। কাকতালীয় কি-না জানি না, মানচিত্রে রাজধানী ঢাকা রয়েছে বাংলাদেশের মাঝখানে আর এই উদ্যানটি ঢাকার কেন্দ্রে; বাংলাদেশের হৃদয়ে। এই উদ্যানে যাওয়া মানে বাংলাদেশের ইতিহাসের হৃদয়ে যাওয়া। ওই পবিত্র স্থানে গেলে বর্তমানে দাঁড়িয়ে যেমন অতীতের হৃদস্পন্দনকে অনুভব করা যায়, ঠিক তেমনি ভবিষ্যতের স্বপ্নও চোখে ভাসে।
এক সকালে রমনা পার্ক পেছনে রেখে রাস্তা পার হতে ওভারপাসে উঠলাম। কিন্তু একি! দুর্গন্ধে নাক সিঁটকে এলো। বুঝতে অসুবিধা হলো না, পথচলা মানুষের মলত্যাগের নিরাপদ স্থান হয়েছে ওভারপাসটি। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাঁয়ে রেখে অর্ধভেজানো গেট দিয়ে উদ্যানে ঢোকার পথ। লেখা রয়েছে : উদ্যানকে সুন্দর ও সবুজ রাখতে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলা নিষেধ। স্মৃতিস্তম্ভ অভিমুখে হেঁটে চললাম। সামনে শান বাঁধানো লেক। এত ভোরেও স্নানে নেমেছে কয়েকজন। লেকের ওপরের পুলে পানি জমে আছে। গত রাতের বৃষ্টির পানি। এরপর স্মৃতিস্তম্ভের বিশাল চত্বরের ডানদিকের সিঁড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। লেখা আছে 'প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত'। চারদিক অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন। বাদামের খোসা, খালি বোতল, দলামোচা ঠোঙা, চিপসের খোসা ছড়ানো-ছিটানো। হঠাৎই পেছন থেকে বাঁশির আওয়াজ। বুঝতে অসুবিধা হলো না পাহারাদারদের বাঁশি। পেছনে তাকাতেই দেখলাম, বেশ একটু দূরে পুলিশ তাঁবুর ভেতরে উঠে দাঁড়িয়েছে। হাত তুলে তাকে অভয় দিলাম। সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে অর্ধসমাপ্ত ম্যুরালগুলোর দিকে তাকালাম। হঠাৎই দেখি একজোড়া কুকুর বেদি আর মূল দেয়ালের মাঝখানের নিচু পথটা দিয়ে চলে যাচ্ছে। ক্ষোভ আর দুঃখে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা হলো, ধরণী দ্বিধা হও। দ্রুত পায়ে সেখান থেকে সরে গেলাম। যেদিক থেকে বসে লাইট অ্যান্ড সাউন্ড দেখেছিলাম সেদিকে। ভাবলাম, রমনা কালীবাড়ি দেখে যাই। যেতে যেতে দেখি কর্তৃর্পক্ষের আদেশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এদিক-ওদিক দলবেঁধে ফুটবল আর ক্রিকেট খেলা হচ্ছে। চারদিকে অসংখ্য টঙের দোকান চোখে পড়ল। ভাবলাম, ব্যবসা করে যদি কিছু পরিবার বাঁচে তবে দোষ কী। আর বেআইনি জায়গায় খেললেও এদের থেকেই একদিন হয়তো বেরিয়ে আসতে পারে আকরাম খান কিংবা সাকিব আল হাসানের মতো ক্রিকেটার; কেউ তো ফুটবলারও হতে পারে সালাউদ্দিন কিংবা মতিউর মুন্নার মতো।
একটু যেতেই দেখি উন্মুক্ত মঞ্চ। অযত্নে হতশ্রী অবস্থায় রয়েছে। হঠাৎই কানে এলো, কেউ কবিতা আবৃত্তি করছে। কে বা কারা কবিতা পড়ছে দেখব ভেবে অগ্রসর হতেই প্রথমে চোখে পড়ল শহীদ মিনার। এর পাশে একজন তরুণ বসে জোরে জোরে কবিতা পড়ছে। ভাবলাম কী ধরনের কবিতা পড়ছে, তা শুনতে হবে। কিন্তু আমাকে তার কাছে যেতে হলে শহীদ মিনার হয়ে যেতে হবে। শহীদ মিনারের কাছে এসে দাঁড়ালাম। ইতিমধ্যে বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। তা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আবৃত্তির গলাও চড়ছে। শহীদ মিনার যে এখানে আছে তা জানতামই না। খুব কাছে গিয়ে অতি কষ্টে শহীদ মিনারের বেদিতে কী লেখা আছে, তা পড়তে চেষ্টা করলাম। অগণিত শহীদের নাম। ওগুলো মুছে যাচ্ছে, অস্পষ্ট। বেদির ওপরে স্তম্ভের গা ঘেঁষে নিচ থেকে ওপরে একটি অর্ধগোলাকৃতি প্রশস্ত স্থাপনা। সহজেই ধারণা করা গেল, শহীদের আশ্রয়স্থল হিসেবে একে কল্পনা করা হয়েছে। সেখান থেকে ভেসে আসছে গোঙানির শব্দ। এক যুবকের অর্ধশরীরও দেখা গেল। ভয়ে সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। মানিব্যাগ ও মোবাইলের জন্য ভয় হলো। দ্রুত ওখান থেকে নেমে এলাম। ইতিমধ্যে বৃষ্টি আরও বেড়ে গেছে। কিছুটা পথ এসে বাঁয়ে ঘুরতেই দেখি ওই অর্ধগোলাকার আশ্রয়ে আছে তিন যুবক। একজন খালি গায়ে চিত হয়ে শুয়ে আছে। আর দু'জন বসে নীরবে কিছু খাচ্ছে। আমাকে লক্ষ্য করার মতো হুঁশ ওদের নেই। মাদকসেবীদের জন্য এর চেয়ে নিরাপদ স্থান আর কী হতে পারে!
এবার আমার গন্তব্য কালীবাড়ি। ছেলেবেলায় মামাবাড়িতে ঢাকায় এলে সবচেয়ে উঁচু এই মন্দিরে কতবার যে গিয়েছি। পাকবাহিনী এই মন্দিরটি রেসকোর্সের মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছিল। এত ভোরেও মন্দিরের দরজায় ভক্তদের ছোট একটি জটলা। এখনও মনে পড়ে, পাকিস্তান আমলের শেষদিকে কী করুণ দশা হয়েছিল মন্দিরটির। তখন আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। একসময় জগন্নাথ হলে আমাদের কাছে অভিযোগ এলো, ওই মন্দিরকে ঘিরে নানা ধরনের অবৈধ অপকর্ম হচ্ছে, অবৈধ দখলদারদের উৎপাত চলছে। হল থেকে দলবেঁধে আমরা সেখানে গেলাম। আপাতত শান্তি ফিরে এসেছিল।
ওখান থেকে হেঁটে যখন শিখা চিরন্তনের কছে পেঁঁৗছলাম, বেশ জোরে বৃষ্টি হচ্ছে। চত্বরটি অপেক্ষাকৃত পরিচ্ছন্ন। তবে সিগারেটের টুকরো থেকে চীনা-বাদামের খোসা সবই আছে। বাঁ দিকে শিশুপার্কের সামান্য কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে। শিশুপার্কটি তৈরি করা হয়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানকে লোকচক্ষুর অন্তরালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তা পারা যায়নি। এখানে-সেখানে গড়ে উঠছে স্মৃতিস্তম্ভ। মনকে প্রবোধ দিলাম এই বলে, এখন তা আছে অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন হয়ে অনেকটাই অভিভাবকহীন অবস্থায়। সেদিন হয়তো দূরে নয়, যখন এটি অতুলনীয় সৌন্দর্যমণ্ডিত একটি পবিত্র দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিগণিত হবে। চোখের সামনে সেই স্বপ্নের দিনগুলোর কথা ভাবতেই স্বপ্ন ছিন্ন হয়ে গেল। একটা ফুটবল সজোরে গিয়ে ধাক্কা দিল স্মৃতিস্তম্ভের দেয়ালে।
তখন দুটি বিষয় ভাবনায় এলো; প্রথমত, যদি না পবিত্র স্থানকে যথাযথ সম্মান দিয়ে সুরক্ষা করা যায়, তবে তা নির্মাণ করা হয় কেন? কেনই-বা অর্ধসমাপ্ত অবস্থায় এটি উদ্বোধন করা হলো? দ্বিতীয়ত, যদি থাকত বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় তবে সহজেই দোষ দিয়ে বলা যেত, 'ওদের' হাতে পড়ে আজ স্মৃতিস্তম্ভ ও শিখা চিরন্তনের এই দশা! এখন দোষ দিই কাকে? এর দায় নেবে কে? যথাযথ মর্যাদা দিয়ে পবিত্র এ স্থানটিকে রাখার কি কোনো উপায় নেই? প্রশ্নগুলো ভাবতে ভাবতে গেটের কাছে চলে এলাম। কিছুদিন আগে সর্বোচ্চ আদালত রায় দিয়েছিলেন, ভাষা শহীদ মিনারকে সঠিকভাবে স্বমর্যাদায় সুরক্ষা করতে। করা হচ্ছে কি? ক্ষোভ আর দুঃখ রাখার জায়গা কোথায়! বয়স যদি এখন ষাটের কোঠায় না হয়ে ষাটের দশকের মতো হতো, তবে বিদ্রোহী হয়ে গেটে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলার নিষেধাজ্ঞা সংবলিত টিনের বিজ্ঞপ্তিটা টেনে ছিঁড়ে ফেলে দিতাম। কিন্তু ধৈর্যের সীমানা যে এখন দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। তাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হওয়া ছাড়া উপায় কী? বিজয়ের মাস ডিসেম্বর সামনে। ডিসেম্বরকে ঘিরে আবারও কি আমরা এই স্থানটিকে নিয়ে আনুষ্ঠানিকতায় মাতব না!

শেখর দত্ত : রাজনীতিক
 

No comments

Powered by Blogger.