মন্ত্রীদের আলগা কথা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেঃ অনিশ্চয়তা ও আশঙ্কা বাড়ছে

বেশি খাওয়া আর বেশি কথা বলা যে কী বিপদ ডেকে আনতে পারে, সেটা অনেকে বুঝতে চান না। বেশি খাওয়ার ফলে শেষকালে জীবন সংশয় হয়ে ওঠে। তখন নিয়ন্ত্রণ আরোপের পাশাপাশি হাসপাতালেও যেতে হয়। আর বেশি কথা বলার পরিণতি সাধারণের ক্ষেত্রে তেমন না হলেও দায়িত্ববানদের ক্ষেত্রে বিপদের কারণ হতে পারে— এটা অস্বীকার করা যাবে না। তবে মহাজোট সরকারের মন্ত্রীরা কথাটা মনে রেখেছেন বলে মনে হয় না।
তারা বেশি কথা বলে পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করতে যেন বেশি আগ্রহী। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মন্ত্রিসভা গঠনের চমকের চেয়ে মন্ত্রীদের কথার চমকই বেশি বলতে হবে। এক্ষেত্রে বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান সবাইকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেছেন। সরকারের প্রথম ৬ মাসে মিডিয়ার সামনে তিনিই ছিলেন উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। দায়িত্ব গ্রহণের পরই তিনি বাজারে ছুটে যান এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ে মুখ খোলেন। কিন্তু মহাবিস্ময়ের ব্যাপার হলো, তার কথায় বাজার আরও অনিয়ন্ত্রিত হয়ে ওঠে। কয়েক মাস ধরে এমন চাঞ্চল্য সৃষ্টির পর সম্ভবত তার হুঁশ ফিরেছে এবং তিনি ঠোঁট চেপে রাখতেই এখন সচেষ্ট। তারপরও বিডিআর হত্যাকাণ্ড তদন্তের সমন্বয়কারী হিসেবে তার কথা মানুষ ভুলতে পারে না। জঙ্গিরা বিডিআর হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে—এমন কথা বলে তিনি যে ফানুস উড়িয়েছিলেন তার পরিণতি টের পেয়ে সেটা প্রত্যাহার করতে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন। বাণিজ্যমন্ত্রী বেশি কথা বলার বদঅভ্যাস ত্যাগ করলেও অন্যরা যেন বেপরোয়া থাকারই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দেরিতে মন্ত্রী হলেও নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান এক্ষেত্রে অন্যদের পেছনে ফেলে দিয়েছেন। ক্রসফায়ারের পক্ষে সাফাই গেয়ে এই সাবেক পরিবহন শ্রমিক নেতা সবার দৃষ্টি কাড়েন। সর্বশেষ তিনি বোমা ফাটানো বক্তব্য দেন নৌশ্রমিক ধর্মঘটের জন্য বঙ্গবন্ধু হত্যার সাহায্যকারীদের দায়ী করে। জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী এ ধর্মঘটকালে তিনি নিজ দায়িত্ব পালনের চেয়ে নির্বাচনী এলাকায় ভোটব্যাংক রক্ষাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। একইভাবে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুও অত্যাধুনিক অস্ত্রসহ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ধরা পড়ার পর বিজ্ঞের মতো বলেছেন, বিগত বিএনপি জোট সরকারের আমলে বিদেশ থেকে চোরাইপথে আসা অস্ত্রই এখন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হাতে। মুখ খোলার আগে একটু চিন্তা করলে সন্ত্রাসে নিজ দলের সম্পৃক্ততার এমন সার্টিফিকেট তিনি দিতে পারতেন না। গোপনে পদত্যাগকারী তার পূর্বসূরি সোহেল তাজও সন্ত্রাসাী ধরার বড় বড় প্রতিজ্ঞার কথা বলে এখন দেশ ছেড়ে স্বপেম্নর দেশে জীবন কাটাচ্ছেন। রাজনৈতিক উত্তরাধিকার বা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব কিছুই তাকে আমেরিকার আকর্ষণ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারেনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বয়সে প্রবীণ হলেও কথাবার্তায় অন্যদের চেয়ে কম যান না। মন্ত্রী হওয়ার পর পর ৩১ জানুয়ারি তিনি জীবন বাজি রেখে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, পাচার ও মাদক সমস্যা সমাধানের কথা শোনান। এর ক’দিন পরই ৩ ফেব্রুয়ারি পরিস্থিতি তাকে বলতে বাধ্য করে, দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ইদানীং সন্ত্রাস ও আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার বেড়ে গেছে। আর ১৭ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর তেজগাঁও থানা কম্পাউন্ডের অনুষ্ঠানে তিনি কবুল করেন সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ ও দুর্নীতিবাজে দেশ ছেয়ে গেছে। এ ধরনের স্বীকারোক্তি স্বাধীনতার পর পরই শীর্ষ ব্যক্তির মুখেও শোনা গিয়েছিল। এখন নিয়মিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মধ্যেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্য হলো, তার সরকার এর বিপক্ষে। ১৪ জুন আমেরিকার সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে তিনি জানান, এ সরকারের আমলে কোনো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেনি। চোখ বন্ধ করে দিনকে রাত করার চেষ্টা বটে! আর আইনমন্ত্রী ব্যারিসল্টার শফিক আহমেদের সদম্ভ ঘোষণা ছিল, বিডিআর হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু হবে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। এখন দ্বিতীয় সপ্তাহ পার হতে চললেও তার কোনো আলামত দেখা যাচ্ছে না। এখনও চলছে গ্রেফতারকৃত বিডিআরদের রিমান্ডে নেয়ার পালা। অন্যদিকে এ বছরের ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ করার ঘোষণাও ছিল তার। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে বিচার আদৌ শুরু করা সম্ভব হবে কিনা সেটা হয়তো ভেবে দেখেননি এই শীর্ষ আইনজীবী। মন্ত্রী বলেই কি এভাবে কল্পনার জগতের বাসিন্দা হতে হয়? একইভাবে মন্ত্রীবচনে সক্রিয় রয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেনসহ অন্য মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী। তবে বিভ্রান্তিকর বচনে অন্যদের থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও কম যান না। গত ১ মার্চ বিডিআর বিদ্রোহকে সুপরিকল্পিত আখ্যা দিয়ে তিনি জানিয়েছিলেন, মৃত্যুর আগে বিডিআর ডিজি শাকিল তাকে ফোন করেছিলেন, বিপদের কথা বলে সহযোগিতা চেয়েছিলেন। আর ৩০ মার্চ এ প্রসঙ্গে সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের কাছে বলেন, ঘটনার কথা শুনে আমি নিজেই তাকে ফোন করি। তাহলে এক্ষেত্রে তার কোন বক্তব্যকে আমরা সত্য বলে মেনে নেব!
অভিজ্ঞদের বাদ দিয়ে চমক সৃষ্টিকারী মহাজোট সরকারের মন্ত্রীদের বেপরোয়া কথাবার্তা এবং দায়িত্ব পালনের নমুনা দেখে মাত্র ১০ মাসেই মানুষের মনে গভীর অনিশ্চয়তা ও আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিদিনকার ঘটনা ও মন্ত্রীদের বিভ্রান্তিকর কথাবার্তায় পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে উঠছে। মানুষ জানে না ভবিষ্যৎ নিয়ে সরকারের ভাবনার কথা। তবে দেশবাসীর মনোভাব যে স্বস্তিদায়ক নয়, সেটা কান পাতলেই শোনা যায়।

No comments

Powered by Blogger.