নতুন মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং এসএসবির ভাগ্য-প্রশাসন by বদিউর রহমান

নপ্রশাসনের একটা মান-মানিতা আছে এবং আমলাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠতারও একটা আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত না সরকার আইন অথবা বিধির মাধ্যমে পদোন্নতি প্রদানের মূল ভিত্তি পিএসসির মাধ্যমে পরিচালিতব্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ব্যবস্থা করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত বর্তমান রেওয়াজে এসএসবির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণই থেকে যাচ্ছে। উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত সব পদ সোপানেই এসএসবির অর্থাৎ সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের সুপারিশের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীর


অনুমোদনক্রমে পদোন্নতি হচ্ছে। বিএনপির গত মেয়াদ থেকে 'দলবাজি' পদোন্নতিতে দৃশ্যমান ভূমিকা রাখছে। কোনো কোনো দক্ষ কর্মকর্তা দলবাজিতে আদৌ সম্পৃক্ত না হলেও ক্ষমতাসীন দলের খুব আস্থাভাজন অপর কোর-আমলারা যখন ওসব কর্মকর্তাকে ভিন্নমতের অর্থাৎ সরকার সমর্থক নয় ভাবেন এবং সেভাবে চিহ্নিত করেন, তখন তাদের কপাল পোড়ে। নব্বইয়ের দশকে বিএনপির প্রথম মেয়াদে দলবাজির অভিযোগ তেমন ছিল না, তখন মুক্তিযোদ্ধা ব্যাচের কর্মকর্তাদের সরকারের অপছন্দের বিষয়টি প্রকাশ্য ছিল। তারপরও শিক্ষামন্ত্রী জমিরউদ্দিন সরকার এবং সংস্থাপন প্রতিমন্ত্রী নুরুল হুদার গণপদোন্নতিতেও দলীয় বিবেচনায় অতিক্রান্ত করার ঘটনা খুব একটা ঘটেনি। এসএসবিকে বাদ দিয়ে মন্ত্রিপরিষদ কমিটির মাধ্যমে মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে পদোন্নতি দেওয়ার নতুন চালু করা প্রথাও আবার উঠে যায়। তখন ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয় যে, এসিআরের ৬০%-এ যত ভালোই কোনো কর্মকর্তা করুন না কেন মৌখিকের ৪০%-এর মধ্যে তাকে 'ডুবিয়ে' দেওয়া সম্ভব। পদোন্নতির জন্য নির্ধারিত ১০০ নম্বরের মধ্যে সর্বশেষ ১০ বছরের এসিআরে গড়ে ৯০% নম্বর পেলে তার ৬০% হয় ৫৪ অর্থাৎ ৬০-এর মধ্যে ৫৪। এই কর্মকর্তাকে মৌখিকে যদি ৪০-এর মধ্যে ১৫ নম্বর দেওয়া হয় তার মোট নম্বর হয় ৬৯ অর্থাৎ পদোন্নতি যোগ্যতার ৭০ থেকে ১ নম্বর কম। অতএব তিনি পদোন্নতি পেলেন না। আর কোনো এক অপদার্থ অফিসার ১০ বছরের এসিআরের ৬০%-এ ৬০% প্রাপ্ত নম্বরের হারে ৩৬ নম্বর পেয়েও মৌখিক ৪০-এর মধ্যে ৩৪ বা ততোধিক নম্বর পেয়ে ৭০ বা তদূর্ধ্ব নম্বর প্রাপ্ত হয়ে পদোন্নতি পেয়ে গেলেন। কী আজগুবি ব্যাপার, তাই না? সে সময়ে একটা কথা বেশি উচ্চারিত হয়েছিল_ যদি হতে চাও ডিএস, হও আগে পিএস। কারণ মন্ত্রীদের পিএসরা সব ডিএস (উপসচিব) হয়ে গিয়েছিলেন নির্বিঘ্নে। তারও আগে এরশাদ কিংবা জিয়া-সাত্তারের আমলেও পদোন্নতির অন্যায় নিয়ে তেমন কিছুই শোনা যায়নি, দু'একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া। তার একটা বড় কারণও ছিল এবং তা হচ্ছে পাকিস্তানি আমলের তিন-অক্ষরী সাহেবদের অটুট ঐক্য এবং তাদের নিজস্ব যোগ্যতার সঙ্গে সরকারের ওপর তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য। খালেদা জিয়ার প্রথম মেয়াদও মোটামুটি ভালোই গেছে বলা চলে। যত বিপত্তি শুরু হলো দ্বিতীয় মেয়াদে আর তা প্রকট রূপ ধারণ করল '৭৩ ব্যাচ অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধা ব্যাচকে পদোন্নতিতে বাদ দেওয়ার 'চোরা-কৌশলের' পর। নতুন করে পদোন্নতি নীতিমালা হলো বিএনপি-ঘরানার বলে চিহ্নিত এবং পরিচিত কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে। বিশেষ করে '৭৯ ব্যাচের কয়েকজনের সমন্বয়ে এমনভাবে করা হলো যে, শিক্ষাগত যোগ্যতার ২৫ নম্বরে ওই '৭৩ ব্যাচ মার খেয়ে যায়। জানা গেল, শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগের ফলের জন্য নম্বর সেট করার আগে ওই ব্যাচের অফিসারদের রেকর্ড দেখে তা এমনভাবে ঠিক করা হলো, যাতে তারা বাদ পড়েন। ১০০'র মধ্যে মোট পাস নম্বরও ৮০'র ওপরে সেভাবে ঠিক করা হলো। কিন্তু '৭৯ ব্যাচকে তাড়াতাড়ি সচিব করার জন্য অতিরিক্ত সচিব পদের দু'বছরের মেয়াদও শিথিল করা হলো। জুলাই ২০০৫-এর ব্যাচকে পদোন্নতি (সচিব পদে) দেওয়ার সময়ে ড. সা'দতের মন্ত্রিপরিষদ সচিব থাকাকালীন ঘটল ন্যক্কারজনক ঘটনা। বিএনপি-ঘরানার বলে সুপরিচিত নিচের দিকের একজনকে সচিব করার জন্য অন্য অনেক যোগ্যতর কর্মকর্তাকে মাঝে মধ্যে ডিঙিয়ে তার ক্রমিক পর্যন্ত আনা হলো। অথচ তার উপরের বেশ কয়েকজন যোগ্যকেও ওই 'কোর গ্রুপের' বিরোধিতার কারণে বাদ দেওয়া হলো। ড. সা'দত কখনও এর সদুত্তর দিতে পারেননি, পারলে তিনি এখনও দিতে পারেন, আমরা খুশি হবো। একজন মন্ত্রিপরিষদ সচিব যে কেন এমন অন্যায় করলেন তার একমাত্র জবাব হয়তো দলীয় হুকুম পালন এবং পরবর্তী চুক্তি নিশ্চিত করা। আমলারা যে কখন নিজ স্বার্থে মেরুদণ্ডহীন হয়ে পড়েন_ সে নজির দেখলাম একজন জুনিয়র আমলা হয়ে। আমরা শুনতে লাগলাম, ড. আকবর আলি খানের পর মন্ত্রিপরিষদ সচিবের ন্যায়ভিত্তিক গুণগত মান এবং সাহসের পতন হতে থাকল। ড. সা'দত এবং ড. কামাল উদ্দীন সিদ্দিকীর পারস্পরিক 'বাজে' সম্পর্কের কারণে এসএসবির সদস্য হিসেবে মুখ্য সচিবের সঙ্গে অবলিক (/) দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিবকেও সদস্য করা হলো। ফলে খন্দকার শহীদুল ইসলামের এসএসবিতে আসা সুগম হলো, আর জনাব হালিম মন্ত্রিপরিষদ সচিব হওয়ার পর তো 'দলবাজি' হালিম খন্দকার সমন্বয়ে আরও চাঙ্গা হলো। আজও জবাব পেলাম না_ আমাকে কেন বারবার সচিব পদে পদোন্নতিবঞ্চিত করা হলো। তত্ত্বাবধায়ক আমলে দলবাজির আপাত সুরাহা হলেও আওয়ামী আমলে তা আরও 'মজবুতরূপে' প্রকাশ্য হলো। পদোন্নতি বঞ্চনার মহাপ্রলয় ঘটল।
কারণটা কী? কারণ একটাই_ মন্ত্রিপরিষদ সচিবের দলবাজির কাছে নতজানু হওয়া অর্থাৎ দলীয় সরকারের অন্যায় হুকুমকে মেনে চলা। একজন মন্ত্রিপরিষদ সচিবের উচিত হওয়া কাম্য পদোন্নতি নীতিমালার আলোকে যোগ্যকে সুপারিশ করা, কোনো 'বায়বীয়' কারণেই আরও তথ্য প্রয়োজন জাতীয় অন্যায় আচরণ থেকে বিরত থাকা। প্রধানমন্ত্রী তার সুপারিশ অনুমোদন না করলে না করুন, তিনি তো বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকলেন। ড. সা'দত, জনাব হালিম যেমন তা করতে পারলেন না, তেমনি পারলেন না বিদায়ী মন্ত্রিপরিষদ সচিব আবদুল আজিজও। তারা সবাই চুক্তি নিয়ে নিজের 'মুক্তি' পেতে আগ্রহী ছিলেন। নতুন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা এসএসবিকে আইএসবির (ওহভবৎরড়ৎ ঝবষবপঃরড়হ ইড়ধৎফ) অমর্যাদাকর অবস্থান থেকে তার ঠিক অবস্থান সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন কি-না দেখার অপেক্ষায় থাকলাম। নাকি তিনিও অর্থমন্ত্রী শামস কিবরিয়ার পিএস থাকার কারণে মগজ-ধোলাইতে শামিল হয়ে তার, আমাদের জানা স্বকীয়তা বিসর্জন দেবেন_ সময়ই তা বলে দেবে। আর তার জ্যেষ্ঠ শেখ ওয়াহিদুজ্জামান যদি নিজেকে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের যোগ্য মনে করে থাকেন, তাহলে তার উচিত হবে সম্মান রক্ষার্থে স্বেচ্ছা-অবসরে যাওয়া। অবশ্য মান-সম্মান যার যার তার তার, যিনি যেভাবে ভাবেন।

বদিউর রহমান : সাবেক চেয়ারম্যান জাতীয় রাজস্ব রোর্ড
 

No comments

Powered by Blogger.