মুর্শিদাবাদ নিছকই একটি শহর by মোহাম্মদ সাদউদ্দিন

কাল সে রাজাধিরাজ, আজ সে পথের ভিক্ষা চায়/কাহারও সমান নাহি যায়।' কবির কথা আজ চরম বাস্তবতায় এসেছে একদা বঙ্গ-বিহার ওড়িষার রাজধানী ইতিহাসখ্যাত মুর্শিদাবাদ শহর। নবাবী মুর্শিদাবাদ আজ নিছকই একটি জেলা অথবা নিছকই একটি শহর। পলাশী যুদ্ধের পর যে নগরীর রূপ দেখে লন্ডন শহরকেও দূরে ফেলেছিলেন ইংরেজ সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভ, সেই শহর যেন আজ সবই মিথ্যায় পর্যবসিত। 'গঙ্গার তীর সি্নগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে যেন'_ মুর্শিদাবাদ ছিল


তেমনই একটি শহর। গঙ্গা-তীরবর্তী জঙ্গলাকীর্ণ মুখসুদাবাদ শহরকে গড়ে নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ নিজের নামানুসারে গড়েছিলেন মুর্শিদাবাদ নগর। কিন্তু দুঃখের হলেও সত্য, নবাবী আমলে গড়ে তোলা সেই মুর্শিদাবাদ নগর ও মুর্শিদাবাদ জেলার ঐতিহাসিক স্থাপত্যগুলো আজ সরকারি অবহেলার শিকার। শুধু নবাবি আমলেই যে মুর্শিদাবাদ ইতিহাসখ্যাত ছিল তা নয়, বরং বলা চলে মুর্শিদাবাদ জেলা প্রাচীন ভারতেও সুপ্রসিদ্ধ ছিল। গৌড়াধিপতি শশাঙ্কের আমলে গৌড়ের রাজধানী ছিল কর্ণসুবর্ণ। এখন কর্ণসুবর্ণ একটি রেলস্টেশন। ভারতের পূর্বরেলের হাওড়া-আজিমগঞ্জ শাখার কর্ণসুবর্ণ স্টেশনটি ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়। কর্ণসুবর্ণ নামে মূল ভূখণ্ড এখন চাঁদপুর-রাঙামাটি-যদুপুর নামে পরিচিত। তিনটি গ্রাম ঢুকলে ভারত সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের একটি বিজ্ঞপ্তি ছাড়া কিছুই পাওয়া যায় না। অথচ কর্ণসুবর্ণ হতে পারত একটি পর্যটন ক্ষেত্র। পাল রাজাদের বাণিজ্য নগরী মহীপাল নিছকই মুর্শিদাবাদ জেলার একটি স্টেশনমাত্র। এমনকি সেন রাজাদের বাণিজ্য নগরী বল্লালপুর মুর্শিদাবাদের ফারাক্কার কাছে অবস্থিত একটি স্টেশনমাত্র। মহীপালকে কেন্দ্র করে বৌদ্ধ পর্যটন গড়া যেত সহজেই। মুর্শিবাদাদের দক্ষিণ সীমান্তে অবস্থিত বর্ধমান জেলা ঘেঁষা সালার। এখানে বসবাস করত নবাবের সিপাহশালার। আর সেই 'সিপাহশালা'র থেকে আজকের 'সালার' নামের উৎপত্তি। আর সালার সংলগ্ন এলাকায় জন্মগ্রহণ করেছেন বিজ্ঞানাচার্য রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী (গ্রামের নাম টেঁয়া), ব্রিটিশ ভারতের কলকাতা করপোরেশনের মেয়র একেএম জাকেরিয়া (শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের আত্মীয়), অন্যতম মেয়র সৈয়দ বদরুদ্দোজা (গ্রামের নাম তালিবপুর), মুর্শিদাবাদ নবাব এস্টেটের ম্যানেজার ইতিহাসবিদ খোন্দকার দেওয়ান ফজলে রাবি্ব, প্রখ্যাত পল্লীগীতি শিল্পী আবদুল আলিম (তালিকপুর, সালার), ডা. ইব্রাহিম (খাঁড়েরা, সালার), সাহিত্যিক সরোজ কুমার রায় চৌধুরী, ভাষা আন্দোলনের অন্যতম শহীদ আবুল বরকত (বাবলা গ্রাম, সালার)। এসব ব্যক্তি ও তাদের জন্মস্থানকে নিয়ে গড়া যেত ঐতিহাসিক পর্যটন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকার বা ভারত সরকার এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ দেখাতে পারেনি।
এ তো গেল মুর্শিদাবাদ জেলার একাংশের বর্ণনা। আর মুর্শিদাবাদ নগরীর এত অবহেলা সত্ত্বেও কেন সেখানে আজও পর্যটকদের আকর্ষণ? বছরে ১৪ লাখ পর্যটক যাওয়া-আসা করেন। ভারত সরকারের প্রচুর আয় হয়। রাজস্ব বাড়ে। এই পর্যটকদের একাংশ বাংলাদেশের। পূর্ব ভারতের পর্যটকদের একাংশ আজও মুর্শিদাবাদ আকর্ষণের বস্তু। ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস গবেষক ও ইতিহাসের ছাত্রছাত্রীদের আজও মুর্শিদাবাদ তাদের কাছে খোরাক।
কী আছে মুর্শিদাবাদ শহরে? গঙ্গা বা ভাগীরথী নদী-তীরবর্তী শহর এটি। গঙ্গা নদী মুর্শিদাবাদ শহরকে দুটি ভাগে ভাগ করেছে। পূর্ব ও পশ্চিম দুটি তীরেই নবাবি পুরাকীর্তিগুলো অবস্থিত। মুর্শিদাবাদ শহরের গঙ্গা-তীরবর্তী জনপদগুলোর নাম খোসবাগ, লালবাগ, রাউটনবাগ, ফারহাবাগ, এলাহিগঞ্জ, ডিহিপাড়া, রোশনিবাগ, খোসবাগে আছে বঙ্গ-বিহার ওড়িষার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার কবর। শুধু তা-ই নয়, নবাব আলীবর্দী খাঁ, তার স্ত্রী সরফুন্নেসা বেগম, সিরাজ পত্নী লুৎফুন্নেসা বেগম, ঘসেটি বেগম, সিরাজের মা আমিনা বেগম, সিরাজ ঘাতক নবাব মহম্মদী বেগসহ ৩৭ জনের কবর আছে খোসবাগে। রোশনিবাগে নবাব সুজাউদ্দিন বর্গনেতা ভাস্কর পণ্ডিসহ কয়েকজন সুফি সাধকের কবর আছে। ডিহিপাড়া ধাম আজও সব সম্প্রদায়ের মানুষকে আকর্ষণ করে। আর গঙ্গা নদীর পূর্বে অবস্থিত কাটরা মসজিদ (নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ প্রতিষ্ঠিত), হাজার দুয়ারি প্রাসাদ, সিরাজের মদিনা, সিরাজের প্রাসাদ, মোতিঝিল প্রাসাদ, জাহানকোষা কামান, বাচ্চাওয়ালি তোপ, ঈমামবাড়া, জাফরাগঞ্জ প্রাসাদ, জাফরাগঞ্জ সমাধিস্থল (নবাব মীর জাফরের বংশ ধরনের সমাধি), ওয়াসেফ মঞ্জিল, ফৌতি মসজিদ, চকমসজিদ, আজিমুনি্নসার সমাধি, দেবী মন্দির, নবাব সরফরাজ খাঁর সমাধি, নৌসেরি বানুর সমাধি, নশীপুর রাজবাড়ি, কদম শরীফ, আস্তাবল, নবাব বাহাদুর স্কুল, ত্রিপোলিয়া গেট, নশীপুর আখড়া, কাঠগোলা বাগান, বড়নগর রানী ভবানীর মন্দির, কিরিটেশ্বরী মন্দির, একলিঙ্গদেবের মন্দির, বঙ্গাধিকার ভিটা, রাধামাধব মন্দির, ঊমি চাঁদের মন্দির, হুমায়ুন মঞ্জিল, মোহন লালের ভিটা, বাগিচাপাড়া মসজিদ, আর্মেনিয়ান, ডাচ সমাধি, পলাশী যুদ্ধক্ষেত্র, মধ্যযুগের বন্দরনগরী কাশিমবাজার। রাজধানী মুর্শিদাবাদ শহরে এতগুলো ঐতিহাসিক কীর্তি ইতিহাস গবেষকদের কাছে আজও আকর্ষণের কেন্দ্রস্থল। অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, আজও নবাব সিরাজের সমাধিস্থল খোসবাগে নেই কোনো নিরাপত্তা বাহিনী। নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আজ বাংলার শেষ নবাব শায়িত। মুর্শিদাবাদের একজন বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ জানান, ভারত স্বাধীনের ৬৫ বছর চলছে। মুর্শিদাবাদকে নিয়ে একটি কোনো সুসংহত পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার কোনো পরিকল্পনা বা উদ্যোগ ভারত সরকারের নেই। এককালে মুর্শিদাবাদ শহরের সঙ্গে ভারতের রাজধানী দিলি্লর রেল যোগাযোগ ছিল। এখন সরাসরি কোনো রেল যোগাযোগ নেই। ভারতের পূর্ব রেলের হাওড়া-আজিমগঞ্জ (কাটোয়া হয়ে) এবং শিয়ালদা-লালগোলা শাখাকে কোনোভাবেই দিলি্লর সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে না। তাই পূর্ব ভারতের বিহার ও উড়িষার পর্যটক আসতে পারছেন না। বাংলাদেশের পর্যটকদের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু দুই বাংলার মানুষ চাইছেন_ মুর্শিদাবাদ-রাজশাহী সীমান্তে পদ্মা নদীর ওপর গড়ে ওঠুক একটি ব্রিজ। তাহলে বাংলাদেশি পর্যটকরা আরও বেশি করে আসবেন। আসলে মুর্শিদাবাদকে নিয়ে ভারত সরকার আয় বাড়াচ্ছে, কিন্তু তাকে নিয়ে পরিকল্পনা নেই। এককালের ধন-মান-যশে পরিপূর্ণ মুর্শিদাবাদ নিছকই একটি জেলা কিংবা একটি শহর।
 

No comments

Powered by Blogger.