যুদ্ধাপরাধের বিচার-প্রক্রিয়ায় এক ধাপ অগ্রগতি-গোলাম আযমের বিচার

৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সাবেক আমির গোলাম আযমকে বুধবার দুপুরে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। পরের দিন বৃহস্পতিবার জাতীয় সংবাদমাধ্যমে এই সংবাদ বেশ গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হয়। বিষয়টি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।


একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত ‘যুদ্ধাপরাধ’ হিসেবে পরিচিত মানবতাবিরোধী অপরাধগুলোর জন্য যাঁদের সাধারণভাবে দায়ী করা হয়, গোলাম আযম তাঁদের নেতৃত্বস্থানীয় হিসেবে পরিচিত। তাঁর দল জামায়াতে ইসলামী আদর্শিকভাবে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছিল, ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ দলটির জন্য অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তা করতে গিয়ে তিনিসহ তাঁর দলের নেতা-কর্মীরা নিরীহ, নিরস্ত্র সাধারণ নারী-পুরুষ ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ যেসব অপরাধ সংঘটিত করেছেন এবং অপরাধ সংঘটনে সহায়তা দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে, সেগুলো মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে আইন দ্বারা সংজ্ঞায়িত। আইনের শাসনভিত্তিক যেকোনো রাষ্ট্রে এসব অপরাধের বিচার অবশ্যকর্তব্য।
যুদ্ধাপরাধের বিচার দীর্ঘ ৪০ বছরেও সম্পন্ন হয়নি, কিন্তু এই বিচার বহু আকাঙ্ক্ষিত এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে জনমত বেড়েছে। সুতরাং সমাজে ও রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকামী প্রত্যেক নাগরিকের জন্য এটি একটি স্বস্তির বিষয় যে, দীর্ঘ বিলম্বের পরে হলেও মানবতাবিরোধী অপরাধগুলোর বিচার সংঘটিত হচ্ছে। এই ধারায় বুধবার গোলাম আযমের গ্রেপ্তার এবং আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি তাঁর মামলায় অভিযোগের বিষয়ে শুনানির দিন ধার্য করার খবর বিশেষ তাৎপর্যবহ। একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের সিংহভাগ বর্তায় তাঁর ওপর। কেননা, তিনি ওই সময় ছিলেন স্বাধীনতার বিরুদ্ধে এবং পাকিস্তানি হানাদার সামরিক জান্তার পক্ষে অবস্থান গ্রহণকারী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর প্রধান নেতা।
গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগে। ট্রাইব্যুনালে সেসব অভিযোগ পেশ করার পর ট্রাইব্যুনাল তা আমলে নিয়ে শুনানির দিন ধার্য করেছেন। অর্থাৎ বিচার-প্রক্রিয়া অগ্রসরমাণ। জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামীসহ আরও পাঁচজন শীর্ষস্থানীয় নেতার বিরুদ্ধেও ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের ও অভিযোগ পেশ করা হয়েছে। তাঁরাও আটক রয়েছেন এবং তাঁদের মামলাগুলোর বিচার-প্রক্রিয়াও এগিয়ে চলেছে।
বিএনপির সাবেক নেতা আবদুল আলীমকে আটক করার পর বার্ধক্য ও অসুস্থতার কারণে শর্ত সাপেক্ষে জামিন দেওয়া হয়েছে। গোলাম আযমের আইনজীবীরাও তাঁর জামিনের আবেদনকালে আবদুল আলীমের উদাহরণ টেনেছেন। কিন্তু গোলাম আযমের মামলা ও তাঁর শারীরিক অবস্থা আবদুল আলীমের থেকে ভিন্ন রকমের বলে অপর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে। গোলাম আযমকে কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন সেলে নেওয়া হয়েছে। আমরা মনে করি, কারাবিধি ও মানবাধিকারসংক্রান্ত বিধিবিধানগুলো অনুযায়ী বন্দীদের সঙ্গে যে ধরনের আচরণ করা উচিত, গোলাম আযমের ক্ষেত্রেও তা-ই করা হচ্ছে এবং হবে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার-প্রক্রিয়ার পরিপূর্ণ গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করার স্বার্থেই এটা জরুরি।
গোলাম আযমের গ্রেপ্তার ও তাঁর মামলার শুনানির দিন নির্ধারণ যুদ্ধাপরাধের বিচার-প্রক্রিয়ায় এক ধাপ অগ্রগতি; এর ফলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সামগ্রিক উদ্যোগটি আরও বেগবান হবে।

No comments

Powered by Blogger.