চরাচর-ভোরের মুগ্ধতা আর সরল পৃথিবীর স্বপ্ন by শামস শামীম

ধুপূর্ণিমার রেশ তখনো মিইয়ে যায়নি। এমন সময়েই জলের কান্তার 'দেখার হাওর' রাতের নৌকায় জোছনা দেখার তাৎক্ষণিক উদ্যোগ নেয় জোছনাভুক একদল বাউল কবি ও সংস্কৃতিকর্মী। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি আর পেজাতুলো মেঘ মাথায় নিয়েই ১৫ সেপ্টেম্বর রওনা হই। তরুণ কবিদের কবিতা ও বাউলদের গান সুরের মূর্ছনায় ঢেউ ওঠে হাওরের বুকে। রাতের নীরবতা ছেঁড়া মাতম তোলা এই সুর ঢেউ দেখার হাওরে অন্য রকম আবহ তৈরি করে।


কখন যে আশ্বিনের উড়ন্ত মেঘ উধাও হয়ে মেঘভাঙা জোছনা উঁকি দিল টের পাইনি। হাওরের জল জাঙ্গালের চোরাবালিতে থেমে থেমে মেঘের ঘোর কাটিয়ে সবাই মজেছেন বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের অন্যতম প্রধান শিষ্য বাউল বশিরউদ্দিন সরকারের গানে। হাওরে জোছনা দেখায় আমাদের সঙ্গী রুক্ষ বরেন্দ্র ও সাগর অঞ্চলের বুন্ধজনসহ এই অঞ্চলের বাউল কবি, সাংবাদিক, শিক্ষক এবং সংস্কৃতিকর্মী। সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক ঘেঁষে দেখার হাওর অবস্থিত। চারটি উপজেলা নিয়ে গঠিত এ ধানভাণ্ডার হাওরে প্রায় ৯ হাজার হেক্টর বোরোধানি জমি। মৎস্য, হিজল কড়চ নল-খাগড়াসহ জলাভূমিতে অসংখ্য জলজ উদ্ভিদ রয়েছে। দিগন্তব্যাপী সুন্দর ছড়ানো হাওরটিকেই বেছে নেওয়া হয় জোছনা দেখার জন্য। হাওরবাসী যখন ঘুমে, তখন রাতের নির্জনতায় নিজেদের খুঁজতে এসে হাওরভাটির নিরাভরণ সুন্দর ভালোবাসা আর শুদ্ধতা খুঁজে পাই আমরা। সরল মরমি জীবনের হাতছানি ছিল আমাদের সামনে। সন্ধ্যা সাড়ে ৮টায় ডুংরিয়া বাজারের সাংহাই হাওর থেকে আমরা রওনা হই। মাঝে পথ ভুল করায় হাওরের জাঙ্গালে কোচা হাতের শৌখিন মাছ শিকারি মাসুক মিয়া হন আমাদের গাইড। তাঁর দেখানো পথেই আমরা এগোতে থাকি। রাত পৌনে ১১টায় সদরপুরের ব্রিজ পেরিয়ে নাইন্দা খাল বেয়ে আমরা পেঁৗছাই দেখার হাওরে। কালিদাসের নয়; হাওরের মেঘগুলো আমাদের সঙ্গী। মেঘের ফাঁক ফুঁড়ে রুপালি জলে বাউরি বাতাসে ঢেউ তুলছিল জোছনার ঝিলিক। মেঘরাঙা জোছনায় আলোকিত আমাদের অবয়ব। বিনয়ী জোছনার অন্য রকম আনন্দে কবি-বাউলরা মাতোয়ারা। কামনা, যেন না ফুরায় রাত। ইঞ্জিন বন্ধ করে বাতাসের অনুকূলে নৌকা এগোচ্ছিল। বাউল বশিরউদ্দিন সরকার তাঁর ওস্তাদ শাহ আবদুল করিমের 'আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম' গানে গলা খোলেন; তাঁর লগে কণ্ঠ ছাড়ি আমরা। একে একে বাউল কামাল উদ্দিন, কফিল উদ্দিন সরকার, কারি আমির উদ্দিন, মশ্রু পাগল এবং নিজের রচিত গান পরিবেশন করেন তিনি। তাঁর কণ্ঠে 'রাখো কিবা মারো', 'সোনা বন্দু ভুইলো না আমারে' মশ্রু পাগলের গান 'ভাটির পানিরে খলখলাইয়া তুমি ভাটির দেশে যাও...' পরিবেশনের সময় আমাদের সবার চোখই ছলছল করছিল। গান পরিবেশন করেন নজরুল ইসলাম রানা, শ্রী বেণু। কবি আহমদ জুনায়েদ পরিবেশন করেন 'বন্দুরে খইয়োগো তোরা'। একটানা বাউল সুরের ঝঙ্কার হাওরের জোছনামাখা জলঢেউয়ে যতই আছড়ে পড়ছিল ততই আমরা মুগ্ধ হয়ে নিজের শিকড়কে খুঁজে ফিরছিলাম। সাংস্কৃতিক ও আর্থ-সামাজিক ধূর্ততা থেকে বেরিয়ে আমরা বাউলদের সরল পৃথিবী ও জীবনের পথ খুঁজছিলাম। গান শেষ হলে রাত পৌনে ৩টায় নৌকায়ই শুরু হয় আলোচনা। টানা দেড় ঘণ্টার আলোচনার নাম দেওয়া হয় 'তারা সম্মিলন'। আলোচনায় শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, রাজনীতির পাশাপাশি বাউলদের বঞ্চনার কথা উঠে আসে। জোছনা উৎসবে অংশ নিতে না পেরে অভিনন্দন জানিয়ে মুঠোফোনে বার্তা পাঠান শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কবি ডক্টর জফির সেতু ও কবি ডক্টর মোস্তাক আহমাদ দীন। হাওরের জলজোছনার স্নিগ্ধতা, ভোরের মুগ্ধতা এবং সরল পৃথিবীর স্বপ্ন নিয়ে আমরা ঘরে ফিরি।
শামস শামীম

No comments

Powered by Blogger.