ভয়াবহ দূষণের কবলে রাজধানীঃ কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি

রাজধানী ঢাকা এবং এর পার্শ্বস্থ এলাকা এখন বহুমাত্রিক দূষণের শিকার। পানিদূষণ, নদীদূষণ, মাটিদূষণসহ বায়ু ও শব্দদূষণের কবলে পড়ে সার্বিক পরিবেশে নেমে এসেছে অসহনীয় বিপর্যয়। ফলে ক্রমাগত নগরবাসী ও নিকটস্থ জনপদের অধিবাসীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি মারাত্মক আকার নিয়েছে। অথচ এ ক্রমবর্ধমান দূষণরোধ করতে এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে শহর ও শহরতলিতে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে কমবেশি দূষণ ঘটেনি। সম্প্রতি পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ঢাকা শহরের ভেতরে সবচেয়ে দূষিত এলাকা হচ্ছে হাজারীবাগ ট্যানারি অঞ্চল। বার বার বলা সত্ত্বেও সরকার এখান থেকে শহরের বাইরে ট্যানারি শিল্প সরিয়ে নিতে সক্ষম হয়নি। ফলে ট্যানারি বর্জ্য থেকে দূষণের মাত্রা এত বেশি বিপজ্জনক হয়ে পড়েছে যে, স্থায়ীভাবে উত্পাদিত সব ধরনের শস্য এবং পালিত পশুপাখিও দূষণাক্রান্ত হয়ে পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা এগুলো না খাওয়ার পরামর্শ পর্যন্ত দিয়েছেন। অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে, হাজারীবাগ এলাকার মতো বিষাক্ত ধাতব পদার্থ খাদ্যচক্রের মাধ্যমে মানুষ ও পশুর দেহে প্রবেশ করলে জটিল রোগব্যাধিসহ ক্যান্সারও হতে পারে। এসব বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় অবহিত থাকলেও দূষণরোধে কোনো ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। দীর্ঘদিন ধরে হাজারীবাগের ট্যানারি বর্জ্যের দূষণ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা শঙ্কা প্রকাশ করলেও তাদের টনক নড়ছে না। বর্তমানে এখানে চালু রয়েছে কয়েকশ’ ট্যানারি কারখানা। অথচ একটিতেও কোনো বর্জ্য শোধনাগার নেই। ফলে অশোধিত বর্জ্য মাটিতে শোধিত হয়ে সরাসরি পড়ছে বুড়িগঙ্গা নদীতে। নদী তা বহন করে নিচ্ছে ভাটির দিকে। গবেষণায় দেখা গেছে, এই ক্ষারীয় তরল ও কঠিন বর্জ্য এক কথায় বিষ। প্রতিনিয়ত এই বিষ গলাধঃকরণ করে বুড়িগঙ্গা এখন নদী নামের ভাগাড়ে পরিণত।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কোনো দূষণই এলাকাবিশেষে সীমাবদ্ধ থাকে না। নানা প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে তা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। বুড়িগঙ্গা তার জ্বলন্ত সাক্ষী। বর্তমানে এই নদীর পানি শুধু পানের যোগ্যতাই হারায়নি, রীতিমত দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এতে স্বভাবতই নদীতীরের স্থায়ী বাসিন্দারা লাগাতার অস্বস্তিকর পরিবেশ সহ্য করতে বাধ্য হচ্ছেন। এরই মধ্যে নদী থেকে উজাড় হয়েছে মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ। এমনকি এর পানি গায়ে লাগলেও দেখা দিচ্ছে ত্বকের বিভিন্ন অসুখ। নদীর এই দুর্দশার অন্যতম প্রধান কারণ হাজারীবাগের ট্যানারির বর্জ্য।
উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে এর আগে সরকার কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। বিভিন্ন প্রকল্প-পরিকল্পনার কথাও শোনা গেছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ট্যানারি বর্জ্য শোধনের জন্য দায়সারাগোছের যেসব ফরমান জারি হয়েছে তাতে কর্ণপাত করেনি ট্যানারির মালিক বা উদ্যোক্তারা। সাধারণ দায়িত্ববোধের পরিচয় দিতেও কার্পণ্য দেখিয়েছেন তারা। অর্থাত্ সামাজিক ও পরিবেশ রক্ষায় যে সাধারণ নাগরিক দায় থাকে তাও সজ্ঞানে এড়িয়ে চলছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত শিল্প-কারখানার ক্ষেত্রেও প্রায় একই কথা প্রযোজ্য। কোথাও নিয়মমাফিক বর্জ্য শোধন হচ্ছে না। দৃশ্যত নদীকেই তার প্রাথমিক পরিণাম বহন করতে হচ্ছে। ঢাকার চারপাশের নদী বুড়িগঙ্গার মতোই বিষের আধারে পরিণত হচ্ছে। তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, বালু এখন শিল্পবর্জ্যে মারাত্মক দূষণাক্রান্ত একেকটি জলাধার।
উল্লেখ্য, শিল্পবর্জ্যসহ অন্যান্য কারণে ভূগর্ভস্থ পানি একবার দূষিত হয়ে গেলে তা পরিশোধন প্রায় অসম্ভব। উন্নত দেশও সহজে এর প্রতিকার করতে পারে না। কাজেই আমাদের দরকার রোগ সৃষ্টি করে চিকিত্সা নয়, বরং রোগ হওয়ার আগে বা নিরাময়ের অযোগ্য হয়ে ওঠার আগে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এরই মধ্যে দেশের সব শিল্প-কারখানায় বর্জ্য শোধনাগার ও অন্যান্য দূষণ নিয়ন্ত্রক যন্ত্রপাতি স্থাপন করতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ নির্দেশ কেন বাস্তবায়ন হচ্ছে না তা সাধারণের বোধগম্য নয়। রাজধানীর বুকেই যদি অব্যবস্থাপনা এত প্রকট হয়ে পড়ে তাহলে নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, খুলনা, গাজীপুরসহ অন্যান্য শিল্পাঞ্চলের দশা কী হবে তা সহজেই অনুমেয়। বর্তমানে ট্যানারি দূষণের সঙ্গে যোগ হয়েছে টেক্সটাইল, রাসায়নিক কারখানা, সার, কীটনাশক, ওষুধ, খাদ্য ও ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানার বর্জ্যদূষণ। এ অবস্থায় আপাতত ঢাকা শহর থেকে হাজারীবাগ ট্যানারি কারখানা যত দ্রুত সম্ভব সরিয়ে নেয়া অপরিহার্য। এছাড়া জরুরিভিত্তিতে শোধনাগার স্থাপন করতে হবে সব বিষাক্ত বর্জ্য উত্পাদন শিল্প-কারখানায়। এ ব্যাপারে সরকারের পাশাপাশি শিল্প উদ্যোক্তা, মালিক এবং জনগণের দায়িত্বও অনেক। আমাদের প্রত্যাশা, সরকার দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেবে।

No comments

Powered by Blogger.