‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’... by মাহবুব তালুকদার

গুরুদেব যোগাসনে বসিয়াছিলেন। শিষ্যের ধারণা হইল সম্ভবত তিনি মন্ত্রপাঠ করিতেছেন। সে প্রভুর পদপ্রান্তে উপবিষ্ট হইয়া গুরুদেবের কণ্ঠবাণী শ্রবণ করিল। তিনি মৃদুস্বরে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাহিতেছিলেন : ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে, এ জীবন পুণ্য করো দহন-দানে...’
শিষ্য মনে ভাবিল, কেন এই সঙ্গীত? ইহার মাজেজাই বা কি?
গুরুদেব সঙ্গীত সমাপনান্তে শিষ্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া কহিলেন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ যে কত বড় কবি তাহা পরিমাপ করা কঠিন।
শিষ্য জিজ্ঞাসিল, প্রভু! আপনার এই উক্তির সহিত ‘আগুনের পরশমণি’ গানটির কোন সম্পর্ক আছে কি?
অবশ্যই আছে। সন্ত্রাসীগণকে উক্ত গানটি পাঠ করিতে দিলে এখন আর কোন সন্ত্রাসীকে ক্রসফায়ারে বেঘোরে প্রাণ দিতে হইত না। সকলেই হাসিমুখে প্রাণ দান করিত।
বলেন কি প্রভু? শিষ্য সবিস্ময়ে বলিয়া উঠিল।
আমি ঠিকই বলিতেছি। গুরুদেব বলিলেন, পরম মানবতাবাদী কবিগুরু সন্ত্রাসীদের কথা মনে করিয়া ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে, এ জীবন পুণ্য করো...’ গানটি লিখিয়াছেন। তবে এই সঙ্গীতের ভিন্ন কোন অর্থ করা হইলে আমার কিছু বলার নাই। রবীন্দ্রকাব্যে একই কবিতার দশরকম বিশ্লেষণ হইতে পারে।
স্যার! আমি গানটির মাহাত্ম্য বুঝিতে পারিতেছি না।
গুরুদেব কহিলেন, আমার মতে ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’ অর্থ হইল আমাকে ফায়ার করিয়া আমার প্রাণে আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও। তোমার দহন-দানে আমার জীবন পুণ্য হইবে।’
প্রভু! আমরা সন্ত্রাসীদিগকে ফায়ার করার কথা শুনি নাই। ক্রসফায়ার কথা শুনিয়াছি।
বত্স! মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলিয়াছেন, এই সরকারের আমলে কোন ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটে নাই। তাহার কথা অবিশ্বাস করার কোন কারণ নাই। এখন উহার নাম হইয়াছে এনকাউন্টার। পূর্ববর্তী সরকারের আমলে ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটিতে পারে।
কিন্তু ক্রসফায়ারের ঘটনার গল্প তো সেই একই। সন্ত্রাসী র্যাবের হাতে ধরা পড়ার পর র্যাব সদস্যরা তাহাকে লইয়া গোপন অস্ত্রভাণ্ডারের খোঁজে বাহির হয়। ঐ সময় সন্ত্রাসীর সাঙ্গপাঙ্গরা র্যাব সদস্যদের প্রতি গুলিবর্ষণ করে। র্যাবও আত্মরক্ষার্থে গুলিবর্ষণ করিতে বাধ্য হয়। অতঃপর উভয়পক্ষের ক্রসফায়ারে পড়িয়া সন্ত্রাসী মারা যায়। শিষ্য জানাইল।
কিন্তু সন্ত্রাসীরা কবিগুরুর গানটি জানিলে এইরূপ করুণ মৃত্যুবরণ করিত না। তাহারা ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’ বলিয়া আগ্নেয়াস্ত্রের গুলির সম্মুখে দাঁড়াইয়া হাসিতে হাসিতে প্রাণ দিত।
হুজুর! আপনার এই কথা শুনিয়া আমার কেমন ভয় করিতেছে।
ভয়ের কিছু নাই। মানুষ মরণশীল। প্রত্যেক মানুষকেই এক সময়ে মৃত্যুবরণ করিতে হইবে। কোন সন্ত্র্ত্রাসী যদি ‘মরণরে তুহু মম শ্যাম সমান’ বলিয়া হাসিমুখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে তাহা হইলে তোমার আপত্তি কিসের?
আমার কিছুতেই কোন আপত্তি নাই। আমি কেবল বলিতে চাহিতেছিলাম, ক্রসফায়ারের ঘটনায় একই গল্প বারবার ব্যবহার করায় উহা বিশ্বাসযোগ্যতা হারাইতেছে।
তুমি ঠিকই বলিয়াছ। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সীমাবদ্ধতাও তোমাকে মনে রাখিতে হইবে। ওই মন্ত্রণালয়ে কোন ভালো স্টরি রাইটার নাই। মানে ঐ মন্ত্রণালয়ের অধীনে কয়েকটি স্টরি রাইটারের পদ সৃষ্টি করা উচিত ছিল।
ক্রসফায়ারের গল্প নতুন করিয়া লেখার জন্য একজন গল্প রচনাকারী হইলেই চলে। একাধিকের প্রয়োজন আছে কি?
অবশ্যই আছে। গুরুদেব ল্যাপটপের বোতাম টিপিয়া তথ্য-উপাত্ত বাহির করিলেন। বলিলেন, মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী এ বছর ১ জানুয়ারি হইতে ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত ১০৯ জনকে ক্রসফায়ারে দেওয়া হইয়াছে অর্থাত্ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আত্মরক্ষার জন্য তাহাদিগকে মারিতে বাধ্য হইয়াছে। হিসাব অনুযায়ী প্রতি মাসে এই ঘটনা ঘটিয়াছে ১০টি। একজন স্টরি রাইটারের পক্ষে মাসে দশটি ভিন্ন ভিন্ন ধরনের স্টরি সাজানো কি সম্ভব?
তাহা ঠিক। শিষ্য মাথা নোয়াইয়া কহিল, এইসব ক্ষেত্রে কাল্পনিক গল্পের বদলে বিশ্বাসযোগ্য গল্প লেখা খুবই কঠিন।
গুরুদেব কহিলেন, তবে ‘অপারেশন ক্লিনহার্টে’র সময় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে সরকারের পক্ষ হইতে যে গল্পটি চালু করা হইয়াছিল, উহা খুবই বিশ্বাসযোগ্য ছিল।
কি সেই গল্প মহাত্মন?
ঐ সরকারের সময় প্রেসনোট দিয়া বলা হইত সন্ত্রাসী বা অপরাধী হার্টফেল করিয়া মারা গিয়াছে।
তত্কালেও শত শত অভিযুক্তকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করিয়া একই গল্প বলা হইত।
তাহাতে কি? গল্পটি তো মিথ্যা ছিল না।
আপনিও কি এই কথা সমর্থন করেন?
নিশ্চয়ই করি। গুরুদেব উদ্দীপ্ত কণ্ঠে কহিলেন, সন্ত্রাসীরা যেভাবেই মৃত্যুবরণ করুক না কেন হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ না হইলে কেহই মারা যায় না। অর্থাত্ হার্টফেল না করিয়া কাহারও পক্ষে মৃত্যুবরণ করা সম্ভব নয়। এই জন্যই বলিতেছি, অপারেশন ক্লিনহার্টের সময় সন্ত্রাসীদের হার্টফেলে মৃত্যুর দাবি খুবই সত্য ও ন্যায়সঙ্গত।
তাহা হইলে সেই গল্পটিকে পরিবর্তনের কি দরকার ছিল?
বত্স! ইহা রাজনীতির খেলা। তোমার পক্ষে ইহার কার্যকারণ অনুধাবন করা সম্ভব হইবে না। তবে ইহার একটি সরল উত্তর আছে।
কী প্রভু?
জোট সরকারের আমলের গল্প মহাজোট সরকারের আমলে চলিতে পারে না। এমতাবস্থায় কেবল দিনবদল করিলে চলিবে না, ক্রসফায়ারের গল্পও বদল করিতে হইবে। এই জন্যই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন নতুন গল্প না তৈয়ারি না হওয়ায় ক্রসফায়ারের ঘটনা অস্বীকার করিয়াছেন। এমতাবস্থায় এই সরকারের আমলে অনুরূপ ঘটনাকে কখনো এনকাউন্টার আবার কখনো সন্ত্রাসীদের সহিত বন্দুকযুদ্ধ বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। তবে এই সকল ঘটনায় একটি কারণে র্যাবকে অবশ্যই বাহাবা দিতে হয়।
কি সেই কারণ? শিষ্য বিনম্রভাবে জিজ্ঞাসিল।
গুরুদেব ল্যাপটপের বোতাম টিপিয়া পুনরায় তথ্য-উপাত্ত বাহির করিয়া বলিলেন, ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ র্যাব গঠনের পর হইতে এই বত্সর ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ৪৭২টি ঘটনায় ৫৭৭ জন নিহত হইলেও আল্লাহর রহমতে কোন র্যাব সদস্য শোকাবহ দুর্ঘটনার শিকার হয় নাই। ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার বা বন্দুকযুদ্ধ যাহাই হউক না কেন, র্যাব সদস্যগণ সর্বদাই নিরাপদ রহিয়াছে।
ইহার কারণ কি প্রভু?
কারণ র্যাব সদস্যগণ দেশে-বিদেশে উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, কিন্তু সন্ত্রাসীরা তেমন কোন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নহে।
হুজুর! গোস্তাকি মাফ করিলে একটি কথা বলিতে ইচ্ছা করি।
নির্বিবাদে বলিতে পারো।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে সকলেই প্রতিবাদমুখর। এমনকি কথাবার্তা শুনিয়া মনে হয় সরকারের নীতিনির্ধারক মহলও ইহার বিরুদ্ধে। ইহার পরও এইরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে কি করিয়া?
বাছা! ইহা অত্যন্ত কঠিন প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর সম্ভবত কাহারও জানা নাই। তবে সম্প্রতি হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ মাদারীপুর উপজেলার লুত্ফর খালাশী ও তাহার সহোদর খায়রুল খালাশীকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করার দায়ে সরকারের প্রতি সুয়োমোটো রুল জারি করায় এইরূপ ঘটনা দেশবাসীর সম্মুখে ভিন্ন মাত্রায় উপস্থাপিত হইয়াছে।
উল্লিখিত দুই ভাইয়ের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি শিষ্য পত্রিকা মারফত পূর্বেই অবগত হইয়াছে। উহা হইতে জানা যায়, লুত্ফর খালাশী ও তাহার ভাই খায়রুল খালাশীকে ক্রসফায়ারের তিন দিন পূর্বে নারায়ণগঞ্জ হইতে আটক করা হয়। আটকের পর লুত্ফর খালাশীর ছেলে বাবুল খালাশী এক সংবাদ সম্মেলনে তাহার পিতা ও চাচাকে ক্রসফায়ারে দেওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করেন। এই সংবাদ সম্মেলনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই উভয়কে হত্যা করা হয়। মাননীয় আদালত এই ঘটনায় স্বপ্রণোদিতভাবে রুল জারি করিয়া এই বিচারবহির্ভূত হত্যার দায়ে স্বরাষ্ট্র সচিব, র্যাবের মহাপরিচালক ও অপর দুই র্যাব সদস্যের বিরুদ্ধে কেন আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হইবে না, এই মর্মে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কারণ দর্শাইতে নির্দেশ প্রদান করিয়াছেন।
গুরুদেব এক সময়ে প্রশ্ন করিলেন, কি ভাবিতেছ?
আমি দুই সহোদর ভাইয়ের মর্মান্তিক মৃত্যুর কথা ভাবিতেছিলাম। পত্রিকায় আদালতের সুয়োমোটো রুলের খবর বেশ গুরুত্বের সহিত ছাপা হইয়াছে।
এইবার হয়তো আদালতে ক্রসফায়ারের বিষয়টি লইয়া সরকারের সুস্পষ্ট অবস্থান কি জনা যাইবে। ক্রসফায়ার সমস্যার সমাধানও হইবে বলিয়া আশা করা যায়।
প্রভু! আমার সীমাহীন অজ্ঞতা মার্জনা করিলে একটি কথা বলিতে পারি।
তুমি নিঃসংকোচে বলো। তোমার বিনয়ে আমি সততই মুগ্ধ।
‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’ গানটি কি সত্যি সত্যি কবিগুরু সন্ত্রাসীদের জবানীতে লিখিয়াছেন?
বত্স! রবীন্দ্র কাব্য সম্পর্কে তোমার জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত। তাই এই প্রশ্নের সরাসরি জবাব প্রদান সঙ্গত হইবে না। তোমাকে উদাহরণ সহকারে বুঝাইতে হইবে।
যথা আজ্ঞা প্রভু!
তুমি কি ‘সোনার তরী’ কবিতাটি পাঠ করিয়াছ?
জ্বি হ্যাঁ। উহা আমার মুখস্থ আছে।
বেশ। ভালো কথা। ওই কবিতায় যিনি উক্তি করিয়াছেন, ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই ছোট সে তরী/আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি’—তিনি কে? তিনি কি কবি স্বয়ং, নাকি কোন কৃষক, যিনি ধান উত্পাদন করেন?
স্যার! বিভিন্ন কাব্য সমালোচক ইহাকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করিয়াছেন।
তুমি যথার্থ বলিয়াছ। রবীন্দ্রকাব্য সম্পর্কে তোমাকে যতখানি অজ্ঞ ভাবিয়াছিলাম, তুমি তাহা নহ।
আপনি জ্ঞানদান করিলে ভবিষ্যতে আমি রবীন্দ্রবিদ্যায় অধিকতর সাফল্য লাভ করিতে পারি।
বত্স! ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’ গানটিরও বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ হইতে পারে। কেহ যদি ইহাতে স্রষ্টার প্রতি আত্মনিবেদন বলিয়া উপলব্ধি করেন তাহা হইলেও আপত্তির কিছু নাই।
কিন্তু কবিগুরু কি ক্রসফায়ারের মৃত্যুমুখী সন্ত্রাসীদের মনোভাব লইয়া এই কবিতা রচনা করিয়াছেন?
কেন করিবেন না? তিনি মানবতাবাদী বলিয়াই যাহারা মৃত্যুমুখে পতিত হইতে যাইতেছে, তাহাদের মধ্যে মৃত্যুর আতংক সঞ্চারিত না করিয়া মৃত্যুকে সহজভাবে ও সুন্দরভাবে বরণ করিবার ভাষা যুগাইয়াছেন। রবীন্দ্রকাব্যের বিভিন্ন স্থানে মৃত্যুর প্রতি কবির মুগ্ধতার পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন—‘অত চুপি চুপি কেন কথা কও ওগো মরণ, হে মোর মরণ/অতি ধীরে এসে কেন চেয়ে রও, ওগো একি প্রণয়েরই ধরন’...
প্রভু! কবিগুরুর মৃত্যু সম্পর্কিত কবিতাগুলি পাঠ করিলে মৃত্যুভয় বলিয়া আর কিছুই থাকে না।
এই জন্যই আমি বলিতে চাহিতেছিলাম, ক্রসফায়ারের দেওয়ার পূর্বে কবিগুরুর এই কবিতাটি সন্ত্রাসীগণকে পাঠ করার সুযোগ দেওয়া উচিত।
অতঃপর গুরুদেব পুনরায় গাহিয়া উঠিলেন: ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে, এ জীবন পুণ্য করো দহন-দানে’...
লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক
ই-মেইল: mahbub_talukdar@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.