'দেশে গাছ কাটার মচ্ছব চলছে'- সরকার কী করছে?

সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের কবল থেকে চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চল রক্ষার জন্য প্রায় দু’দশক আগে ২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ যে সবুজ বেষ্টনি গড়ে তোলা হয়েছিল তা আর নেই। আওয়ামী মহাজোট সরকারের প্রথম বছর শেষ হওয়ার আগেই তার বিনাশ সম্পন্ন হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রায় ৪৫ হাজার একর উপকূলীয় বন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

কেটে নেয়া হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির লাখ লাখ গাছ। কোরবানি ঈদের ছুটির সুযোগে সর্বশেষ সীতাকুণ্ডের ২০ একর জমির প্রায় দু’হাজার গাছ কেটে নেয় সংগঠিত দুর্বৃত্তরা। এর আগে গত ৮ মাসে বিভিন্নভাবে কমপক্ষে ৩০ হাজার সরকারি গাছ নিধন হলেও স্থানীয় প্রশাসনের নির্বিকার ভূমিকা প্রমাণ করেছে দুর্বৃত্তদের ক্ষমতার জোর। গাছ কাটার জন্য শিপ ব্রেকিং ও লবণ ব্যবসায়ীরা থানা-পুলিশ, ইউএনও, এসিল্যান্ড, বন কর্মকর্তা, ইউপি চেয়ারম্যানসহ সব মহলকে টাকা দিয়ে ঠাণ্ডা করে রাখে। ফলে নাম-ধাম উল্লেখ করে মামলা করলেও কোনো ফল হয় না। শেষ পর্যন্ত বিষয়টির স্বীকৃতি পাওয়া গেছে ক্ষমতাসীন মহল থেকে। গতকালের আমার দেশসহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বন ও পরিবেশ সম্পর্কিত জাতীয় সংসদের স্থায়ী কমিটির বরাত দিয়ে বলা হয়েছে—সারা দেশে গাছ কাটার মচ্ছব চলছে।
স্থায়ী কমিটির বৈঠক শেষে সভাপতি সরকার দলীয় এমপি আবদুল মোমিন তালুকদার সাংবাদিকদের জানান, সীতাকুণ্ডে গাছ কাটার খবর আগে থেকেই বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী জেনেছিলেন। স্থানীয় পুলিশকে মন্ত্রী ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিলেও তা পালন করা হয়নি। গাছ কাটার সময় পুলিশ গেলেও তারা চা খেয়ে চলে এসেছে। পরবর্তী সময়ে অবশ্য ওসিকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে এবং বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। এই স্বীকারোক্তি থেকেই বোঝা যায় দেশ কীভাবে চলছে। বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রীর নিজ এলাকাতেও সরকারি গাছ কাটা থেমে নেই। টেকনাফ ও কক্সবাজার সমুদ্র তীরবর্তী ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ ঝাউবন উজাড় হয়ে গেছে। লবণ মাঠ তৈরির জন্য বাঁশখালী উপজেলার ৪০ হাজার গাছ কেটে সাফ করে দেয়া হয়েছে। বন বিভাগ সূত্রে প্রকাশ, গত বছরের ১৯ নভেম্বর থেকে সীতাকুণ্ড উপকূলের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলে গাছ কাটা শুরু হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষদিকে শুরু হলেও নির্বাচিত সরকারের আমলে গাছ কাটা পূর্ণগতি লাভ করে। স্থানীয় শিল্পপতি, সংসদ সদস্যসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ এফএনএফ, ম্যাক, মক্কা, প্রভিটা, সুলতানা প্রভৃতি বিভিন্ন নামে শিপব্রেকিং ইয়ার্ড গড়ে তোলার জন্য অবাধে গাছ কেটে নিয়ে যায়। গত ৩ জুলাই সোনাছড়িতে রাতারাতি কেটে ফেলা হয় ১৫ হাজারের বেশি কেওড়া ও বাইন গাছ। শুধু চট্টগ্রাম অঞ্চলেই নয়, নোয়াখালী, চাঁদপুর, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, সিলেট, টাঙ্গাইল, শেরপুর, ফরিদপুর, মাগুরা, বরগুনা, পটুয়াখালী, বাগেরহাট, পঞ্চগড়—সর্বত্রই নির্বিচারে গাছ কাটার ‘মহোত্সব’ অব্যাহত রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীসহ অনেকেই জলবায়ু পরিবর্তন রোধে দেশে-বিদেশে অতিমাত্রায় সোচ্চার হলেও দেশজুড়ে বনভূমি ধ্বংস ও গাছ কাটার মচ্ছব বন্ধ হচ্ছে না। এ অবস্থায় সংসদীয় স্থায়ী কমিটির স্বীকারোক্তি আর পরিবেশ রক্ষায় দক্ষিণ উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীর কুয়াকাটার সমুদ্র সৈকতে সংসদ সদস্যদের মানবপ্রাচীর কর্মসূচি কতটা ফলদায়ক হবে তা নিয়ে সন্দেহ জাগাটা খুবই স্বাভাবিক। সংসদীয় কমিটির কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্নের শেষ নেই। কেননা চলতি সংসদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিগুলোর এ পর্যন্ত দেয়া কয়েকশ’ সুপারিশ ও নির্দেশনার বেশিরভাগই অকার্যকর রয়ে গেছে। শতকরা ২০ ভাগও বাস্তবায়িত না হওয়ায় কমিটির সভাপতিদের ক্ষোভ প্রকাশের কথা গোপন থাকেনি। এ অবস্থায় বন উজাড় ও অবাধে গাছ কাটার বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান কঠোর করতে জেল-জরিমানার ব্যবস্থা রেখে বিদ্যমান আইন সংশোধনের সুপারিশও যে ফাইল চাপা থাকবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়!

No comments

Powered by Blogger.