তত্ত্বাবধায়ক নামধারীদের সঙ্গে পার্থক্য নেই আ’লীগ সরকারের by শাহ আহমদ রেজা

ওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে কি-না, সে প্রশ্ন আবারও জোরেশোরেই উঠেছে। এমন প্রশ্ন ওঠার কারণ সম্ভবত উল্লেখের প্রয়োজন পড়ে না। একটি বড় কারণ হলো, সর্বোচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারপতিদের বিরুদ্ধে রাজপথে লাঠি মিছিল করা থেকে মাননীয় প্রধান বিচারপতির অফিসের দরজায় লাথি মারা পর্যন্ত নানা অপকর্মের রেকর্ড একমাত্র আওয়ামী লীগেরই রয়েছে।
এবারও ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচারের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সরকারের নেতিবাচক নীতি-মনোভাবের প্রকাশ ঘটে চলেছে। এ সম্পর্কিত উদাহরণের সংখ্যাও আবার কয়েকটি মাত্র নয়। কিছুটা ধারণা দেয়ার জন্য এখানে সর্বশেষ তিনটি খবরের উল্লেখ করা যেতে পারে।
প্রথম খবরটি হলো, সরকার আরও ১৭৫ জন রাজনীতিকের বিরুদ্ধে দায়ের করা রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পবিত্র ঈদুল আজহার প্রাক্কালে নেয়া এই সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও বিরোধী দলের রাজনীতিকরা যথারীতি বাদ পড়েছেন। রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি শুধু ক্ষমতাসীন মহাজোট নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাই প্রত্যাহার করার সুপারিশ করেছে। ২৬ নভেম্বর কমিটির দশম সভায় দুদকের দায়ের করা ১৬টি এবং ১৫৯টি ফৌজদারি মামলা প্রত্যাহার করে নেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে চট্টগ্রামের মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর একারই নয়টি দুর্নীতির মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে জাতীয় কমিটি। জাতীয় পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগে বিতর্কিত এনজিও প্রশিকা’র প্রধান কাজী ফারুক আহমদের বিরুদ্ধে দায়ের করা দুর্নীতির মামলাও প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, এর আগে সরকার দুদকের ১৬৪টি এবং ১১৮৪টি মিলিয়ে মোট ১৩৪৮টি ফৌজদারি মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে। এবারের ১৭৫টির পর সব মিলিয়ে ১৫২৩টি মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হলো। দীর্ঘ এ তালিকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ক্ষমতাসীন জোটের প্রায় সবার নাম থাকলেও বিরোধীদলীয় নেতাদের নাম নেই। এর আগে একবার শুধু বিএনপির দুটি মামলা প্রত্যাহারের খবর জানা গেছে। দুটির মধ্যে একটি ছিল বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমানের। সে মামলাটি মামলার বাদী নিজেই প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। দ্বিতীয় মামলা ছিল ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের বিরুদ্ধে দুদকের দায়ের করা। কিন্তু সরকার সুপারিশ করলেও মওদুদ আহমদ প্রত্যাহারের সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করেছেন। এদিকে সবচেয়ে আজব কথা শুনিয়েছেন আইন প্রতিমন্ত্রী। রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার সংক্রান্ত সভা শেষে ২৬ নভেম্বর প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ চারদলীয় জোট নেতাদের বিরুদ্ধে কোনো হয়রানিমূলক মামলা হয়েছে কি-না তা নাকি তার জানা নেই! ওই সময়ে দুর্নীতি দমন কমিশন চারদলীয় জোটের কোনো নেতার বিরুদ্ধে মামলা করেছে বলেও তিনি জানেন না! তবে দুদক নাকি মামলা করলেও করে থাকতে পারে!
প্রাসঙ্গিক দ্বিতীয় খবরটিও যথেষ্ট তাত্পর্যপূর্ণ। সরকার দুদককে দিয়ে বিএনপির চেয়ারপার্সন ও বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর বিরুদ্ধে ১৩ নভেম্বর নতুন একটি মামলা দায়ের করিয়েছে। অর্থ পাচারের মামলাটি আদালত গ্রহণ করেছে ১৫ নভেম্বর। অভিযুক্ত কোকোকে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ জারি করেছেন বিচারক। ওদিকে তৃতীয় খবরটি এর ঠিক উল্টো ধরনের। কোকোর বিরুদ্ধে যেদিন মামলা দায়ের করা হয়েছে, সেদিনই রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান সংসদের উপনেতা সাজেদা চৌধুরীর ছেলে শাহদাব আকবর চৌধুরীর দণ্ড মওকুফ করেছেন। অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ বিভিন্ন অভিযোগে ২০০৮ সালে দুদকের দায়ের করা কয়েকটি মামলায় শাহদাব চৌধুরীকে সব মিলিয়ে ১৮ বছরের কারাদণ্ড দেয়া এবং ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছিল। তিনি পলাতক ছিলেন এবং পলাতক থাকা অবস্থাতেই রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন পেশ করেছিলেন। অমন একজন দণ্ডিত ও পলাতক ব্যক্তির দণ্ড মওকুফের খবর দেশের সচেতন মানুষ মাত্রকে স্তম্ভিত করেছে। পত্র-পত্রিকায়ও মানুষের প্রতিক্রিয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে তত্পর হয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ১৫ নভেম্বর দেয়া এক ব্যাখ্যায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী এবং সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদে দেয়া ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি আইনসম্মতভাবেই সাজেদা চৌধুরীর ছেলে শাহদাব আকবর চৌধুরীর দণ্ড মওকুফ করেছেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য হতে পারেনি। কথা উঠেছে বরং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে। কারণ, নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে দণ্ডিতজনের ব্যাপারে দণ্ড মওকুফ, হ্রাস বা স্থগিত করার ব্যবস্থা নেবেন—এমন চিন্তা ও ধারণার ভিত্তিতেই সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতা দিয়েছে। তার মানে এই নয় যে, রাষ্ট্রপতি বেছে বেছে কেবল আওয়ামী লীগ নেত্রী সাজেদা চৌধুরীর ছেলের দণ্ডই মওকুফ করে দেবেন। তাছাড়া আইনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়েও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সত্য এড়িয়ে গেছে। কারণ, আইনের বিধান হলো, দণ্ডিত ব্যক্তিকে প্রথমে আদালতের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে। আদালত তাকে কারাগারে পাঠাবে। দণ্ড মওকুফ করার আবেদন তাকে কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পাঠাতে হবে। কিন্তু সাজেদা চৌধুরীর পুত্রের ক্ষেত্রে দেখা গেল, দেশের রাষ্ট্রপতি একজন পলাতক দণ্ডিত অপরাধীর বেআইনি পন্থায় পাঠানো আবেদনের ভিত্তিতে দণ্ড মওকুফ করেছেন। এটা শুধু আওয়ামী লীগ সরকারের রাষ্ট্রপতিকেই দিয়ে সম্ভব। নিজে আইনজীবী হয়েও জিল্লুর রহমান প্রমাণ করেছেন, তিনি এখনও দলীয় ‘আসরের’ ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি। আওয়ামী লীগের লোকজন সাধারণত সেটা পারেনও না!
আইন ও স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সরকারের মনোভাব সম্পর্কে জানার জন্য আইন প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যটুকু স্মরণ করা যেতে পারে—যেখানে তিনি বিরোধী দলের মামলার ব্যাপারে অজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। বস্তুত প্রতিমন্ত্রীর এ বক্তব্যের মধ্য দিয়েও পরিষ্কার হয়েছে, প্রতিটি বিষয়ে সরকার সর্বতোভাবে রাজনৈতিক স্বার্থ ও উদ্দেশ্যকে প্রাধান্যে রেখে চলেছে। যেমন মামলা প্রত্যাহার প্রসঙ্গে সরকার প্রথম থেকে বলে এসেছে, ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক’ বলে এসব মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো— মামলা প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে সরকার সুস্পষ্টভাবে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ দিয়েছে। এজন্যই ১৫২৩টির মধ্যে বিএনপির মাত্র দু’জনের দুটি মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে সরকার। বাকিগুলো আওয়ামী লীগ এবং তার মহাজোটের সঙ্গীদের। সরকার এমনকি খালেদা জিয়া ও মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীসহ বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা কোনো একটি মামলাই প্রত্যাহার করায়নি। এ থেকেই আওয়ামী লীগ সরকারের দলীয় সংকীর্ণতা সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার হয়ে গেছে।
এখানেই অবশ্য শেষ নয়। এরও আগে সরকার এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে যেগুলোকে ন্যক্কারজনক বলাও যথেষ্ট হতে পারে না। এরকম একটি পদক্ষেপ হিসেবে পল্টন হত্যা মামলার কথা উল্লেখ করতে হয়। মামলাটি সরকার ১৭ আগস্ট প্রত্যাহার করিয়ে নিয়েছে। এর ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনুসহ আওয়ামী মহাজোটের ৪৬ জন নেতা অভিযোগ থেকে রেহাই পেয়েছেন। উল্লেখ্য, চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার দিন, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর পল্টনে লগি-বৈঠার সন্ত্রাস চালিয়ে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের ছয়জন কর্মীকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। লগি-বৈঠা নিয়ে রাজপথে নামার নির্দেশটি দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আইনের কোনো ব্যাখ্যাতেই সরকার এভাবে একটি মামলা প্রত্যাহার করাতে পারে না। সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেয়া হলেও বিচারক মামলা খারিজ করতে পারেন না। কারণ, বাদী এখানে প্রধান নির্ধারক। পল্টন হত্যা মামলায় বাদী সরকার ছিল না, ছিলেন জামায়াতের মতিঝিল থানা শাখার আমির। সুতরাং মামলা প্রত্যাহার করতে হলে তিনিই আদালতের কাছে অনুরোধ জানাবেন। অন্যদিকে এমনভাবে মামলাটি প্রত্যাহার করানো হয়েছে যেন সরকার নিজেই মামলার বাদী ছিল! এ ঘটনা থেকে আরও একবার আইন ও আদালতের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সরকারের নীতি-মনোভাব সম্পর্কে স্পষ্টভাবে জানা গেছে। একথাও প্রকাশিত হয়েছে যে, বিচার বিভাগ অন্তত আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে স্বাধীন অবস্থান বজায় রাখতে পারবে না।
এই পেক্ষাপটে সংক্ষেপে বলা যায়, আওয়ামী লীগ সরকার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে চলেছে এবং অবজ্ঞা দেখাচ্ছে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার প্রতি। সরকারের এই দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থানের কারণেই ক্ষমতাসীন জোটের নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলোই শুধু প্রত্যাহার করা হচ্ছে। ওদিকে দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে মন্ত্রীরা দেশের আইন ও সংবিধানই শুধু লঙ্ঘন করছেন না, মন্ত্রিত্বের শপথও ভঙ্গ করছেন। এমনকি রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত নিজেকে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রভাব বলয়ের বাইরে নিয়ে যেতে পারেননি। পরিণতিতে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, ন্যায়বিচার পাওয়া অসম্ভব হয়ে উঠছে। স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার ব্যাপারে সততা থাকলে এবং রাজনৈতিক শত্রুতা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্য না থাকলে সরকারের উচিত রাজনৈতিক স্বার্থচিন্তার ঊর্ধ্বে ওঠা এবং তত্ত্বাবধায়ক নামধারী সরকারের আমলে দায়ের করা সব রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার করে নেয়া। কারণ, একথা প্রমাণিত হয়েছে যে, ওই সরকারের উদ্দেশ্যই ছিল দল ও মত নির্বিশেষে রাজনীতিকদের হেয়প্রতিপন্ন করা। আওয়ামী লীগ সরকারও শুধু ক্ষমতাসীনদের মামলা প্রত্যাহার করায় স্বাভাবিকভাবেই সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। সাধারণ মানুষও বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, তত্ত্বাবধায়ক নামধারীদের সঙ্গে বর্তমান সরকারের কোনো পার্থক্য নেই—অন্তত বিএনপিসহ দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত ও অসম্মানিত করার ব্যাপারে। বলা দরকার, এভাবে চলতে থাকলে জনগণ একই সঙ্গে স্মরণ করবে, আওয়ামী লীগ আসলেও সমঝোতার ভিত্তিতেই ‘বিজয়’ অর্জন করে ক্ষমতায় এসেছে। সমঝোতা ছিল বলেই জেনারেল মইন উ-সহ যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার নাম নিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিলেন তাদের প্রত্যেককেই চমত্কার কৌশলে ছাড় দেয়া হয়েছে। কাউকে জবাবদিহি করতে বা বিচারের সম্মুখীন হতে হয়নি—এমনকি দুর্নীতি উচ্ছেদের নামে দেশে ‘ব্ল্যাকমেইলিং’য়ের রাজত্ব কায়েম করা এবং দুই নেত্রীসহ রাজনীতিকদের ‘জেলের ভাত’ খাওয়ানো সত্ত্বেও।
লেখক : সাংবাদিক
ই-মেইল : shahahmadreza@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.