সদরে অন্দরে-জেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে কিছু কথা by মোস্তফা হোসেইন

হীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন ছিলেন দৈনিক ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক। তাঁর সম্পাদিত অনেক সংবাদই সাংবাদিকদের মুখে মুখে ঘুরে এখনো। তবে কিছু সংবাদ ও শিরোনাম রীতিমতো ইতিহাসের মতো হয়ে আছে। শিরোনাম রচনার প্রসঙ্গ এলেই সাংবাদিকরা সেসব শিরোনাম স্মরণ করে থাকেন। আজও শ্রদ্ধাভরে তাঁর কথা মনে করেন। মনে করেন এই কারণে যে, সংবাদের মধ্যে পাঠকের মনচাহিদাকে ঢুকিয়ে দেওয়ার যে কৌশল, তার সফল প্রয়োগ করতে পেরেছিলেন তিনি।


শুধু তা-ই নয়, রসচ্ছলেও যে অনেক সিরিয়াস বিষয়কে উপস্থাপন করা যায়, তা বোধ করি তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানে তখন গণ-আন্দোলন তুঙ্গে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেলখানায়। গ্রামে গ্রামে সংগঠিত হচ্ছে মানুষ। সবার কথা_হঠাও আইয়ুব খান। এই স্লোগানের আড়ালে-আবডালে ছড়িয়ে পড়ে আইয়ুব খান উদ্ভাবিত এবং ক্ষমতার ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত মৌলিক গণতন্ত্রীদের প্রত্যাখান করার বিষয়টিও। ওই সময় ইত্তেফাকের এক সংবাদদাতা সংবাদ পাঠালেন ঢাকায়। বৃহত্তর কোনো এক গ্রামে ষাঁড়ের গুঁতোয় নিহত হয়েছেন এক ইউনিয়ন বোর্ডের মেম্বার। যাঁদের ওই আমলে বলা হতো বিডি মেম্বার। মানে বেসিক ডেমোক্রেসি মেম্বার। এই মেম্বারের গুঁতো খাওয়াকে তিনি আরেক ধাপ গুঁতো দিয়ে উপস্থাপন করলেন এভাবে_'চিনিল কেমনে'। শিরোনামের আকার ছোট। ভেতরে সংবাদ বলে দিল যে ঘটনাটি সেদিন ঘটেছিল।
গল্পটা সিনিয়র সাংবাদিকদের কাছ থেকেই শোনা। তারপর থেকে যখনই মৌলিক গণতন্ত্রের কথা আসে মনে পড়ে যায় সেই শিরোনামটি। মনে আসে গণতন্ত্র শব্দটি ব্যবহারকারীদের অনেকের কথাও। ব্যাখ্যা কিংবা গবেষণার মতো অনেক কিছুই। সেই মৌলিক গণতন্ত্রের জমানা কি আবার ফিরে আসছে? স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে বাংলাদেশে এর প্রয়োগ আবার শুরু হতে যাচ্ছে। সংবাদ হয়েছে, শিগগিরই জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচন হতে যাচ্ছে দেশে। আর এই নির্বাচনে ভোট দেবেন দেশের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যানরা। তাদের ভোটে উপমন্ত্রীর মর্যাদায় একজন নির্বাচিত হবেন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হিসেবে। নির্বাচনের এই পদ্ধতির কথা শোনার পরই মনে হতে থাকে ঊনসত্তরের সেই ষাঁড়টি আবার ফিরে আসবে না তো? সন্দেহ হতে পারে স্পষ্টত_এবার কিন্তু ষাঁড় একটি হবে না। গুঁতোও ভোঁতা শিং দিয়ে হবে না। কারণ এখন গরুর শিঙের চেয়ে হাজার গুণ শক্তিশালী একেকটি হাতিয়ার তৈরি হয়ে আছে যথারীতি। একটু এদিক-সেদিক হলে বিডি মেম্বারদের সহযোগী-সহগামীরা জনতার ক্ষুব্ধ রোষে পড়বেন মারাত্মক। যেখান থেকে রেহাই পাওয়ার সুযোগ থাকবে কম। সরকার জেলা পরিষদ নির্বাচন ও জেলা পরিষদ নিয়ে যেভাবে ভাবছে, তাতে এমন ভয় থেকেই যায়। সরকার চিন্তা করছে নির্বাচনের আগে তারা সেখানে একজনকে প্রশাসক নিয়োজিত করবে। এই প্রশাসক হবেন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী। হয়তোবা নির্বাচন হলে সরকারের দলীয় আধিপত্য নিশ্চিত হবে বলে ধারণা করছে। প্রশ্ন এখানেও আসে। সরকারের এই অনুমান কি সঠিক হবে? সরকার মনে করছে যেহেতু উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদগুলোর চেয়ারম্যানরা অধিকাংশই আওয়ামী লীগের সমর্থক নেতা-কর্মী, তাই জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচনও তাদেরই পক্ষে যাবে? কিন্তু উপজেলা চেয়ারম্যানদের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে বোধ হয় সরকারের ভাবনা সঠিক নয়। কারণ নিজ দলের সমর্থক উপজেলা চেয়ারম্যানরাও সরকারি দলের পথে থেকেই আলাদা একেকটি গলি তৈরি করে রেখেছে। সেই গলিপথগুলো এতই সংকীর্ণ যে, সেখানে সরকারি দলের যানবাহন প্রবেশের কোনো সুযোগই পাবে না। তাই ৬১ জেলার (পার্বত্য অঞ্চল বাদে) মধ্যে ৪৬টি সরকারি দলের মনোনীত প্রার্থীরা পাবে এমন চিন্তা করা যায় না।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর হযবরল অবস্থা স্পষ্ট হয়ে যায়। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতাদের অবস্থা দেখে প্রস্তাবিত জেলা পরিষদের নির্বাচনগুলো সম্পর্কে সহজেই অনুমান করা যাবে। নারায়ণগঞ্জের দুই আওয়ামী লীগের নেতা শামীম ওসমান ও সেলিনা হায়াত আইভীকে দলীয় নেতৃত্ব ঐকমত্যে আনতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত দুজনই নির্বাচনী লড়াইয়ে নিয়োজিত আছেন। এটা দলকে দ্বিধাবিভক্ত করার জন্য একমাত্র পথ নয়। এমন ভাবা হয়তো ঠিক হবে না। কিন্তু মানতে হবে নারয়ণগঞ্জকে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি বলে যে ধারণা দেওয়া হতো, সেই ধারণা এখন মিথ্যাও হয়ে যেতে পারে। ইতিমধ্যে শামীম ওসমানের পক্ষে আওয়ামী লীগের সমর্থন স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পরও বোঝা যাচ্ছে না সেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিজয়ী হবে কি না। কারণ একটাই, দলীয় আনুগত্যের প্রতি দ্বিধান্বিত হওয়া। যদি আলী আহমদ চুনকার মতো দলীয় সমর্থন ছাড়া আইভী জয়ী হতে পারেন, তাহলে এটা হবে তার জন্য বড় একটি অর্জন। যদি সেখানে শামীম ওসমান জয়ী হতে পারেন, তাহলে দলের জন্য প্রাপ্তি হবে। কিন্তু আইভী আর শামীম ওসমানের এই ভাগাভাগিতে যদি বিএনপির প্রার্থী বিজয়ী হয়ে যান, তাহলে অবস্থাটা কী হবে সরকারি দলের?
নারায়ণগঞ্জের এই প্রসঙ্গ টানার উদ্দেশ্য হচ্ছে_দলীয় সমর্থন দিলেই যে দলীয় সাফল্য না-ও আসতে পারে তার কিছুটা আলোকপাত করা। নারায়ণগঞ্জে দলীয় সমর্থকরা মাত্র দুই ভাগ হয়েছে। কিন্তু জেলা পরিষদে এটা হবে অনেক ভাগ। এমন প্রমাণ গত পৌরসভা নির্বাচনগুলোতে দেখা গেছে। জোড়াতালি দেওয়ার চেষ্টা করেও অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগের কর্মীদের এক ছাতার নিচে আনা সম্ভব হয়নি। তাদের টেন্ডারবাজি করতে গিয়ে হতাহতের ঘটনাগুলো এ কারণেই বেশি ঘটে থাকে।
এই পরিস্থিতিতে জেলা পরিষদের নির্বাচন দিয়ে দলীয় মনোনয়ন প্রথা চালু করা যেতে পারে। পর্যায়ক্রমে এই মনোনয়ন একবারে উপজেলা পরিষদ পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। আসলে মনোনয়ন নিষিদ্ধ করে কোনো লাভ হয় না। কারণ প্রতিটি নির্বাচনেই নারায়ণগঞ্জের মতো ওপেন সিক্রেট হিসেবে দেখা দেয় দলীয় সমর্থন। স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার যে অঙ্গীকার রাজনৈতিক সরকার দিয়ে থাকে, তা বাস্তবায়ন না করতে পারলে দেশের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব হবে না। কিন্তু সেখানে আইনপ্রণেতাদের আধিপত্য ক্ষুণ্ন হয়ে যায় এমন কোনো কাজই তারা করতে চায় না। এই অভিযোগও বহু পুরনো এবং সত্যও বটে। এমন পরিস্থিতিতে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে ভাগাভাগি করে দেওয়ার যে চিন্তাভাবনা বিভিন্ন মহল থেকে করা হয়েছে, সে বিষয়টিও ভেবে দেখা দরকার। দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র বাস্তবায়ন করতে হলে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু দীর্ঘদিনের দাবি ও সরকারের অঙ্গীকার জেলা পরিষদকে উপেক্ষা করে কিংবা সেখানে প্রশাসক নিয়োগ করে এটা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। সরকারের ভিশন ২০২১ সফল করতে হলেও স্থানীয় সরকারের ওপর নির্ভর করতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয় সরকারের প্রধান একটি দিক জেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠান অপরিহার্য।
তবে সরকার যেভাবে মৌলিক গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচন করতে চায় তাকে প্রথম বছরের জন্য গ্রহণ করা যায়। পরবর্তী নির্বাচনগুলো যাতে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনের সঙ্গে একই সময় সম্পন্ন করা যায় সেদিকেও চিন্তা করা যেতে পারে। উপজেলা নির্বাচন আর জেলা পরিষদ নির্বাচন একসঙ্গে করতে পারলে সাধারণ মানুষই উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচন করতে পারবে। এতে করে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের যেমন প্রয়োজন হবে না, তেমনি পরিষদ নির্বাচনে সরাসরি সাধারণ মানুষের ইচ্ছারও প্রতিফলন হবে।
mhussain_71@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.