দাওয়াতে তাবলিগ ও বিশ্ব ইজতেমা by মুফতি এনায়েতুল্লাহ

'আর তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকা উচিত, যারা (মানুষকে) আহ্বান করবে সৎ কাজের প্রতি। নির্দেশ দিবে ভালো কাজের এবং নিষেধ করবে অন্যায় কাজ থেকে। আর তারাই মূলত সফলকাম।'- সূরা আল ইমরান : ১০৪
এ আয়াতের আলোকে বলা যায় যে, ইসলামের যে কোনো বার্তা তা যতই সামান্য হোক না কেন, অন্যের কাছে পেঁৗছে দেওয়া সবার ওপর ফরজ।


এতে আরব-অনারব, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের কোনো ব্যবধান নেই। কিয়ামত পর্যন্ত মানবগোষ্ঠীর জন্য এ দাওয়াত প্রযোজ্য। দিক ভুলে মানবসমাজ যখন ইসলাম সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝি নিয়ে নিজেদের মধ্যে সংঘাত ও দূরত্ব তৈরি করছে, তখন দাওয়াতি কার্যক্রমের প্রয়োজনীয়তা আরও ব্যাপকভাবে উপলব্ধি করা যায়।
দাওয়াতি মেহনত একজন মুমিনের জন্য প্রথম ও প্রধান করণীয় একটি কাজ। ইসলামের সর্বজনীন কল্যাণের বার্তা প্রচার-প্রসারের জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ, আধুনিক ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবন বিধান। একমাত্র এ বিধানই মানবগোষ্ঠীকে শান্তির পথ দেখাতে সক্ষম। এ পথ দেখানোর নিমিত্তে যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসূল (আ.) পাঠিয়ে আল্লাহতায়ালা মানবজাতিকে হেদায়েতের ব্যবস্থা করেছেন। তারা সবাই আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে আদিষ্ট হয়ে আল্লাহতায়ালার দিকে মানবসমাজকে আহ্বান করেছেন। ইসলাম ধর্ম আল্লাহর মনোনীত জীবন ব্যবস্থা। আর এই জীবন ব্যবস্থার যাবতীয় বিধানাবলি মানবজাতির মধ্যে বাস্তবায়ন করার জন্য যে মেহনত এবং চেষ্টা করা হয়ে থাকে তাকে দাওয়াতে তাবলিগ বলে। এটা কল্যাণকর কাজ। এ প্রসঙ্গে কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, 'তোমরাই সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি। মানুষের কল্যাণের জন্য তোমাদের বের করা হয়েছে। তোমাদের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ এই যে, তোমরা সৎ কাজের আদেশ কর ও অসৎ কাজে বাধা প্রদান কর এবং আল্লাহর ওপর ইমান দৃঢ় রাখ।' আলেমগণ বলেন, যদি কেউ দুনিয়া এবং আখেরাতে শ্রেষ্ঠ হতে চায়, তাহলে তার উচিত মানবসমাজকে সৎ কাজের দিকে আহ্বান করা এবং অসৎ কাজে বাধা দেওয়া। কোরআনে আরও ইরশাদ হচ্ছে, 'ওই ব্যক্তির কথার চেয়ে উৎকৃষ্ট কথা আর কার হতে পারে, যে মানুষকে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয় এবং নিজেও নেক আমল করে আর বলে, আমি একজন মুসলমান।'-সূরা হামীম সেজদা : ৫
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বিদায় হজের ভাষণে বলেছিলেন, 'আমি কি তোমাদের মাঝে আল্লাহর দ্বীনকে পেঁৗছাতে পেরেছি? উপস্থিত সাহাবীরা সমস্বরে বলেছিল, 'ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি শুধু দ্বীনকে পেঁৗছাননি, দ্বীনের হকও আদায় করেছেন। তখন হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) আকাশের দিকে হাত তুলে বলেছিলেন, হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকলেন। এরপর সাহাবীরা হজরত রাসূলুল্লাহকে (সা.) জিজ্ঞাসা করেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এখন আমাদের কাজ কী? উত্তরে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছিলেন, আমার যে কাজ তোমাদেরও একই কাজ, আমার পরে আর কোনো নবী আসবে না; কারণ আল্লাহতায়ালা নবুওয়তের দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন।' আল্লাহতায়ালা হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) পর্যন্ত প্রত্যেক নবীকে যেসব গুরুত্বপূর্ণ কাজ অর্পণ করেছিলেন, নবুওয়তের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে শেষ নবীর উম্মত হিসেবে সেসব কাজের ভার ও দায়িত্ব আমাদের ওপর অর্পিত হয়েছে। এর মধ্যে দাওয়াতের কাজ অন্যতম।
কোরআনে কারিমের বিভিন্ন আয়াত ও হাদিস থেকে দাওয়াত, দ্বীন প্রচার ও দ্বীন প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব সহজেই বুঝে আসে। দাওয়াতের কাজ মুমিনের জন্য ইবাদত। এ ইবাদত পালন করলে মুমিন নামাজ, রোজা ও অন্যান্য ইবাদত পালনের মতো সওয়াব ও পুরস্কার লাভ করবেন। সমাজের নানাবিধ অন্যায়-অপরাধের নীরব দর্শক না হয়ে সাধ্যমতো দাওয়াত দিতে হবে ও অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। এটা ইসলামের বিধান। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় উপমহাদেশে দাওয়াতে তাবলিগ বা দ্বীনের মেহনত চালু করেন হজরত ইলিয়াস (রহ.)।
হজরত ইলিয়াস (রহ.) তাবলিগ সম্পর্কে বলেন, 'দাওয়াত ও তাবলিগের উদ্দেশ্য হলো ইমানের দাওয়াত। এ দাওয়াত নিজের সংশোধন তথা সমগ্র মানবজাতির মুক্তির দাওয়াত। ইমানের এই দাওয়াতের উদ্দেশ্য হলো_ আল্লাহর দেওয়া জীবন, সম্পদ এবং সময় আল্লাহর রাস্তায় বের হয়ে এর সঠিক ব্যবহার শিক্ষা করা এবং বাস্তব জীবনে এর সঠিক প্রয়োগ করার পাশাপাশি আল্লাহ-ভোলা মানুষকে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক করে দেওয়ার মেহনত করা।'
এভাবে তাবলিগের কাজ ধীরে ধীরে চলতে থাকে। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের গণ্ডি ছাড়িয়ে পেঁৗছে যায় বিশ্বের সর্বত্র। হজরত মাওলানা আবদুল আজিজের (রহ.) মাধ্যমে ১৯৪৪ সালে বাংলাদেশে তাবলিগের মেহনত শুরু হয় এবং ১৯৪৬ সালে প্রথম ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় কাকরাইল মসজিদে। বিভিন্ন স্থান ঘুরে ১৯৬৬ সাল থেকে টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে প্রতিবছর বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। দাওয়াতে তাবলিগের মেহনতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো_ জেলা ও দেশভিত্তিক তিন দিনের ইজতেমাগুলো। এসব আঞ্চলিক ও কেন্দ্রীয় ইজতেমায় দাওয়াতের প্রয়োজনীয়তা ও পদ্ধতিসহ দাওয়াতি কাজ সম্পর্কে দিকনির্দেশনামূলক আলোচনা হয়।
আজ ফজরের নামাজের পর আম বয়ানের মধ্য দিয়ে শুরু হবে প্রথম পর্বের ইজতেমার আনুষ্ঠানিকতা। অবশ্য গত বুধবার বাদ জোহর থেকেই মাঠে খিত্তাওয়ারি বয়ান ও তালিম চলছে। আজ ইজতেমা মাঠে স্মরণকালের বৃহৎ জুমার জামাত অনুষ্ঠিত হবে। এতে প্রায় ৫ লাখ মুসলিল্গ অংশ নেবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। নামাজে ইমামতি করবেন কাকরাইলের মুরবি্ব মাওলানা মোঃ রবিউল হক। জুমার নামাজান্তে ইজতেমার সাফল্য কামনা করে আল্লাহতায়ালার দরবারে বিশেষ মোনাজাত করা হবে। প্রথম পর্বের ইজতেমার আখেরি মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে ১৫ জানুয়ারি রোববার জোহরের নামাজের আগে। আর দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমা শুরু হবে ২০ জানুয়ারি। ৩২ জেলা করে ইজতেমার উভয় পর্বে ৬৪ জেলার মুসলিল্গরা মাঠের ৩৯টি খিত্তায় অবস্থান করবেন। ইতিমধ্যেই ইজতেমার প্যান্ডেল নির্মাণসহ আনুষঙ্গিক যাবতীয় কাজ শেষ হয়েছে। মুসলিল্গদের পদভারে মুখরিত ইজতেমার ময়দান। মূলত ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তিন চিল্লার সাথীদের নিয়ে বার্ষিক জোড় ইজতেমার পরই শুরু হয় মাঠ প্রস্তুতির কাজ। উলেল্গখ্য, ইজতেমার মাঠে স্থান সংকুলান না হওয়ায় মুসলিল্গদের দুর্ভোগ লাগব করার লক্ষ্যে গত বছর থেকে দুই পর্বে ৬ দিন ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
muftianaet@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.