চুক্তি ছাড়াই চলছে ভারতে বন্দি হস্তান্তরঃ জনগণকে অন্ধকারে রাখা অনুচিত

বাংলাদেশ আর ভারতের মধ্যে বন্দি বিনিময় চুক্তি কয়েক বছর ধরে হচ্ছে-হবে করেও নানান কারণে এখনও হয়নি। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফরকালে এ ধরনের একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে বলে সর্বত্রই জোর আলোচনা চলছে।

সে চুক্তি স্বাক্ষরিত হোক বা না হোক, এখন যে দু’দেশের মধ্যে বন্দি বিনিময় চুক্তি নেই, এটাই বাস্তবতা। তবে চুক্তি না থাকলেও বর্তমান সরকারের আমলে যেভাবে বাংলাদেশ থেকে ভারতের কাছে বন্দি হস্তান্তরের ঘটনা একের পর এক ঘটে চলেছে, তাতে দিল্লির নীতিনির্ধারকদের কাছে বন্দি বিনিময় চুক্তির অস্তিত্ব গৌণ বিষয়ে পরিণত হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। মিডিয়ার খবর অনুযায়ী, গত কয়েক মাসে উলফার (ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অফ আসাম) অন্তত ৭ জন নেতাকে এবং এনএলএফটি’র (ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট অফ ত্রিপুরা) ক’জন নেতাকর্মীকে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ গ্রেফতার করে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেছে। এসব হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে অত্যন্ত গোপনে। তবে মিডিয়ায়, বিশেষ করে ভারতীয় মিডিয়ায় বিষয়গুলো গোপন থাকেনি। বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক মিডিয়াতেও এই বন্দি হস্তান্তরের ঘটনাগুলো গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছে। অতিসম্প্রতি ভারতীয় মিডিয়ায় যে ঘটনা নিয়ে দারুণ হৈচৈ পড়ে গেছে সেটা হলো উলফার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমান সভাপতি অরবিন্দ রাজ খোয়া এবং এনএলএফটির সভাপতি বিশ্বমোহন দেব বর্মাকে চট্টগ্রাম থেকে আটক করে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশের আইজিসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের কেউই এ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেননি। কিন্তু ভারতীয় মিডিয়াতে এ ব্যাপারে তোলপাড় চলার পাশাপাশি সে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মি. চিদাম্বরমের বক্তব্য থেকে এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, গোটা ঘটনাপ্রবাহে উল্লাস চেপে রাখতে তার বেশ কষ্ট হচ্ছে। তিনি মিডিয়াকে ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, তার কাছ থেকে সময়মতো সুখবর পাওয়া যাবে। গত নভেম্বরে উলফার ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক চিত্রবন হাজারিকা ও বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক সম্পাদক শশধর চৌধুরীকে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে গ্রেফতার করে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হয় বলে দেশ-বিদেশের মিডিয়ায় খবর বেরিয়েছিল। সেবারও বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ সে খবরের সত্যতা পত্রপাঠ নাকচ করে দিয়েছিল। কিন্তু নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে উলফার এ দুই নেতাকে বন্দি অবস্থায় গৌহাটির আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। সে খবর ছবিসহ প্রাকাশিত হয় ভারতীয় মিডিয়ায়।
তাই পর্দার আড়ালের ঢাকের আওয়াজ চারদিকে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে, তথ্য গোপনের চেষ্টাকারীরা নিজেরাই হাস্যস্পদ হয়েছেন, গোটা জাতিকেও হাস্যস্পদ করেছেন। যে যেই দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখুন না কেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৭টি রাজ্যে (সেভেন সিস্টারস নামে পরিচিত) দীর্ঘদিন ধরে সশস্ত্র লড়াই চলছে। দিল্লির দৃষ্টিতে এসব হচ্ছে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হিংসাত্মক বাড়াবাড়ি। অপরপক্ষে সে অঞ্চলের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষের কাছে এটা হচ্ছে স্বাধীনতার লড়াই। যারা এ রক্তাক্ত হানাহানিতে জড়িত তারা বিচ্ছিন্নবাদী হোক অথবা স্বাধীনতাকামী, এই রক্তারক্তি ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। বৃহত্ রাষ্ট্র ভারতের নিকট-প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের উচিত হচ্ছে এসব ব্যাপারে নাক না গলানো। এই ইস্যুতে আমাদের বক্তব্য অত্যন্ত পরিষ্কার। সেভেন সিস্টারসে বাংলাদেশ অবশ্যই অশান্তি উস্কে দেবে না, পাশাপাশি ভারতের বরকন্দাজ সেজে সেখানকার সশস্ত্র লড়াই দমনে লাঠিয়ালের ভূমিকাও পালন করবে না। দুর্ভাগ্যক্রমে বর্তমান সরকার শেষোক্ত ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ায় ভারতের আগুন বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ভারত আমাদের নিকট-প্রতিবেশী এবং বন্ধু রাষ্ট্র। সে সুবাদে ভারতের জনগণ আমাদের বন্ধু। উত্তর-পূর্ব ভারতের সংঘাত-বিক্ষুব্ধ এলাকার জনগণও আমাদের বন্ধু। এ প্রেক্ষাপটে আমরা যদি কারও পক্ষে অথবা বিপক্ষে অবস্থান নেই তবে তাতে বন্ধুত্বের সংজ্ঞা বিকৃত হয়। এছাড়াও মানবাধিকার একটি স্পর্শকাতর বিষয়। কোনো দেশ থেকে কেউ যদি নিরাপত্তাহীনতার কারণে আমাদের দেশে আশ্রয় নেয় আর আমরা যদি তাদের সঙ্গে বলির পাঁঠার মতো আচরণ করি তাতে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় চরমভাবে। বাংলাদেশ বাংলাদেশের মতো করে চলবে, এটাই স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিত। কিন্তু বাইরের কোনো অদৃশ্য সুতার টানে যদি এদেশের ‘গাছের পাতা’ নড়তে থাকে তবে সেই পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়া যায় না। সেক্ষেত্রে আরও নেতিবাচক অস্বাভাবিকতাকে ডেকে আনার ক্ষেত্র তৈরি হয়। তাই সবার মঙ্গলের জন্য জনগণকে আস্থায় নিয়ে স্বচ্ছভাবে যে কোনো নাজুক পরিস্থিতির মোকাবেলা করা হোক, এটাই আমরা কামনা করি।

No comments

Powered by Blogger.