একলা চলো রে by আতাউর রহমান

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর মূল ও পরীক্ষণ থিয়েটার হলে সম্প্রতি ১২ দিনব্যাপী জাঁকজমকের সঙ্গে ইবসেন সেমিনার ও নাট্যোত্সব হয়ে গেল। বিদেশ থেকে এসেছিল প্রায় ১০টির মতো নাট্যদল। আর দেশের ১২টি নাট্য দল ইবসেন নাট্যোৎসব ও সেমিনারে যোগ দিয়েছে।

এই নাট্যযজ্ঞের প্রধান হোতা ছিল ‘সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার’, সংক্ষেপে সিএটি। এই নাম উচ্চারিত হলে স্বাভাবিকভাবে এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান পুরুষ কামালউদ্দিন নীলুর নাম উচ্চারণ করতে হয়। তিনি অত্যন্ত করিত্কর্মা নাট্যপ্রাণ মানুষ এবং নাট্য নির্দেশক হিসেবেও ইতোমধ্যে দেশে-বিদেশে অনেক সুনাম অর্জন করেছেন। আমিও নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের পক্ষে এই উত্সবে একটি নাটক নির্দেশনা দিয়েছি। এই নাটকে ইবসেনের দুই নাটকের দুই নিঃসঙ্গ চরিত্রের সঙ্গে সৈয়দ শামসুল হকের ‘ঈর্ষা’ কাব্য নাটকের আরেকটি নিঃসঙ্গ চরিত্রের মিলন হয় এক রেল স্টেশনে। এই নাটকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের একটা মেলবন্ধন ঘটে এবং একশ’ বছরেরও অধিক সময়ের ব্যবধানে দুই দেশের দুই নাট্যকার একাত্ম হয়ে ওঠেন। আমি প্রধানত ইবসেনের দুটি নাটক সম্পর্কে কিছু নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করতে প্রয়াসী। হেনরিক ইবসেনের একটি নাটক খুব জনপ্রিয় এবং প্রায়ই বিভিন্ন দেশে অভিনীত হয়ে আসছে। নাটকটির নাম ‘এ ডলস হাউস’। বাংলা ভাষায় বিভিন্ন শিরোনামে এই নাটকটি অভিনীত হয়েছে। যেমন ‘পুতুলের সংসার’ ‘পুতুল খেলা’, ‘পুতুলের ঘর’ ইত্যাদি। সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার আয়োজিত সেমিনার ও নাট্যোত্সবে দেশি-বিদেশি ৫টি নাটকের দল ‘এ ডলস হাউস’ মঞ্চায়ন করেছে, হয় সরাসরি অনুবাদে, না হয় রূপান্তরিত রূপে। সৈয়দ শামসুল হক রচিত আমার নির্দেশিত তিন নাটকের তিন চরিত্র নিয়ে রচিত নাটক ‘অপেক্ষমাণ’-এর অন্যতম প্রধান চরিত্র হিসেবেও ‘এ ডলস হাউস’-এর নোরার উপস্থিতি ছিল বেশ প্রখর। নাট্যাংশের একটি বড় অংশ জুড়ে ছিল নোরা আর নোরার স্বামী হেলমানের কথোপকথন। হেনরিক ইবসেন-এর ‘এ ডলস হাউস’ দেশে দেশে আজও কেন অভিনীত হয়ে চলেছে, এ ভাবার বিষয়। ইবসেন তার জীবদ্দশায় একটি মানবতাবাদী নাটক লিখেছিলেন যাকে অনেক নাট্যবোদ্ধা ও সাহিত্য সমালোচক নারীবাদী নাটক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ইউরোপে এই নাটকটি সমালোচনার ঝড় তুলেছিল, এমনকি জার্মানিতে নাটকটির মঞ্চায়ন বন্ধ করে দেয়া হয়। স্বামী-স্ত্রীর সামান্য ভুল বোঝাবুঝি অথবা ঝগড়ার কারণে ঘরের বৌ স্বামী ও তিনটি শিশু সন্তানকে পেছনে ফেলে চিরদিনের জন্য গৃহ ত্যাগ করতে পারে, একি সম্ভব? এই প্রশ্নবোধক চিহ্নটি আজও আমাদের বিদ্ধ করে চলেছে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাদ-বিসম্বাদ শুধু আমাদের দেশে নয়, পৃথিবীর সর্বত্র বিরাজমান। আমরা সামাজিক কলঙ্কের ভয়ে অথবা পুত্র-কন্যার স্বার্থে বিবাদ মিটিয়ে ফেলি অথবা জোড়া-তালি লাগিয়ে সংসার-যাত্রা চালিয়ে যেতে চাই। নেহাত অসহনীয় না হলে স্বামী-স্ত্রীর চির বিচ্ছেদ আমরা ঘটাতে চাই না। আমি নাটকটিকে বিচার করতে চাই মানবতাবাদী নাটক হিসেবে। পাশাপাশি এ কথাও সত্য যে, মাতৃতান্ত্রিক সমাজের অবলুপ্তির পর পিতৃতান্ত্রিক সমাজের অভ্যুদয়ের পর থেকে সমাজ ও সংসারে পুরুষের রাজত্ব গেড়ে বসল। পুরুষের রাজত্ব অথবা একনায়কত্ব থেকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ভূমি আজও সম্পূর্ণ মুক্ত নয়। আমরা আজকাল সরকার অথবা রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নারীকে দেখছি, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য হিসেবেও নারীকে দেখছি; কিন্তু তাতেও পুরুষের স্ব-আরোপিত ও স্বঘোষিত শ্রেষ্ঠত্ব কমেনি। আমাদের দেশে আজও ধর্ষণকারীর বিচার হয় না, অথচ কলঙ্কময়ী হয়ে ধর্ষিত নারীর বিচার হয়। এখনও স্কুল অথবা কলেজ স্বামী পরিত্যক্ত নারীর সন্তানকে ভর্তি করতে চায় না, পিতার পরিচয় জানতে চায়। আমার ধারণায় ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে প্রয়াত হেনরিক ইবসেনের ‘এ ডলস হাউস’ নাটকটি এই দৃষ্টিকোণ থেকে আজও প্রাধান্য পেয়ে আসছে। এখনও উন্নয়নশীল বিশ্বে, এমনকি উন্নত বিশ্বেও এই নাটকটিকে নারীবাদী নাটক হিসেবে গণ্য করা হয়। আমার ধারণায় যদিও আমরা একটি সর্বপ্রকার বৈষম্যহীন বিশ্বের স্বপ্ন দেখি, বৈষম্য পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ দূরীভূত হবে না, কোনো না কোনো সামাজিক বৈষম্য থেকেই যাবে। সুতরাং ভাবা অসঙ্গত হবে না যে, হেনরিক ইবসেনের ‘এ ডলস হাউস’ নাটকটি নব দ্যোতনায় নিরন্তর প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে। তার নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র নোরার মুখ থেকে নিঃসৃত বাক্য এই প্রাসঙ্গিকতার ইঙ্গিতবহ। নোরা স্বামীর ঘর ছাড়ার আগে স্বামীর কাকুতি-মিনতির উত্তরে বলে, ‘আমাদের পুনরায় মিলন যদি হয় তাহলে পৃথিবীতে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনাটি ঘটতে হবে।’ আমি মনে করি, যুগে যুগে, দেশে দেশে সেই আশ্চর্যজনক ঘটনাটি ঘটতে হবে পৃথিবী থেকে সব রকম বৈষম্য বিদূরিত করার জন্য। আমরা মানব মিলনের সেই
রাখিবন্ধনের অপেক্ষায় থাকব।
ইবসেনের একটি নাটককে মানুষের মনোজগতের পরিপ্রেক্ষিতে খুব প্রাসঙ্গিক মনে হয় আমার এবং নাটকটি আমাকে নানাভাবে জীবন সংগ্রামে অনুপ্রাণিত করে। নাটকটির নাম ‘অ্যান এনিমি অব দ্য পিপল’। এই নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র ড. স্টকম্যান সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে যুদ্ধ করে ক্ষতবিক্ষত হন কিন্তু কখনও পরাজয় মানতে চান না। তবে তার আদর্শের পরাজয় ঘটে সংঘবদ্ধ কায়েমি স্বার্থের কাছে, মানুষের সংঘবদ্ধ ভেদবুদ্ধির কাছে। তিনি ক্লাসিক্যাল হিরোদের মতো ঢাল-তলোয়ার নিয়ে আবার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েননি, তিনি জীবন দর্শনের এক অমোঘ অস্ত্র আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। নাটকের একেবারে শেষে তিনি তার পরিবারসহ পৃথিবীর সব মানুষকে জানাচ্ছেন —আমি মনে করি একা মানুষই বরাভয় হয়ে উঠতে পারে, একা মানুষই আত্ম আবিষ্কার করতে পারে, সে-ই গাইতে পারে, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।
লেখক : অভিনেতা ও নাট্যনির্দেশক

No comments

Powered by Blogger.