সময়চিত্র-রাষ্ট্রপতির কি কিছুই করার নেই! by আসিফ নজরুল

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর নতুন রাষ্ট্রগুলোর যাত্রা শুরু হয় নানা সমস্যা নিয়ে। ঔপনিবেশিক শোষণ বা কখনো যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির বোঝা তো ছিলই। এসব রাষ্ট্রের শাসকদের জন্য নতুন সংকট হয়ে দাঁড়ায় আন্তর্জাতিক আইন। মানবাধিকার ও পরিবেশ-সংক্রান্ত আইনের প্রকৃত বিকাশ ঘটে ঔপনিবেশিকতার অবসানের পরই।


নতুন রাষ্ট্রের শাসকদের অনেককে হঠাৎ করে উপলব্ধি করতে হলো যে ঔপনিবেশিক আমলের মতো ইচ্ছামতো ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার তাঁদের নেই, ইচ্ছামতো উন্নয়ন পরিকল্পনা নেওয়ার স্বাধীনতাও তাঁদের নেই। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানুষের অধিকার রক্ষা করে তাঁকে দেশ চালাতে হবে, বিবেচনায় নিতে হবে প্রাণী ও পরিবেশের স্বার্থও।
নতুন রাষ্ট্রের শাসকেরা প্রায় সবাই এসব আইন বা নীতি দৃশ্যত মেনে নিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁরা এসব প্রয়োগের দায়িত্ব এড়িয়ে গেছেন নানা কূটকৌশলে। তাঁরা আরও সমস্যায় পড়েন গণতন্ত্র নিয়ে স্বাধীন দেশের মানুষের ক্রমেই পরিণত চেতনাবোধের কারণে। নতুন বিশ্বব্যবস্থায় গণতন্ত্রের সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়েছে বিস্তৃত অর্থে। গণতন্ত্র মানে শুধু নির্বাচনে ভোট দেওয়ার অধিকার নয়, প্রতিনিধির মাধ্যমে রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণও। উচ্চ আদালত আর পার্লামেন্টারি কমিটিগুলোর মাধ্যমেই শুধু নয়, সরাসরি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে স্টেকহোল্ডারদের (স্বার্থসংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠী) সঙ্গে সরাসরি আলোচনা, তাঁদের অবহিতকরণ ও তাঁদের পরামর্শ গ্রহণের নীতি গৃহীত হয় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও দেশীয় আইনে।
একটি অসাধারণ সংবিধান নিয়ে যাত্রা শুরুর পরও বাংলাদেশ দীর্ঘদিন রাষ্ট্রের গণতন্ত্রকরণের এই প্রক্রিয়ার বাইরে ছিল। জনগণের অংশগ্রহণ সীমিত ছিল কেবল ভোটদানের ক্ষেত্রে। এই অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন সূচিত হয় ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সফলতার পর। বর্তমান সরকারের আমলে বিভিন্ন আইন প্রণয়ন, রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা গ্রহণ এবং সংবিধান সংশোধনীর বিষয়ে রাজনৈতিক ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে আলোচনা করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তবে আলোচনা যতই হোক, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে সরকারের বা কখনো কখনো শুধু সরকারের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ইচ্ছাকে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর ক্ষেত্রে এমনকি অগ্রাহ্য করা হয় এ-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির বিভিন্ন প্রস্তাবও।
এই পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক আয়োজিত চলমান সংলাপ নিয়ে তাই হয়তো খুব আশাবাদী হওয়ার কারণ নেই। সংলাপ যে হচ্ছে এবং তাতে প্রধান বিরোধী দল অংশ নিয়েছে, এটি স্বতন্ত্রভাবে একটি ইতিবাচক খবর। কিন্তু তা আরও অর্থবহ করতে হলে রাষ্ট্রপতির যে অবস্থান ও ক্ষমতা প্রয়োজন, তা আদৌ তাঁর আছে কি না কিংবা ক্ষমতাসীন দলের পরামর্শের বাইরে গিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ সৃষ্টি করার মতো স্বকীয়তা তাঁর আছে কি না, এ নিয়ে অনেকেরই সংশয় থাকতে পারে। তবে তিনি যদি এমন অবস্থান নিতে পারেন, তাহলে রাষ্ট্রপতির সংলাপ হয়তো সমঝোতার রাজনীতির নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে। তা না হলে আগামী নির্বাচন ঘিরে ঘনায়মান সংকট বাংলাদেশে নতুন বছরে আরও ঘনীভূত হতে পারে। রাষ্ট্রপতি চাইলেও সেই পরিস্থিতি হয়তো তখন আর সামাল দিতে পারবেন না।
চলমান সংলাপে তাই কিছু প্রশ্নে অগ্রগতি কাম্য। প্রধান দুটো দলের সদিচ্ছা থাকলে সেটি অসম্ভব নয়।

২.
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নিয়ে অনেক কৌতুক করা হয়। ঈদে দাওয়াত খাওয়ানো আর মিলাদ পড়া ছাড়া তাঁর আর কোনো কাজ নেই, এমন কথাও আমরা শুনেছি। এসব বক্তব্য আসলে সঠিক নয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সীমিত, কিন্তু তাঁর কোনো ক্ষমতাই নেই, এটি সত্য নয়। অন্য সব ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুসারে কাজ করতে সাংবিধানিকভাবে বাধ্য, তবে দুটো ক্ষমতা তিনি প্রয়োগ করতে পারেন সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির সবচেয়ে বড় ক্ষমতা, তিনি স্বাধীনভাবে দেশের প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করতে পারেন। একজন নিরপেক্ষ, যোগ্য, আত্মমর্যাদাশীল প্রধান বিচারপতি উপযুক্ত পদক্ষেপ নিয়ে দেশে বহু অনাচার দূর করতে পারেন, মহা প্রতাপশালী একটি সরকারের অনেক স্বৈরতান্ত্রিক পদক্ষেপও রুখে দিতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো রাষ্ট্রপতি আসলেই স্বাধীনভাবে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ কখনো করেছেন কি না, নাকি কাজটি করতে গিয়েও প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শই পালন করেছেন, তা আমাদের জানা নেই।
রাষ্ট্রপতির আরেকটি স্বাধীন ক্ষমতা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়োগ দেওয়া। সংবিধান অনুসারে যেহেতু তাঁকে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাকেই প্রধানমন্ত্রী বানাতে হয়, এই ক্ষমতা তাই নিতান্ত আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। তবে রাষ্ট্রপতির আরও কিছু ক্ষমতা আছে, যা প্রয়োগ করে তিনি ক্ষমতাসীন দলকে সতর্কসংকেত দিতে পারেন। যেমন, অর্থবিল ছাড়া সংসদে অন্য কোনো বিল বা খসড়া আইন পাস হওয়ার পর তাঁর কাছে অনুমোদনের জন্য এলে তিনি বিলটি বা তার কোনো অংশ পুনর্বিবেচনার জন্য বা কোনো সংশোধনীর প্রস্তাব করে সংসদে তা ফেরত পাঠাতে পারেন। মানবাধিকার লঙ্ঘনমূলক বা দুর্নীতির দায়মুক্তিমূলক আইন কোনো রাষ্ট্রপতি এভাবে ফেরত পাঠালে তা সরকারের জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে বাধ্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের কোনো রাষ্ট্রপতিকে আমরা এমন পদক্ষেপও নিতে দেখিনি।
রাষ্ট্রপতি যদি চান, তিনি আরও নানাভাবে নিজের স্বকীয় সত্তার পরিচয় দিতে পারেন। বর্তমান রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যে সংলাপের আয়োজন করছেন, তার আলোকে তাঁর যদি মনে হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে বা এর বিকল্প আছে কি না সেসব প্রশ্নে সংসদে দুটো দলের খোলামেলা আলোচনা প্রয়োজন, সংলাপ শেষে তিনি জোরের সঙ্গে তা বলতে পারেন। নির্বাচন কমিশন গঠন-সংক্রান্ত একটি আইন প্রণয়নের তাগিদ রয়েছে সংবিধানে কয়েক দশক ধরে। রাষ্ট্রপতির সংলাপের ফলশ্রুতি হিসেবে যদি সেই আইন প্রণয়ন করা হয় এবং সেই আইন অনুসারে উপযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের কমিশনে নিয়োগ দেওয়া হয়, তাহলে সেটিও হবে একটি অর্জন। তবে তাই বলে মূল সংকটের নিরসন এতে হবে না। বড় দুটো রাজনৈতিক দলের আসল বিরোধ তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখা না-রাখা নিয়ে। এবারের সংলাপে এটি আলোচ্য বিষয় নয়। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে দুই বড় দলকে একসময় আলোচনায় বসতেই হবে। না হলে এই প্রশ্নের মীমাংসা করতে হবে রাজপথে শক্তি প্রদর্শনের দ্বন্দ্বে। বাংলাদেশের মানুষের জন্য তা কল্যাণকর হবে না।

৩.
বিরোধী দলের চট্টগ্রাম রোডমার্চ কর্মসূচিতে সবচেয়ে জোরালোভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি তোলা হয়েছে। এই কর্মসূচিতে বিপুল জনসমাগম বিরোধী দলকে উজ্জীবিত করেছে, আবার কর্মসূচিতে কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি না করে সরকারও প্রশংসিত হয়েছে। বিরোধী দলের ১২ মার্চ কর্মসূচি একইভাবে পালিত হলে আমাদের দুর্ভাবনার কারণ থাকবে না। কিন্তু সরকার ও বিরোধী দল আগামী নির্বাচন কার অধীনে হবে, এই প্রশ্নে কোনো সমঝোতার চেষ্টা না করলে রাজনৈতিক অঙ্গনে ভবিষ্যতে অস্থিরতা বেড়েই চলবে।
সরকার পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপ করলেও এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার অবকাশ এখনো রয়েছে। সরকারি দলের উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি শুধু বিএনপির নয়। দেশের আরও বহু রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে এই সরকারব্যবস্থা পুনস্থাপনের দাবি করেছে। সরকার আদালতের যে রায়ের কথা বলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেছে, সেই রায় অনুসারে আগামী দুটো নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠান করার অবকাশ রয়েছে। সংবিধান সংশোধনী কমিটির সভায় এমনকি দল হিসেবে আওয়ামী লীগও সংস্কার সাপেক্ষে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছিল।
মূল কথা হচ্ছে, সংঘাতের রাজনীতি পরিহার করতে হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের সম্ভাবনা নিয়ে ভাবতে হবে। প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে সংসদে এসে বিরোধী দলকে বক্তব্য দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে সংসদে গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের পক্ষে বক্তব্য দিলে বিরোধী দলের জন্য ক্ষতির কিছু নেই। এই বক্তব্য সরকারি দল প্রত্যাখ্যান করার সম্ভাবনা থাকলেও সংসদে বক্তব্য পেশ করা সংক্রান্ত বিরোধী দলের তার নিজস্ব দায়দায়িত্ব পালন করা উচিত। সরকারি দলের উচিত, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রশ্নে অনড় থাকলে যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি দেশে সৃষ্টি হতে পারে, তা বিবেচনায় নিয়ে সমঝোতার সব সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা। যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মতো কেউ কেউ মাঝেমধ্যে বলে থাকেন, তা কীভাবে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনা নিশ্চিত করবে, তা বিস্তারিতভাবে সরকারের এখনই বলা প্রয়োজন।
আমরা মনে করি, সংসদে সব দলকে খোলামনে আলোচনা করতে হবে, সব অতীত অভিজ্ঞতা বিবেচনায় রাখতে হবে এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাগুলো বিবেচনায় রাখতে হবে। রাজপথে বিএনপির বিপুল সমর্থন কিংবা সংসদে আওয়ামী লীগের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা মাথায় রেখে দল দুটোকে নিজের অবস্থানে অনড় না থেকে সম্ভাব্য সব শান্তিপূর্ণ বিকল্প ভেবে দেখতে হবে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের নিরন্তর প্রচেষ্টায় নির্বাচনকালীন সরকার এবং নির্বাচন কমিশনকে আরও নিরপেক্ষ ও কার্যকর করার চিন্তা আমাদের সততার সঙ্গে করতে হবে।
রাষ্ট্রপতির সংলাপ সেই প্রক্রিয়ায় কিছুটা অগ্রগতি সৃষ্টি করতে না পারলে অর্থনৈতিক কারণে বিপর্যস্ত মানুষের হতাশা আরও বাড়বে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.