নিরাপদ সড়ক দিবস-স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই by দীপংকর ভট্টাচার্য লিটন

দেশব্যাপী সড়ক দুর্ঘটনার মাত্রা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। তার সঙ্গে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত কারণে মৃত্যুর সংখ্যা। মৃত্যু চিরন্তন। জন্মিলে মরতে হয়। কিন্তু এ রকম মৃত্যু তো কারো কাম্য নয়। আমার এক নিকটাত্মীয়ের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে সম্প্রতি। রজত ভট্টাচার্য প্রতিদিন সকালে অফিসের উদ্দেশে বের হয়ে রাতে বাসায় ফিরতেন। সেদিনও সুস্থ-সবল দেহ নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে রাতে ফিরলেন নিথর দেহ নিয়ে।


অকালমৃত্যুতে স্বামীকে হারিয়ে স্ত্রীর কান্না, বাবাকে হারিয়ে সন্তানের কান্না, ভাইকে হারিয়ে বোনের কান্না, সুহৃদকে হারিয়ে প্রতিবেশীদের কান্নায় যেন নিস্তব্ধ রাতের আকাশ ভারী হয়ে উঠছিল। কলেজপড়ুয়া বড় মেয়ে তিশা ঘাতক চালককে উদ্দেশ করে বলছে আমার বাবাকে কেন মেরে ফেললে। ছোট মেয়ে অর্পা শুধু 'বাবা বাবা' বলে বিলাপ করছে। একমাত্র ছেলে সাড়ে চার বছর বয়সের রুদ্র অবুঝ শিশুর মতো শুধু চারদিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু এই অবুঝ সন্তানদের সান্ত্বনা জানানোর ভাষা উপস্থিত কারোরই জানা ছিল না। এ রকম রজত ভট্টাচার্য কিংবা তাঁর সন্তানদের মতো আরো অসংখ্যজন আছেন দেশে। রাষ্ট্রই যেখানে নীবর, সেখানে সাধারণ মানুষের কী-ই বা করার আছে। দেশে ট্রাফিক আইন আছে। কিন্তু যথাযথ প্রয়োগ নেই। স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি দিতে পারছে না রাষ্ট্র। কিন্তু জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করা তো রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব। জনগণের করের টাকায় প্রতিপালিত পুলিশ বাহিনীর কিছু ট্রাফিক পুলিশ শুধু উপরি বাণিজ্যে মত্ত। প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়তে থাকলেও নির্ধারিত গতিসীমার ওপর গাড়ি চালানোর অপরাধে পুলিশ মামলা করেছে এমনটি কি শোনা যায়? সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সরকার কর্তৃক নতুন ট্রাফিক আইন প্রণয়নের বিষয়টি ছিল ইতিবাচক। 'রোড ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড ট্রাফিক অ্যাক্ট' নামে প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় বেপরোয়া ও বিপজ্জনক গাড়ি চালানোর জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি দুই বছরের কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। ১৯৮৩ সালের সংশোধিত মোটরযান অধ্যাদেশ অনুযায়ী একই অপরাধের জন্য শাস্তি ছিল সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড এবং মাত্র এক হাজার টাকা জরিমানা। এ আইনটি ছিল ব্রিটিশ আমলে প্রণীত ১৯৩৯ সালের মোটরযান আইনের সম্প্রসারণ। শেষ পর্যন্ত সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নসহ চালকদের আন্দোলনের মুখে তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। সড়ক দুর্ঘটনার নানা কারণের মধ্যে অদক্ষ চালক ও ড্রাইভার, অনুন্নত সড়ক অবকাঠামো, মাত্রাতিরিক্ত ও পুরনো যানবাহন, ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা, আইনের প্রয়োগহীনতা, সর্বোপরি পথচারীদের অসতর্কতা দায়ী হলেও প্রধানত এর দায়-দায়িত্ব বর্তায় সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি অর্থাৎ বিআরটিএর ওপর। অবশ্য এককভাবে যে বিআরটিএ দায়ী তা নয়। প্রায়ই যানবাহন ও চালকের ভুয়া কাগজপত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স ভুয়া। ব্যবহারিক পরীক্ষা ছাড়াই চালকরা লাইসেন্স পাচ্ছেন। আর এটা সম্ভব হচ্ছে বিআরটিএর একশ্রেণীর অসাধু কর্মচারীর যোগসাজশে। এ প্রক্রিয়ায় অনেক অদক্ষ ও অর্ধশিক্ষিত চালকও লাইসেন্স পেয়ে যান অবলীলাক্রমে। আজ জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবসে সড়ক দুর্ঘটনামুক্ত বাংলাদেশ চাই_এই হোক আমাদের অঙ্গীকার। সড়ক দুর্ঘটনার হার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব না হলেও তা হ্রাসের জন্য নেওয়া হোক কার্যকর ব্যবস্থা। প্রয়োজনে এ লক্ষ্যে নতুন নীতিমালা গ্রহণ করে সে মোতাবেক পদক্ষেপ নেওয়া হোক। সরকার জননিরাপত্তা বিধানে নতুন আইন প্রণয়নে অগ্রসর হবে বলেই প্রত্যাশা করি। নিরাপদ সড়কের দাবি গণদাবি। এটি উপেক্ষা করার কোনো অবকাশ নেই।
দীপংকর ভট্টাচার্য লিটন

No comments

Powered by Blogger.