মৃদুকণ্ঠ-সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী by খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

সোশ্যাল সেফটি নেট বা সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী বলতে আমরা এমন কিছু প্রোগ্রাম বা কর্মসূচিকে বুঝি, যে কর্মসূচিগুলো সমাজের দরিদ্র, অক্ষম বা বঞ্চিত মানুষকে বেঁচে থাকার নিম্নতম প্রয়োজন মেটাতে সাহায্য করে। মানুষের বেঁচে থাকার তীব্রতম সংকট হচ্ছে ক্ষুধা। তাই ক্ষুধা নিবারণ এই কর্মসূচির প্রধান লক্ষ্য। পর্যায়ক্রমে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান_এসব বিষয়ও এসে পড়ে। বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে।

সে হিসাবে পাঁচ কোটি মানুষের খাদ্যনিরাপত্তার বিরাট দায়িত্ব এসে পড়ে সমাজের ওপর এবং কার্যত সরকারের ওপর। খাদ্যের সঙ্গে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার বিষয়টিও চলে আসে। এটি রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের পর্যায়ে পড়ে। রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে সমাজতন্ত্র অর্থাৎ সামাজিক সাম্যের দায়বদ্ধতা রয়েছে। আমাদের সমাজতন্ত্র কমিউনিজম নয়। এটি সংবিধানেই রয়েছে। কমিউনিজমে দেশের সব সম্পদের মালিক রাষ্ট্র। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানে পরিষ্কার উল্লেখ রয়েছে যে দেশের সম্পদের তিন ধরনের মালিকানা থাকবে_১. ব্যক্তিগত, ২. সমবায়ভিত্তিক এবং ৩. রাষ্ট্রীয়। বাহাত্তরের সংবিধানে বাংলাদেশি সমাজতন্ত্র এভাবেই সংজ্ঞায়িত। এটি ছিল একটি অগ্রসর চিন্তা। সমাজতন্ত্রের সঙ্গে গণতন্ত্রের মিশ্রণ। জনগণের সংশ্লেষণ। সমাজতন্ত্রের যুগোপযোগী উত্তরণ। তবে সমাজতন্ত্রের এ ধরনের সংজ্ঞায়ন ও বাস্তবায়ন কিছু ইউরোপীয় দেশে প্রত্যক্ষ করা যায়। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ফ্রান্স, জার্মানি, এমনকি ব্রিটেনেও এটি লক্ষ করা যায়। এ ধরনের নমনীয় এবং আধুনিক সমাজতন্ত্রকে কল্যাণতন্ত্র বলা হয়ে থাকে। এ ধারার অর্থনীতি কল্যাণ অর্থনীতি এবং এ ধারার রাষ্ট্র কল্যাণ রাষ্ট্র নামে পরিচিত। কল্যাণ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হলো_১. ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান সহনীয় পর্যায়ে বজায় রাখা এবং ২. দরিদ্র, অক্ষম ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর নিম্নতম প্রয়োজন মেটানোর দায়িত্ব রাষ্ট্র কর্তৃক গ্রহণ করা।
কল্যাণ রাষ্ট্রবোধক সমাজতন্ত্র অর্জনের লক্ষ্য অভিমুখে চলতে হলে বাংলাদেশকেও অনুরূপ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। বিষয়টি অবশ্যই আপেক্ষিক। নরওয়ে বা সুইডেন যে মাত্রার 'দরিদ্র'কে যে পরিমাণ সহায়তা দান করে, বাংলাদেশের পক্ষে তা সম্ভব নয়। কারণ বাংলাদেশের জাতীয় আয় কম। আয়ের সঙ্গে সংগতি রেখেই ব্যয় করতে হয়। তবে নীতি বা প্রিন্সিপল একই। বাজেটের উল্লেখযোগ্য অংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনযাপনের নিরাপত্তা বিধানের জন্য ব্যয় করতে হবে। জাতীয় আয় যতই বাড়তে থাকবে, কল্যাণ ব্যয় ততই বৃদ্ধি পাবে। দারিদ্র্যের আপেক্ষিকতা সহনীয় হয়ে উঠবে। সামাজিক অস্থিরতা হ্রাস পাবে। সমাজ সংহত হবে এবং সামাজিক স্পন্দন বৃদ্ধি পাবে। এই অর্থনৈতিক দর্শনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে 'সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর কর্মসূচি প্রণীত। ২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেটের প্রায় ১৫ শতাংশ এই খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যা বাজেটের বৃহত্তম বরাদ্দ। বরাদ্দকৃত অর্থ দেশের জাতীয় আয়ের আড়াই শতাংশ। এ কথা বলা যায়, অর্থনৈতিক সক্ষমতা বিচারে এ বরাদ্দ কল্যাণ অর্থনীতির শর্ত পূরণ করে। বরাদ্দ মানেই কিন্তু সর্বোত্তম ব্যবহার নয়। এমনকি বরাদ্দকৃত অর্থ পুরোপুরি খরচ হলেও সঠিক ব্যবহার হয়েছে, এমনটা দাবি করা যাবে না। সঠিক ব্যবহার বলতে বোঝা যায়_ক. উপকারভোগী নির্বাচন সঠিক হয়েছে কি না, খ. উপকারভোগী তার প্রাপ্য সুবিধা পুরোপুরি পেয়েছে কি না, গ. উপকারভোগী নির্বাচন ও বণ্টনব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ছিল কি না, ঘ. দুর্নীতি ছিল কি না, ঙ. উপকারভোগীদের ভোগান্তির পরিমাণ কেমন ছিল এবং ছ. যে লক্ষ্যে সুবিধা বিতরণ করা হয়েছে, তার কত অংশ অর্জিত হয়েছে।
এসব নিয়ে গবেষণা কম হয়। আলোচনা আরো কম হয়। 'সিভিল সোসাইটি' অনেক তাত্তি্বক এবং রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণী বিষয় নিয়ে আলোচনায় ঝড় তোলে সেমিনার, টক-শো এবং পত্রিকার কলামে। সেসব প্রয়োজন। কিন্তু বাজেটের ১৫ শতাংশ বরাদ্দ গরিবের কতটা কাজে লাগল, কতটা অপব্যবহার হলো তা নিয়ে মাথাব্যথা কম। প্রায়োগিক সমীক্ষার সংখ্যা হাতে গোনা। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামী কথাবার্তা সবাই বলেন। কিন্তু দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে গৃহীত কর্মসূচি নিয়ে কথাবার্তা বড়ই কম। এই নিস্পৃহতা এবং বৈপরীত্যের কারণ সমাজবিজ্ঞানীরা অনুসন্ধান করতে পারেন। জানা গেছে যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সর্বমোট ৮৬টি কর্মসূচি রয়েছে। সরকারের কোনো মন্ত্রণালয় অথবা মাঠপর্যায়ের বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো ৮৫টি কর্মসূচির নাম বলতে পারবেন কি না সন্দেহ। গবেষকরা বিভিন্ন সময়ে গৃহীত কর্মসূচিগুলো একত্র করে সংখ্যাটি বের করেছেন। সম্ভবত বর্তমানে ১৫ থেকে ২০টি কর্মসূচি সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর সিংহভাগ জুড়ে রয়েছে, যা মোট বরাদ্দের কমবেশি ৯০ ভাগ হতে পারে। প্রধান কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ক. ভিজিএফ, খ. ভিজিডি, গ. কর্মসংস্থান প্রকল্প, ঘ. বয়স্কভাতা, ঙ. বিধবাভাতা, চ. একটি বাড়ি-একটি খামার প্রকল্প, ছ. দরিদ্র ছাত্রদের শিক্ষা প্রকল্প, জ. ওএমএস প্রকল্প এবং ঝ. টেস্ট রিলিফ ইত্যাদি। সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর সামগ্রিক মূল্যায়নভিত্তিক কোনো সমীক্ষা আমাদের নজরে আসেনি। তবে ভিজিডি ও কর্মসংস্থান প্রকল্পের একেবারেই মোটা দাগের একটি ছোট্ট সমীক্ষা এ বছর করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সমুন্নয়। ভিজিএফ-বিষয়ক অনুরূপ একটি সমীক্ষাও অন্য একটি প্রতিষ্ঠান প্রকাশ করেছে। সমীক্ষাগুলো বিশদ এবং গভীর নয়। তবু কিছুটা ধারণা এ থেকে পাওয়া যায়।
সমীক্ষাগুলোর সবচেয়ে সুখকর দিক হলো, স্বল্পসংখ্যক উপকারভোগীই ঘুষ প্রদানের কথা বলেছেন। তবে অনিয়ম এবং অস্বচ্ছতার কথা মোটা দাগে উঠে এসেছে। সমীক্ষায় উঠে আসা অনিয়মের মধ্যে রয়েছে_ক. বয়সসীমা লঙ্ঘন, খ. ভূমি মালিকানার সীমা লঙ্ঘন, গ. বসতবাড়ির অবস্থা, ঘ. অভুক্ত থাকার সংজ্ঞা পালনে নমনীয়তা, ঙ. ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বারদের আত্মীয়দের সুবিধা প্রদান, চ. বিধি মোতাবেক উন্মুক্ত স্থানে জনসমাবেশে সুবিধাভোগী নির্বাচন না করা এবং ছ. দুর্বল মনিটরিং ব্যবস্থা। দরিদ্রতমদের কর্মসংস্থান প্রকল্পে (EGPP) এবং ভালনারেবল গ্রুপ ডেভেলপমেন্ট (VGD) প্রকল্পে উপকারভোগীর বয়সসীমা যথাক্রমে ১৮ থেকে ৬০ বছর এবং ১৮ থেকে ৪৯ বছর। সমীক্ষামতে প্রথম প্রকল্পে বয়সসীমা লঙ্ঘনের হার ৫.৬ শতাংশ এবং দ্বিতীয় প্রকল্পে ১০.৭৫ শতাংশ। এটি বড় রকমের বিচ্যুতি নয়। বিশেষ করে দরিদ্রের বয়স বিচার না করাই শ্রেয়। ইজিপিপি এবং ভিজিডি প্রকল্পে উপকারভোগীর জমির মালিকানার উচ্চসীমা যথাক্রমে ৫০ শতাংশ এবং ১৫ শতাংশ। সমীক্ষামতে, উচ্চসীমা লঙ্ঘনের হার প্রথম প্রকল্পে ৫ শতাংশ এবং দ্বিতীয় প্রকল্পে ১৪ শতাংশ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভূমিহীনরাই প্রকল্প দুটিতে সুবিধাভোগী। এ ক্ষেত্রে জোরালো অভিযোগ নেই। দারিদ্র্য নিরূপণের জন্য আরেকটি শর্ত রাখা হয়েছে উপকারভোগীর বসতবাড়ির অবস্থা সম্পর্কে। পাকাবাড়ি হবে না; দারিদ্র্যসূচক বাড়ি হতে হবে। ইটের গাঁথুনিতে দেয়াল দেওয়া বাড়ির সংখ্যা প্রথম প্রকল্পে ৩ শতাংশ এবং দ্বিতীয় প্রকল্পে ৪ শতাংশ। এটি সংখ্যা হিসেবে নগণ্য। তা ছাড়া বাবার মৃত্যুর পর সন্তানরা পাকা দেয়ালের বাড়িতে অধিকতর দারিদ্র্যের মধ্যে অবস্থান করতে পারে।
অভুক্ত থাকার সংজ্ঞাটি গুরুত্বপূর্ণ। ইজিপিপি প্রকল্পে মঙ্গা ও নদীভাঙন এলাকার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। ভিজিডি প্রকল্পে দিনে অন্তত একবারও নিয়মিত খেতে পায় না, এমন পরিবারের কথা বলা হয়েছে। সমীক্ষায় প্রকাশ পেয়েছে, উপকারভোগীরা কমবেশি অভুক্তের সংজ্ঞায় পড়ে। অধিকাংশ মঙ্গা এলাকায় বছরে চার মাস খাদ্যসংকট চরমে থাকে। মধ্য মার্চ থেকে মধ্য এপ্রিল এবং মধ্য সেপ্টেম্বর থেকে মধ্য নভেম্বর খাদ্যসংকটের সময় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। মঙ্গা ও নদীভাঙন এলাকায় আলোচ্য প্রকল্প দুটি দরিদ্র মানুষের বিশেষ অবলম্বন হিসেবে বিবেচিত। একটি সংবেদনশীল বিষয় হলো, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-সদস্যদের আত্মীয়দের সুবিধা প্রদান। সমীক্ষায় প্রকাশ পেয়েছে, কর্মসংস্থান প্রকল্পে ৫ শতাংশ এবং ভিজিডি প্রকল্পে ৭.৫ শতাংশ উপকারভোগী চেয়ারম্যান-মেম্বারদের আত্মীয়। বাস্তবে এই হার আরো বেশি হতে পারে। চেয়ারম্যান-মেম্বারদের বক্তব্য হলো, তাঁদের কি গরিব আত্মীয়স্বজন থাকতে পারে না? আত্মীয় বলেই কি তারা বঞ্চিত হবে? এ বিষয়টাও বিবেচনার দাবি রাখে। আত্মীয় হলেও তারা যদি প্রকল্পের সুবিধাভোগী নির্ণয়ের ক্রাইটেরিয়া পূরণ করে থাকে, তাহলে দোষের কিছু নেই। প্রার্থী নির্বাচন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা প্রকাশ করার জন্য বিধান রয়েছে যে উন্মুক্ত স্থানে এলাকাবাসীর উপস্থিতিতে বাছাই সম্পন্ন করতে হবে। এই গুরুত্বপূর্ণ বিধানটি দারুণভাবে উপেক্ষিত হয়েছে। প্রার্থীদের ৩৬ শতাংশ জানিয়েছেন, উন্মুক্ত স্থানে কোনো সভা হয়নি। বাকি ৬৪ শতাংশের অর্ধেক জানিয়েছে, সভা হলেও সভায় প্রার্থী নির্বাচন হয়নি। এ পরিসংখ্যানটি ইজিপিপি প্রকল্পের ক্ষেত্রে ঘটেছে। ভিজিডি প্রকল্পের সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ৫০ শতাংশ প্রার্থী উন্মুক্ত সভা হয়েছে বলে স্বীকার করেছে। প্রার্থী নির্বাচনে নিরপেক্ষতার বিষয়ে ক. সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ হয়েছে বলেছে ১৮ শতাংশ, খ. মোটামুটি নিরপেক্ষ বলেছে ৫৩ শতাংশ এবং গ. ২৮ শতাংশ বলেছে, নির্বাচন একেবারেই নিরপেক্ষ হয়নি। এই পরিসংখ্যান অবশ্য সামষ্টিক গড়। কোনো কোনো জেলায় উন্মুক্ত সভা যেমন একেবারেই হয়নি, তেমনি প্রার্থী বাছাইও সম্পূর্ণ পক্ষপাতপূর্ণ। আবার কোনো কোনো এলাকার অবস্থা উল্টো। এতে মনে হয়, স্থানীয় সংসদ সদস্য ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত সততা ও স্বচ্ছতার ওপর প্রার্থী বাছাই নির্ভর করছে। প্রকল্পের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের চেয়ে স্থানীয় নেতাদের ওপর নির্ভরশীল রয়েছে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া।
প্রকল্প মনিটরিংয়ের অবস্থা আরো খারাপ। সুবিধাভোগীরা জানিয়েছে, মনিটরিং অর্থাৎ প্রকল্প চলাকালে দেখাশোনা করার মতো কিছু তাদের নজরে আসেনি। এমনকি নির্বাচন কমিটি নামে কিছু আছে বলেও তারা জানে না। এই হলো সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত তথ্যাবলি। এসব তথ্য নিয়ে জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে যে ওয়ার্কশপ হয়েছে, সেখানে আরো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। রাখঢাক না করেই তাঁরা বলেছেন, মূল সমস্যাটা অন্য জায়গায়। প্রকল্পের আওতায় যদি ৩০ কেজি চাল দেওয়া হয়, তাহলে গ্রহীতা ভাগ্যবান হলে সর্বাধিক ২৪ কেজি পেয়ে থাকে। অনেকে ১৮ কেজিও পেয়ে থাকে। কারণ হিসেবে জানা যায়_ক. চাল সংগ্রহের সময় প্রতি ১০ কেজিতে দুই কেজি কম থাকে; খ. সৎ বিতরণকারীরা ১০ কেজির স্থলে আট কেজি দিতে পারেন; গ. চেয়ারম্যান বা অন্য কেউ ভাগ বসালে কমতে কমতে ছয় কেজিতে দাঁড়ায় এবং ঘ. যাঁর দস্তখতে বিতরণ মঞ্জুরি হয়, তিনি বখরা ছাড়া অনুমোদন দিতে প্রায়ই রাজি থাকেন না (অবশ্য ব্যতিক্রম রয়েছে)। মূল দুর্নীতিটা চাল বিতরণে। নির্বাচন মোটামুটি গ্রহণযোগ্য। কিন্তু বিতরণপ্রক্রিয়া খোলামেলাভাবেই দুর্নীতিগ্রস্ত। খাদ্য বিতরণে দুর্নীতি রোধ করার একটা উপায় রয়েছে। রাজনৈতিক সংকল্প থাকলে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। খাদ্য বিতরণ সম্পূর্ণ বন্ধ করে, খাদ্যের মূল্য নগদ অর্থে বিতরণ করার সুপারিশ এসেছে। এ প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে হলে ক. সব সুবিধাভোগী ১০ টাকা দিয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলবে; খ. প্রার্থী নির্বাচনের পর আর কোনো মঞ্জুরির প্রয়োজন হবে না; গ. সুবিধাভোগীর অ্যাকাউন্টে সরাসরি মাসিক বা ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে অর্থ জমা হবে, তবে মাসিক বা ত্রৈমাসিক মঞ্জুরি প্রদানে কারো দস্তখতের জন্য মঞ্জুরি আটকে থাকবে না, মঞ্জুরি হবে স্বয়ংক্রিয় এবং ঘ. ব্যাংক নিজস্ব খরচায় (বা সরকারি খরচায়) ছবি তুলে অ্যাকাউন্ট খুলবে এবং ছবি মিলিয়ে উইথড্রয়াল স্লিপের মাধ্যমে অর্থ পরিশোধ করবে। সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আরো একটি বিষয়ে সামগ্রিক পর্যালোচনার প্রয়োজন রয়েছে। বেষ্টনীর আওতায় প্রকল্প সংখ্যা ৮৬টি বলে জানা যায়। এত প্রকল্পের পারস্পরিক কো-অর্ডিনেশন কঠিন কাজ এবং কার্যত হচ্ছেও না। বেনিফিশিয়ারির সংখ্যা হ্রাস না করে (বরং প্রয়োজনে বৃদ্ধি করে), প্রকল্প সংখ্যা হ্রাস করা সম্ভব বলে ধারণা। কাজটি সতর্কতার সঙ্গে করতে হবে।
আরেকটি জরুরি এবং অর্থপূর্ণ কাজ করতে হবে এবং সেটি হলো, সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় সুবিধাভোগীদের প্রকল্পওয়ারি তালিকা প্রস্তুতকরণ এবং তালিকা অনুযায়ী প্রত্যেক সুবিধাভোগীর প্রয়োজনীয় তথ্যাবলির ডেটাবেইস তৈরীকরণ, সংরক্ষণ ও নির্দিষ্ট সময় পর পর হালনাগাদকরণ। কাজটি প্রযুক্তিগতভাবে মোটেই কঠিন নয়। তবে সরকারের রাজনৈতিক সংকল্প এর পূর্বশর্ত। বাস্তবায়নে ইউএনডিপির মতো বিশ্ব সংস্থার সহায়তা প্রত্যাশা করা যায়। ডেটাবেইস তৈরি করা হলে ধীরে ধীরে সব হতদরিদ্রকে বেষ্টনীর আওতায় আনা যাবে এবং অবাঞ্ছিতদের অন্তর্ভুক্তি বাতিল করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া ক্রমাগত মূল্যায়নের দ্বারা সুবিধাভোগীদের স্বাবলম্বিতা অর্জনের ধারাও পরীক্ষা করা যাবে এবং দুর্বলতা পরিলক্ষিত হলে প্রকল্প পর্যালোচনা করে সংশোধন করা সহজ হবে। দেশে শেয়ারবাজার, কালোবাজার আর কালো টাকা নিয়ে যত আলোচনা, মিডিয়া প্রতিবেদন, টক-শো বা সেমিনার-গোলটেবিল বৈঠক হয়, তার ১ শতাংশও হয় না দরিদ্র বা সুবিধাবঞ্চিতদের নিরাপত্তাবেষ্টনীর প্রকল্প নিয়ে, যে সব প্রকল্পে সর্বমোট উপকারভোগীর সংখ্যা ৫৯ মিলিয়ন বা পাঁচ কোটি ৯০ লাখ দুর্বল মানুষ, যাদের জন্য বরাদ্দ থাকে মোট বাজেটের প্রায় ১৫ শতাংশ, যা নাকি জাতীয় আয়ের ২.৫০ শতাংশের মতো। এদের অনুচ্চ কণ্ঠ পল্লীর বাতাসেই মিলিয়ে যায়, শহরে প্রবেশের সুযোগ পায় না। এদের ক্ষোভ থাকলেও বিক্ষোভ করার সুযোগ নেই। মিছিল করার অবকাশও নেই।

লেখক : সাবেক ডেপুটি গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক ও কলামিস্ট।

No comments

Powered by Blogger.