বেগম রোকেয়াঃ জাগরণের অগ্রদূত by বশিরুজ্জামান বশির

নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া। বাংলাদেশেরই একটি গ্রাম পায়রাবন্দ, থানা-মিঠাপুকুর, জেলা-রংপুর। এ গ্রামেরই এক সম্ভ্রান্ত প্রাচীন পরিবার হলো সাবের পরিবার। ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর এই সাবের পরিবারে বেগম রোকেয়ার জন্ম। বিয়ের পর বেগম রোকেয়া স্বামীর সঙ্গে ভাগলপুরে চলে যান।
উদারমনা উচ্চশিক্ষিত স্বামীর উত্সাহ ও সাহায্যে বেগম রোকেয়ার কর্মপ্রেরণা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। এই সময়েই প্রকৃতপক্ষে তার ইংরেজি শিক্ষা ও সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। রোকেয়ার প্রথম প্রকাশিত রচনা বেরোয় নবনূর পত্রিকায়, মাঘ ১৩১০ সনে। রচনার নাম ‘নিরীহ বাঙালি’। এটি তার প্রথম প্রকাশিত রচনা হলেও প্রথম রচনা নয়। এর আগে অনেক লেখা লিখে তিনি নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়েছিলেন। তবে লেখিকা হিসেবে বিয়ের পরই রোকেয়ার প্রথম আত্মপ্রকাশ।
নবনূর ছাড়া অন্যান্য সাময়িক পত্রেও বেগম রোকেয়ার কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প ইত্যাদি প্রকাশিত হতে থাকে। এ সময় তিনি মিসেস আরএস হোসেন নামে লিখতেন। স্ত্রীর মধ্যে যে বিরাট সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে তার বিকাশে সাহায্য করাও যে অবশ্য কর্তব্য এটা গভীরভাবে অনুভব করতেন বেগম রোকেয়ার স্বামী সাখওয়াত হোসেন।
বেগম রোকেয়ার সংগ্রামী জীবনের শুরুটাই ছিল অন্যরকম। স্কুলের দশ হাজার টাকা যে ব্যাংকে জমা রাখা ছিল, সে ব্যাংক ফেল হলো। এতে তার যে দু’চারজন শুভাকাঙ্ক্ষী ও সহকর্মী ছিল তারা নিরাশায় ভেঙে পড়ল। কিন্তু বেগম রোকেয়া ভেঙে পড়লেন না বা পরাজয়ও মেনে নিলেন না। নিজের টাকা থেকে প্রায় ত্রিশ হাজার টাকা স্কুলের জন্য দান করেন। স্কুল পরিচালনার ব্যাপারে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য বেগম রোকেয়া কোলকাতায় ইংরেজি, বাঙালি, ব্রাহ্মণ, খ্রিস্টান সমাজের সব অভিজ্ঞ কর্মদক্ষ মহিলাদের সঙ্গে মিশে কোলকাতার বিখ্যাত বালিকা বিদ্যালয়গুলোর কার্যপ্রণালীর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ করে নেন। তার জীবনের একমাত্র আকাঙ্ক্ষা ও আদর্শ ছিল মুসলমান মেয়েদের অজ্ঞতার আঁধার থেকে জ্ঞানের আলোয় নিয়ে আসা। নিঃসন্তান বেগম রোকেয়া স্কুলের ছাত্রীদের কন্যা স্নেহে দেখতেন। তার অসীম অধ্যবসায় ও অনুপ্রেরণায় অবশেষে ১৯৩০ সালে সাখাওয়াত স্কুল উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে পরিণত হয়।
কেবল নারী শিক্ষাই নয়, নারী আন্দোলনের ক্ষেত্রেও বেগম রোকেয়া ছিলেন অগ্রদূত। শিক্ষা বিস্তারে মনোনিবেশের পর বেগম রোকেয়া যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন তা থেকেই তিনি অনুভব করেন নারী জাগরণ ব্যতীত নারীদের উন্নতি ঘটানো সম্ভব নয়। তাই নারী আন্দোলনের উদ্দেশ্য নিয়ে ১৯১৬ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম বা মুসলিম মহিলা সমিতি। তখনকার দিনে মুসলমান মেয়েরা ঘরের কোণ ছেড়ে সভা-সমিতিতে যোগদান করবে—এটা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। কিন্তু বেগম রোকেয়া দিনের পর দিন ঘরে ঘরে গিয়ে তাদের বুঝিয়েছেন। হাত ধরে ধরে একেকজনকে ঘরের বাইরে এনেছেন। বেগম রোকেয়া সাহিত্য সাধনার কাল তিন দশক (১৯০৩-৩২০। তেইশ বছর বয়সে প্রথম আত্মপ্রকাশ (নিরীহ-বাঙালি নবনূর, মাঘ-১৩১০) থেকে মৃত্যুর আগের রাত পর্যন্ত (নারীর অধিকার, মাহেনও, মাঘ-১৩৬৪)। স্বামীর অকাল মৃত্যু, স্কুল পরিচালনা ও স্কুলের কাজে শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও তিনি সাহিত্যচর্চা ছাড়েননি। প্রকাশে বিরতি ছিল কিন্তু সৃষ্টিতে বা রচনায় ছিল না। বেগম রোকেয়ার জীবদ্দশাতেই তার পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। মতিচুর (প্রথম খণ্ড), প্রকাশকাল-১৯০৫ সাল, ঝঁষঃধহধ্থং উত্বধস, প্রকাশকাল-১৯০৮ সাল, মতিচুর (দ্বিতীয় খণ্ড) প্রকাশকাল-১৯২১ সাল, পদ্মরাগ, প্রকাশকাল-১৯২৪ সাল, অবরোধ বাসিনী, প্রকাশকাল-১৯২৮ সাল। মূলত প্রবন্ধ রচনা করলেও বেগম রোকেয়া কবিতা, উপন্যাস, গল্প, রম্য রচনা আর কিছু অনুবাদধর্মী লেখা লিখেছেন। আর সব রচনাতেই তার ব্যক্তিত্ব-চিহ্নিত। বাংলা, ইংরেজি ও উর্দু এ তিনটি ভাষাজ্ঞানকেই তিনি কাজে লাগিয়েছেন। বাংলায় তো লিখতেনই। ইংরেজিতে লিখেছেন ঝঁষঃধহধ্থং উত্বধস. ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন সুলতানার স্বপ্ন (স্বরচিত ঝঁষঃধহধ্থং উত্বধস-এর অনুবাদ), নারী সৃষ্টি (আংশিক অনুবাদ), ডেলিশিয়া হত্যা। (মূল রচনা : মিস মেরি করেলি)। উর্দু থেকে অনুবাদ নূর-ইসলাম (মিসেস অ্যানি বেশান্তের ইংরেজি প্রবন্ধের উর্দু অনুবাদের অনুবাদ), বেগম তরজির সহিত সাক্ষাত্, পরীবিবি ইত্যাদি। বুদ্ধিজীবী, লেখিকা ও কর্মী—এই তিনরূপে বেগম রোকেয়ার বিকাশ। যে নারী শিক্ষা ও নারী জাগরণের প্রয়োজনীয়তা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, তার স্বাক্ষর একদিকে তার স্কুল, অন্যদিকে তার চিন্তাশীলতা, যার প্রকাশ তার রচনাবলীতে বিধৃত। বেগম রোকেয়া ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর চলে গেলেন পরপারের ডাকে। তার বয়স হয়েছিল মাত্র ৫৩ বছর।

No comments

Powered by Blogger.