বিশেষ আকর্ষণ-হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার

মদাদুল হক মিলন : আপনি অনেক দিন ধরে বলছেন যে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনী আপনি লিখতে চান। সেই লেখার প্রস্তুতিটা কী রকম? হুমায়ূন আহমেদ : আমার প্রস্তুতির কথা বলব, কিন্তু এখানেও কিছু সমস্যা আছে। সমস্যা হলো দুই ধরনের। প্রথম সমস্যা হলো, আমার মধ্যে কিছু ছেলেমানুষি আছে তো...আমি যখন সব কিছু ঠিকঠাক করলাম, তখন একটা ঘটনা ঘটে। শুরু থেকেই বলি। বাংলাবাজারে অন্যপ্রকাশের একটি স্টল আছে।
স্টলটি উদ্বোধনের জন্য আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়। অনেক দিন পরে আমি বাংলাবাজারে গেলাম। স্টলের ফিটাটিতা কাটলাম। এক মাওলানা সাহেব প্রার্থনা করলেন। আমি খুবই অবাক হয়ে তাঁর প্রার্থনা শুনলাম। আমার কাছে মনে হলো, এটি বইপত্র সম্পর্কিত খুবই ভালো ও ভাবুক ধরনের প্রার্থনা। একজন মাওলানা এত সুন্দর করে প্রার্থনা করতে পারেন যে আমি একটা ধাক্কার মতো খেলাম। মাওলানা সাহেবকে ডেকে বললাম, 'ভাই, আপনার প্রার্থনাটা শুনে আমার ভালো লেগেছে।' মাওলানা সাহেব বললেন, 'স্যার, আমার জীবনের একটা বড় আকাঙ্ক্ষা ছিল আপনার সঙ্গে একদিন দেখা হবে। আল্লাহ আমাকে সেই সুযোগ করে দিয়েছেন। আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে।' আমি তাঁর কথা শুনে বিস্মিত হলাম। আমি বললাম, 'এই আকাঙ্ক্ষাটি ছিল কেন?' মাওলানা সাহেব বললেন, 'আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই কারণ আমি ঠিক করেছি, দেখা হলেই আপনাকে আমি একটা অনুরোধ করব।'
'কী অনুরোধ শুনি?'
'আপনার লেখা স্যার এত লোকজন আগ্রহ নিয়ে পড়ে, আপনি যদি আমাদের নবী করিমের জীবনীটা লিখতেন, তাহলে বহু লোক এই লেখাটি আগ্রহ করে পাঠ করত। আপনি খুব সুন্দর করে তাঁর জীবনী লিখতে পারতেন।'
মাওলানা সাহেব কথাগুলো এত সুন্দর করে বললেন যে আমার মাথার ভেতর একটা ঘোর তৈরি হলো। আমি তাঁর কাঁধে হাত রেখে বললাম, 'ভাই, আপনার কথাটা আমার খুবই মনে লেগেছে। আমি নবী করিমের জীবনী লিখব।' এই হলো ফার্স্ট পার্ট। চট করে তো জীবনী লেখা যায় না। এটা একটা জটিল ব্যাপার, কাজটা বড় সেনসেটিভ। এতে কোথাও একটু উনিশ-বিশ হতে দেওয়া যাবে না। লিখতে গিয়ে কোথাও যদি আমি ভুল তথ্য দিয়ে দিই, এটি হবে খুবই বড় অপরাধ। এটা আমাকে লেখা শুরু করতে বাধা দিল।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনি কি মহানবীর জীবনী লেখার কাজটা শুরু করেছিলেন?
হুমায়ূন আহমেদ : নাহ্, আমি লেখার কাজ শুরু করিনি। আমি অন্যদিন-এর মাসুমকে বললাম, 'তুমি একটা সুন্দর কাভার তৈরি করে দাও তো। কাভারটা চোখের সামনে থাকুক। তাহলে আমার শুরু করার আগ্রহটা বাড়বে।' মাসুম খুব চমৎকার একটা কাভার তৈরি করে দিল। বইটার নামও দিলাম_'নবীজী'। তখন একটা ছেলেমানুষি ঢুকে গেল মাথার মধ্যে। ছেলেমানুষিটা হলো, আমি শুনেছি বহু লোক নাকি আমাদের নবীজীকে স্বপ্নে দেখেছেন। কিন্তু আমি তো কখনো তাঁকে স্বপ্নে দেখিনি। আমি ঠিক করলাম, যেদিন নবীজীকে স্বপ্নে দেখব, তার পরদিন থেকে লেখাটা শুরু করব। স্বপ্নে এখন পর্যন্ত তাঁকে দেখিনি। যেহেতু এক ধরনের ছেলেমানুষি প্রতিজ্ঞার ভেতর আছি, সে কারণে লেখাটা শুরু করতে পারিনি। ব্যাপারটা হাস্যকর। তবু আমি স্বপ্নের অপেক্ষায় আছি।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনার প্রস্তুতি কী? মানে পড়াশোনা আর অন্যান্য...।
হুমায়ূন আহমেদ : আমার প্রস্তুতি ভালো। পড়াশোনা ভালোই করেছি। বইপত্র জোগাড় করতে পেরেছি। বন্ধুরাও বইপত্র সংগ্রহ করতে সাহায্য করেছেন। কাজেই এখন আমি বলতে পারি যে নবীর জীবনী লেখার জন্য আমার প্রস্তুতি যথেষ্ট হয়েছে।
ইমদাদুল হক মিলন : বাংলা ভাষায় হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর যেসব জীবনী লেখা হয়েছে, এর মধ্যে আপনার পছন্দের কোনটা?
হুমায়ূন আহমেদ : সত্যি কথা বলতে কি, আমার তেমন পছন্দের কোনো জীবনী নেই। জীবনীগুলোর মধ্যে ভক্তি চূড়ান্তভাবে বেশি। আমার লেখার মধ্যেও ভক্তি থাকবে। কিন্তু একটু অন্যভাবে থাকবে এবং আরো কিছু ব্যাপার থাকবে।
ইমদাদুল হক মিলন : ধানমণ্ডিতে আপনার বাড়িটা যখন করলেন, তখন আমি দেখেছি, আপনি একটা নামাজঘর করেছেন। নুহাশপল্লীতেও আপনি নামাজের জন্য আলাদা জায়গা রেখেছেন। এটা কোন চিন্তা থেকে করেছেন?
হুমায়ূন আহমেদ : নামাজঘর করার চিন্তাটা ধর্মীয় ভাব থেকে যতটা না এসেছে, তার চেয়ে বেশি এসেছে পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের বই পড়ে। তাঁদের বইয়ে দেখি, তাঁদের একটা ঠাকুরঘর আছে, পূজাঘর আছে। তাঁরা প্রতিটি বাড়িতে একটা অংশ আলাদা করে রাখেন উপাসনার জন্য। এই কাজটা আমরা করি না। আমাদের প্রার্থনার জন্য আলাদা জায়গা রাখি না। নামাজঘর বানাই না। আমি বানাতে চেয়েছি। আর নুহাশপল্লীতে আমি নামাজের জায়গাটা করেছি আমার মায়ের জন্য। একটা খোলা মাঠে_লোকজন নেই, একটা গাছের নিচে বসে নামাজ পড়তে হয়তো বা তাঁর ভালো লাগবে_এ কথা মনে করেই শ্বেতপাথর বসিয়ে একটা জায়গা আলাদা করে দিয়েছি।
ইমদাদুল হক মিলন : এবার অন্য প্রসঙ্গে আসি। হুমায়ূন ভাই, আপনি তো বহু বিষয়ে আগ্রহী। এর মধ্যে আপনার একটি খুব প্রিয় বিষয় হচ্ছে ভূত; এবং বহু স্মরণীয় ভূতের গল্প লিখেছেন আপনি। আপনার ছোট ছোট অনেক অভিজ্ঞতার কথা জানি আমরা। এই ভূত ব্যাপারটা নিয়ে আপনার বিশ্বাসটা কী?
হুমায়ূন আহমেদ : বিশ্বাসটা হলো, আমি মনে করি না ভূত বলে কিছু আছে। ভূত না থাকলেও ভূতের ভয় আছে। ভূতের ভয় আছে বলেই ভূতের গল্প আছে।
ইমদাদুল হক মিলন : তাহলে কি বলব, আপনি বানিয়ে বানিয়ে লেখেন?
হুমায়ূন আহমেদ : গল্প-উপন্যাস মানেই কি বানানো বিষয় নয়? গল্প-উপন্যাস তো ইতিহাস নয়। তার পরও কিছু কিছু ব্যাপার ঘটেও যায়।
ইমদাদুল হক মিলন : কিন্তু ভূত আপনি বিশ্বাস করেন না। লেখেন, আবার বলছেন এমন ঘটনা ঘটে_বিষয়টা কী রকম?
হুমায়ূন আহমেদ : একটা উদাহরণ দিই। আমি তখন মুহসীন হলে থাকি। সেখানে একদিন রাতে আমার স্ত্রীর ঘুম ভাঙল। মাঝখানে বিপাশা, এক পাশে আমি আরেক পাশে সে। ঘুম ভাঙার পর সে খাট থেকে নামল। নামার সময় স্বামীর ওপর দিয়ে পার হওয়া যায় না_মেয়েদের একটা বিষয় থাকে না। তাই তাকে অনেক কষ্ট করে নিচে নামতে হলো, যাতে আমার গায়ের সঙ্গে পা লেগে না যায়। খাট থেকে নেমে সে দরজাটা খুলে বারান্দায় এল। বারান্দায় এসে দেখে আমি টেবিলে বসে লেখালেখি করছি। এটা দেখে সে চিৎকার দিয়ে উঠল। এই ঘটনাটা মাথায় রেখে আমি একটা ভূতের গল্প লিখেছি, নাম হচ্ছে 'দ্বিতীয়জন'।
ইমদাদুল হক মিলন : কিন্তু আসলে আপনি লিখছিলেন, না ঘুমাচ্ছিলেন?
হুমায়ূন আহমেদ : আমি লিখছিলাম।
ইমদাদুল হক মিলন : তার মানে ভাবির এ ব্যাপারটা ঘটেছে ঘুমের ঘোরে?
হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ, ঘুমের ঘোরে কিংবা হয়তো তার মাথার মধ্যে আছে যে এখানে একটা লোক ঘুমায়। এ বিষয়টার লৌকিক ব্যাখ্যা কিন্তু এটাই। তার মনের মধ্যে আছে আমি তার পাশে ঘুমাচ্ছি।
ইমদাদুল হক মিলন : আচ্ছা। কিন্তু আপনার নুহাশপল্লীতে কিছু ভৌতিক ঘটনার কথা শুনেছি। সেগুলোর ব্যাখ্যাটা কী? ঘটনাগুলোই বা কী?
হুমায়ূন আহমেদ : ঘটনাগুলো ভয়াবহ। কাজেই এ ঘটনাগুলো বলে লোকজনকে নতুন করে ভূতপ্রেতে বিশ্বাস করাতে আমি রাজি নই। প্রতিটি ঘটনার লৌকিক ব্যাখ্যা অবশ্যই আছে। আমরা বের করতে পারছি না। ব্যর্থতা আমাদের।
ইমদাদুল হক মিলন : না, আমরা আপনার অভিজ্ঞতার কথাটা জানতে চাই।
হুমায়ূন আহমেদ : ভালো ঝামেলায় পড়লাম! আচ্ছা ঠিক আছে, একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি, স্বপ্নবিষয়ক অভিজ্ঞতা। আমি প্রায়ই স্বপ্নে দেখতাম, আমি আর আমার মা একটা অদ্ভুত ঘরে বাস করছি। কেউ কারো সঙ্গে কথা বলতে পারছি না এবং ঘরের ভেতর ইয়েলো লাইট। দুজন থাকি খুব কাছাকাছি, কিন্তু কেউ কারো সঙ্গে কথা বলি না। আমি মাকে স্বপ্নের কথাটা বললাম। তিনি তো বুঝলেন না কেন স্বপ্নটা দেখি। তারপর একসময় ভাবলাম, হয়তো মৃত্যুর পর এক জায়গায় দেখা হবে দুজনের, সেটাই হয়তো দেখি। স্বপ্ন দেখার অনেক পরে আমাদের বাইপাস অপারেশনটা হলো_মা ও ছেলের একই সঙ্গে, সিঙ্গাপুরে আমাদের দুজনকে একই কেবিনে রাখা হলো। যদিও পুরুষ আর নারীদের আলাদা থাকার কথা। যেহেতু মাদার অ্যান্ড সন, তাই একত্রে রাখা হলো। অপারেশনের পর আমার যখন প্রথম জ্ঞান হলো, আমি তাকালাম এবং সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলাম যে এই ঘরটাই আমি দিনের পর দিন স্বপ্নে দেখেছি। এখানেও ছোট্ট ঘর, ইয়েলো লাইট, পাশাপাশি দুজন, কেউ কারো সঙ্গে কথা বলতে পারছি না। এর ব্যাখ্যাটা কী বলো?
ইমদাদুল হক মিলন : আমি আপনার ব্যাখ্যাটাই আসলে জানতে চাই। স্বপ্ন নিয়ে আসলে আপনার ব্যাখ্যাটা কী?
হুমায়ূন আহমেদ : আমার কোনো ব্যাখ্যা নেই। ব্যাখ্যা করার যোগ্যতাও নেই। সিগমন্ড ফ্রয়েড যৌনতা স্বপ্নের মূল_এই ব্যাখ্যা করেছেন। সেই ব্যাখ্যা খুব গ্রাহ্য হয়েছে বলে মনে হয়নি। তাঁরই ছাত্র অধ্যাপক জাংক গুরুর সঙ্গে একমত ছিলেন না। তিনি অনেক গবেষণা করেছেন প্রিক্যানিশন ড্রিম নিয়ে। প্রিক্যানিশন ড্রিম হলো স্বপ্নে ভবিষ্যৎ দেখে ফেলা।
এ রকম গল্প তো প্রায়ই শোনা যায়_নিকটাত্মীয় মারা গেছে, মৃত্যুর সময় সে স্বপ্নে দেখা দিয়ে প্রিয়জনদের বলেছে_আমি চলে যাচ্ছি_তোমার কাছ থেকে বিদায় নিতে এসেছি। এসব ঘটনার কি ব্যাখ্যা আছে?
ইমদাদুল হক মিলন : ধর্মীয় ব্যাখ্যা কি আছে?
হুমায়ূন আহমেদ : থাকতে পারে, আমি বলতে পারছি না। বড় আলেমরা বলতে পারবেন। আত্মার মৃত্যু নেই_এটি সব ধর্মই বলছে। আত্মাটা কী তা কিন্তু তেমনভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে না। পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক আত্মাকে বলেছেন ঙৎফবৎ ড়ভ ড়েফ. আত্মা হলো আল্লাহর আদেশ। এর মানে আমার কাছে পরিষ্কার নয়। [চলবে]

No comments

Powered by Blogger.