টিপাইমুখ ড্যামঃ ভারতের সামরিক প্রকল্প by প্রকৌশলী এসএম ফজলে আলী

তদিন আমরা টিপাইমুখ ড্যামের কারণে ভারতের মনিপুর, ত্রিপুরা ও মিজোরাম এবং বাংলাদেশের যেসব সমস্যা হবে তা নিয়ে বহু লেখালেখি, মিডিয়ায় টকশোতে তা বলে এসেছি। বাংলাদেশে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চল মারাত্মক পরিবেশগত পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, সে বিষয়েই জোর দেয়া হয়েছে।
ড্যাম ও ব্যারেজের কারণে বরাক নদীর নিম্নভাগে বাংলাদেশের সুরমা ও কুশিয়ারায় পানি থাকবে না, জীববৈচিত্র্য নষ্ট হবে, জলজপ্রাণী ধ্বংস হবে, নদীর নাব্য হারাবে, সমুদ্রের লবণাক্ত পানি ভৈরব অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে যাবে, ওই অঞ্চলের হাওর-বাঁওড় সব শুকিয়ে যাবে, পুরো এলাকায় মরুকরণ শুরু হবে এবং ফসলের উত্পাদন শূন্যের কোটায় পৌঁছবে। আর ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা বলে যে কোনো মধ্যমানের ভূমিকম্প হলে ড্যাম অবশ্যই ধ্বংস হবে। তাতে মনিপুরসহ বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যে ধ্বংসলীলা হবে তা সুনামিকে ছাড়িয়ে যাবে। এ সবই বাস্তবতার দিক দিয়ে ঠিক। কিন্তু এর সঙ্গে যে তথ্যটি বর্তমানে আমাদের কাছে পৌঁছেছে তাতে ওসব বিষয় ছাড়াও ভারতের টিপাইমুখ ড্যাম নিয়ে আরও রহস্য রয়েছে।
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের এমন কোনো প্রয়োজন পড়েনি যে মাত্র ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য মনিপুরের বরাক নদীতে ড্যাম তৈরি করবে। এর আসল কারণ এই সাত কন্যার সামরিক গুরুত্বের জন্য এ ড্যাম তৈরি হতে যাচ্ছে। জলবিদ্যুত্ ও সেচ কাজের কথা বলা হলেও ভারত তার দেশের সম্পূর্ণ সামরিক কৌশলগত কারণে টিপাইমুখ ড্যাম তৈরি করতে যাচ্ছে। ড্যামটি নির্মাণের সব ধরনের দায়িত্ব বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকার সামরিক বাহিনীর হাতে ন্যস্ত করেছে এবং বর্তমানে ড্যামের পুরো এলাকাই ভারতের সামরিক বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের অধীন। ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের পর ইস্টার্ন কমান্ডের সৃষ্টি। ইস্টার্ন কমান্ড ইতোমধ্যে ড্যামের থ্রিডায়মেনশন অর্থাত্ জরিপ, প্লানিং ও ডিজাইনের কাজ শেষ করে ফেলেছে। জানা গেছে, বাঁধ নির্মাণের দায়িত্ব নর্থ-ইস্ট ইলেক্ট্রিক পাওয়ার কর্পোরেশনের (নিপকো) হলেও এর কোনো পরিকল্পনা ও ডিজাইন তাদের হাতে নেই। এর পুরো দায়িত্ব নিয়েছে ইস্টার্ন কমান্ড। ড্যাম নির্মাণ সংক্রান্ত পুরো বিষয়টি এখন ইস্টার্ন আর্মি কমান্ডের মিলিটারি ডকট্রিনের আওতায়। ইস্টার্ন আর্মি কমান্ডের শিলচরের বেইজ কমান্ড এখন এটা নিয়ন্ত্রণ করছে।
১৯৯৭ সালে এই ড্যামের ওপর একটি টেরেন স্টাডি ইস্টার্ন-আর্মি কমান্ড সেরে ফেলেছে। তারা ইতোমধ্যে সম্পূর্ণ ইকোলজিক্যাল সার্ভে শেষ করেছে। ডিজিটাল সার্ভেসহ অ্যারোপ্লেন পিকচার নেয়ার কাজও শেষ করেছে। মনিপুরের জয়েন্ট অফিসার কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার সাকসেনা এখন এই ড্যাম এলাকার সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে আছেন।
অপরদিকে এ ধরনের একটি ড্যাম নির্মিত হলে সিভিল-আর্মি সম্পর্ক কী ধরনের হতে পারে তা নিয়ে নয়াদিল্লিতে উচ্চপর্যায়ের একটি বৈঠক বিগত ২০ জুন হয়। এতে বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার ভারত ভাবাপন্ন বিধায় এই সরকারের আমলেই যাতে ড্যামের কাজ শুরু করা যায় তার তাগিদ দেয়া হয়। তাছাড়া এ নিয়ে দুই দেশের সুশীল সমাজের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এখানে সুশীল সমাজ বলতে ভারতমুখী সুশীলদের বোঝানো হয়েছে। ড্যাম নির্মাণের পক্ষের লোকদের নিয়ে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করার জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়েছে একটি বিশেষ গ্রুপকে। এতে উভয় দেশের সমমনা সুশীলরাই যোগ দেবে। এদের দ্বিতীয় ফ্রন্ট হিসেবে ব্যবহার করা হবে। এ ধরনের একটি বৈঠক গত ৩ এপ্রিল দিল্লিতে হওয়ার কথা ছিল। ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশের পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ভারতের সামরিক বাহিনী বিশেষ করে ইস্টার্ন কমান্ডের অনেক অফিসার যোগ দিতে না পারায় সে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। প্রথমে ব্রহ্মপুত্র বোর্ডের অধীনে টিপাইমুখ ড্যাম নির্মাণের কথা ছিল। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত পাল্টিয়ে ড্যাম নির্মাণের দায়িত্ব নর্থ-ইস্টার্ন ইলেক্ট্রিক পাওয়ার কর্পোরেশনকে দেয়া হয়। তা আবার পরিবর্তন করে মনিপুরের প্রাদেশিক সরকারের মালিকানাধীন ন্যাশনাল হাইড্রো-ইলেক্ট্রিক পাওয়ার কর্পোরেশনের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। এটা সামরিক কৌশলগত কারণে করা হয়েছে। কারণ, কোম্পানিটি সরকারের হওয়ায় ভারতের সামরিক বাহিনী তাদের মত মোতাবেক এটা চালাতে পারবে।
অন্য আরেকটি সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর ২২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আসামের জোড়হাটে সামরিক বাহিনীর যৌথ মহড়ায় এই ড্যাম নির্মাণের ব্যাপারে ইস্টার্ন কমান্ডের সম্পৃক্ততা নজরে আসে। সেই যৌথ মহড়ায় নকশা এঁকে উভয় দেশের সেনা কর্মকর্তাদের বোঝানো হয় যে, এই স্থানে ড্যাম নির্মাণ হতে যাচ্ছে। আর এ কারণে সংশ্লিষ্ট এলাকাটি জলমগ্ন হবে। এলাকাটি জলমগ্ন হলে কী ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদীর উদ্ভব হবে তাও উল্লেখ করা হয়। সে পরিস্থিতি ভারত ও বাংলাদেশকে কীভাবে মোকামেলা করতে হবে, তাও বিশদভাবে বোঝানো হয়। বিচ্ছিন্নবাদীরা ভিন্ন কৌশলে তত্পরতা চালাতে পারে, তাও বাংলাদেশকে অবহিত করা হয়। এতেই বাংলাদেশের সামরিক কর্মকর্তারা স্পষ্ট বুঝে যান যে, ভারত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করবেই। এ বাঁধ নির্মাণের ফলে ২৮৮.৬০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা পানিতে ডুবে যাবে। ফলে লাখ লাখ লোক বাস্তুচ্যুত হবে। ঘর-বাড়ি ও জমিহারা এই লোকগুলো যে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টে পড়বে সে ব্যাপারে কোনোকিছুই উল্লেখ করা হয়নি। সামরিক দিক থেকে জলমগ্ন এলাকায় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মোকাবেলায় ভিন্ন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হবে। কারণ, ইস্টার্ন কমান্ডের পক্ষে ঘনবনাঞ্চল ঘেরা এলাকাটিতে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মোকাবেলা করা দুরূহ হড়ে পড়বে। বাংলাদেশের সেনা কর্মকর্তারা কাপ্তাই ড্যামের ফলে উদ্ভূত যে দুঃসহনীয় পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে পড়তে হয়েছে, তা ভারতীয় সেনা কর্মকর্তাদের জানান। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পুরো এলাকা অস্থিতিশীল করে রেখেছে। তারা ভারতীয় বর্ডার অতিক্রম করে আশ্রয় নেয়ার ফলে দুই দেশের সীমান্ত এলাকাও অস্থিতিশীল হতো। রাজনৈতিক কারণে ভারত তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিত এবং তাদের সামরিক ট্রেনিংও দিত। তারা এখনও বাংলাদেশের এক-দশমাংশ এলাকা অস্থিতিশীল করে রাখছে। তাই টিপাইমুখ ড্যাম হলে এ ধরনের পরিস্থিতি মনিপুর, মিজোরাম ও আসামেও হতে পারে। তা ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য সুখকর হবে না।
এ দুর্গম এলাকায় এ ধরনের ড্যাম নির্মাণের ভারতের আসল উদ্দেশ্য ভারতের পূর্বাঞ্চলে শক্ত সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ। ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের পর চীন অরুণাচল প্রদেশটিকে তিব্বতের অংশ বলে দাবি করে আসছে। ভারতের ভয় কোনো এক সময় হয়তো চীন হিমাচল অঞ্চলের মতো এই প্রদেশটিও দখল করে নিতে পারে। তাই এখানকার সামরিক শক্তি বৃদ্ধির ব্যবস্থা করছে। তার অংশ হিসেবেই এই টিপাইমুখ বাঁধ ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। আসলে চীনের সঙ্গে ভারত এ সমস্যার সামরিক সমাধান করতে পারবে না। তার উচিত বিরোধটির রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করা। ভারত কখনও চীনের শক্তির সমকক্ষ হতে পারবে না। ওদিকে এ ড্যাম তৈরি হলে স্থানীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উসকিয়ে দেবে। তখন ভারতের পুরো পূর্বাঞ্চল অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে। আর এদিকে বাংলাদেশের মহাক্ষতি করে ছাড়বে। ভারত ফারাক্কা ব্যারাজ দিয়ে বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল মরুকরণের দিকে ঠেলে দিয়েছে। তারা টিপাইমুখ বাঁধ করে আরেক মরণ ফাঁদ তৈরি করবে বাংলাদেশের জন্য। এ বাঁধের ফলে দেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এলাকা পানিশূন্য হবে। সুনামির ঝুঁকিতে থাকবে। এসব বিষয় ভারতকে পুনরায় ভেবে দেখতে হবে। এ অঞ্চলে চীনকে ঠেকাতে গিয়ে ভারত যা করতে যাচ্ছে তার জবাবে চীন ব্রহ্মপুত্র নদের পানি পুরোটা প্রত্যাহার করে নেয়ার পরিকল্পনা করছে। মানস সরোবর থেকে ব্রহ্মপুত্র নদের উপরে যে সানগো নদী, তাতে চীন বিরাট ড্যাম করে সে পানি পুরোটা ব্যবহারের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ভারতের উচিত বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানকে সঙ্গে নিয়ে সে ব্যাপারে চীনের সঙ্গে দেনদরবার করে মেকং নদীর মতো একটা সমাধানে আসা। মেকং নদীর পানি এখন কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস ও থাইল্যান্ড সমতার ভিত্তিতে ব্যবহার করছে।

No comments

Powered by Blogger.