লো ক জ বা হ ন-উহুম্ না-রে-উহুম্ না...

'হুম্ না-রে-উহুম্ না...' কণ্ঠে এমন সুর তুলে সবুজ-শ্যামল গ্রামের পথ দিয়ে হেঁটে চলছে বেহারার দল। কাঁধে পালকি। বাঙালির হাজার বছরের লোক সংস্কৃতির স্রোতোধারায় আজও মিশে আছে বাহনটি। এটি কয়েক যুগ আগেও আমাদের গ্রামাঞ্চলে দেখা যেত। বাহন হিসেবে পালকি ব্যবহৃত হতো জমিদার-জোতদার থেকে শুরু করে রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের যুবতী, নববিবাহিত ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াতের জন্য।


গ্রামে বিয়ে হচ্ছে, অথচ পালকি নেই_ এটা একসময় ভাবাই যেত না। বিয়ের আসরে পালকির উপস্থিতি ছিল অবশ্যম্ভাবী। পালকি শুধু বর-বধূকে আনা নেওয়ার বাহন হিসেবেই ব্যবহৃত হতো না, বিয়ের অনুষ্ঠানকে আলাদা মর্যাদা দিতেও এটির প্রয়োজন হতো।
পালকি শব্দটি এসেছে সংস্কৃত পল্যঙ্ক বা পর্যঙ্ক থেকে। তবে পালি ভাষায় এটিকে পালাঙ্কো, তামিলরা বেড বা কোচ বলে থাকে। বাংলা, হিন্দি ও তেলেগু ভাষীদের কাছে এটি পালকি নামেই পরিচিত। ফারসিতে বাহনটি 'পালকী' নামে পরিচিত। একসময় গ্রাম বাংলার নিত্যদিনের বাহন ছিল পালকি। যানবাহন উন্নয়নের ফলে এবং আনুষঙ্গিক কারণে আমাদের দেশের এককালের এই ঐতিহ্যবাহী বাহনটি আর তেমন দেখা যায় না। নববধূ এতে চড়ে আর যায় না শ্বশুরবাড়ি। প্রযুক্তির ব্যাপক আগ্রাসনের ফলে ঐতিহ্যবাহী এ বাহনটি কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে চলেছে।
আমাদের দেশে কখন, কীভাবে, কার মাধ্যমে প্রথম পালকি ব্যবহারের প্রচলন ঘটে, এ প্রশ্নের মীমাংসা করা আজও সম্ভব হয়নি। এ ব্যাপারে লিখিত কোনো প্রমাণ না থাকায় বিষয়টি ক্রমে জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে বোধগম্য কারণেই আমরা এ কথা ধরে নিতে পারি, অতি প্রাচীনকাল থেকেই পালকি আমাদের দেশে বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
জানা যায়, প্রাচীনকালে জনসাধারণ বিশেষ করে উচ্চ শ্রেণীভুক্ত ব্যক্তিরা রাস্তাঘাট ভালো না থাকায় যাতায়াতের জন্য পালকি ব্যবহার করতেন। জমিদাররা তাদের জমিদারি দেখভাল অথবা রাজস্ব সংগ্রহ ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য পালকি বাহন হিসেবে ব্যবহার করতেন। সে সময় এটিকে দেখা হতো আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে।
পালকির আকার অনেকটা বাক্সের মতো। উপরিভাগ টিন অথবা কাঠ দিয়ে গোল করে ছাওয়া। পালকির মধ্যে যাত্রী বসার জন্য দেড় ফুট চওড়া, তিন ফুট লম্বা এবং আড়াই ফুট উঁচু করে চারপাশে শক্ত কাঠ দিয়ে তৈরি একটি আসন থাকে। পালকির মালিকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলত কার পালকিতে কে কত বেশি কারুকাজ করতে পারে। তেমনি আবার প্রতিযোগিতা ছিল কোন বাহক বা বেহারা ভালো শ্লোক গাইতে পারবে। এই পালকির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হলো বেহারারা। পালকি চালক এই বেহারাদেরকে সমাজে তেমন মর্যাদার চোখে দেখা হয় না। সচরাচর কেউ বেহারা হতেও চায় না। সাধারণ বেহারার খাতায় নিম্নশ্রেণির ব্যক্তিরাই নাম লেখাত। জমিদারের সন্তুষ্টির জন্য বেগার খাটা ব্যক্তিরাই প্রথমে পালকি বহন করত। ক্রমে এদের মধ্য থেকেই সৃষ্টি হয় পালকি বেহারা গোষ্ঠী।
তারা পালকি বহনের সময় সুখ-দুঃখের নানা ধরনের গান গাইত। গানের তালে তালে তারা পা ফেলত বন্ধুর কিংবা সরল পথে। বেহারারা অত্যন্ত কৌশলের সঙ্গে পালকির ভারসাম্য রক্ষা করে পথ চলত। বলা যায়, এ গান ছিল বেহারাদের ক্লান্তি মোচনের পক্ষে বিশেষ সহায়ক। পালকি বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে বেহারারাও বাধ্য হয়ে সমাজের ছোটখাটো পেশায় নিজেদের নিয়োজিত করছে। অনেকে আবার বাপ-দাদার পেশাকে শত দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও আঁকড়ে ধরে আছে। তবে তাদের সংখ্যা খুবই কম। এখন আর পথ চলতে যেখানে-সেখানে পালকির সন্ধান পাওয়া যায় না। কালেভদ্রে দু-একটা পালকি চোখে পড়লেও কেউ তাতে আর তেমন পুলকিত বোধ করে না।
বর্তমানে আধুনিক সমাজের কেউ-ই এখন আর পালকি চড়ার ইচ্ছে ব্যক্ত করে না। তাদের চিন্তা চেতনা, ধ্যান-ধারণা ঘিরে আছে কেবল প্রাইভেট কার। পালকি চড়া এখন রীতিমতো বিলাসিতার শামিল। ফলে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী এ বাহনটির এখন স্থান হয়েছে বিভিন্ন জাদুঘরে।
হাসান মাহমুদ রিপন

No comments

Powered by Blogger.