শেয়ার বাজার-তবুও পতন by নাজমুল আলম শিশির

রকারের গুচ্ছ প্রণোদনা ঘোষণার পরও বড় ধরনের পতন হলো শেয়ারবাজারে। গতকাল রবিবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সূচক ৩০৮ হ্রাসের পর বিনিয়োগকারীদের অনেকেই অভিযোগের আঙুল তুলছে ৩০ শতাংশের কম শেয়ার হাতে থাকা কম্পানির পরিচালকদের দিকে।এসইসির ঘোষণা অনুযায়ী সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণের শর্ত পূরণের জন্য কম্পানি পরিচালকরা শেয়ার কিনবেন, শেয়ারবাজার চাঙ্গা হবে_এমনটিই ধারণা ছিল


সাধারণ বিনিয়োগকারীদের। কিন্তু গতকাল ঘটেছে তার উল্টো। যে ৪৬টি কম্পানির পরিচালকের ৩০ শতাংশের নিচে শেয়ার রয়েছে, তার সব কয়টিরই দাম পড়ে গেছে গতকাল। সকাল থেকে সূচক ও দামের পতন দেখে হাতের শেয়ার ছেড়ে দেওয়ার প্রতিযোগিতায় নামে অনেক বিনিয়োগকারী। এতে পতনের ধারাই ত্বরান্বিত হয়।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মতে, বর্তমানে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৪৬টি কম্পানি আছে, যাদের পরিচালকদের ৩০ শতাংশের কম শেয়ার আছে। এর মধ্যে গতকাল দুলামিয়া কটন এবং মুন্নু জুট স্টাফলারসের লেনদেন হয়নি। আর লেনদেন হওয়া বাদবাকি সব শেয়ারের দাম কমেছে কাল।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) একটি সূত্রে জানা যায়, যেসব কম্পানির পরিচালকরা সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করছেন কিন্তু এককভাবে ২ শতাংশ শেয়ারও হাতে রাখেননি, এমন কম্পানির সংখ্যা ১০০ টিরও বেশি। এসব কম্পানির পরিচালকরা এর আগে শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা তুলে নিয়েছেন। এসইসির বুধবারের ঘোষণায় বিপাকে পড়ে তাঁরা কারসাজিতে জড়িয়ে পড়ছেন বলে অভিযোগ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের। তাদের মতে, কম্পানিগুলোর পরিচালকরা নিজেদের বেনামে থাকা শেয়ার ইচ্ছে করেই কম দামে বিক্রি করছেন। দাম কমিয়ে পরবর্তী সময়ে নিজেরাই সেই শেয়ার কেনার পাঁয়তারা করছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. সালাউদ্দিন আহমেদ খান বলেন, শোনা যাচ্ছে যেসব পরিচালকের হাতে ৩০ শতাংশের কম শেয়ার রয়েছে, তাঁরাই গতকাল দরপতনে ভূমিকা রেখেছেন। বিষয়টি সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) সার্ভেইলেন্সে ধরা পড়বে। এ বিষয়ে এসইসিকে আরো কঠোর হতে হবে।
চট্টগ্রামের হাসান শেয়ারস অ্যান্ড সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অ্যাডভোকেট আনোয়ার হোসাইন বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী যেখানে উদ্যোগী হয়েছেন সেখানে কারা এভাবে পতন ঘটাচ্ছে? এসইসি যে তদারকি কমিটি করেছে তাদের ভূমিকা কোথায়? একটা পক্ষ গুজব ছড়াচ্ছে প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়িত হবে না। গুজব যে মিথ্যা তা এসইসির ক্লিয়ার করা উচিত। প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগও যদি ব্যর্থ হয়ে যায় তাহলে এই বাজারকে আর দাঁড় করানো যাবে না।' তিনি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সমালোচনা করে বলেন, 'গতকালের বাজারে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে খুব বেশি কার্যকর দেখা যায়নি।'
৩০ শতাংশ শেয়ারের কোটা পূরণে পূবালী ব্যাংকের পরিচালকদের আরো ১২ কোটি ৭৫ লাখ ৭৮ হাজার ৭৪২টি শেয়ার আগামী ছয় মাসের মধ্যে বাজার থেকে কিনতে হবে। মাসে ২২ কার্যদিবস ধরলে প্রতিদিন গড়ে ব্যাংকটির পরিচালকদের কিনতে হবে ছয় লাখ ৬৬ হাজার ৫০৬টি শেয়ার। ফলে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা আশায় ছিল, ব্যাংকটির পরিচালকদের বিপুল পরিমাণ শেয়ার কেনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দাম বাড়বে। তবে গতকাল শেয়ারের দাম তো বাড়েইনি, বরং আগের দিনের চেয়ে কমে গেছে। গত বৃহস্পতিবার পূবালী ব্যাংকের প্রতিটি শেয়ার ৫২.৪০ টাকা বিক্রি হলেও গতকাল তা কমে ৪৭.৩০ টাকায় হাতবদল হয়েছে। ফলে এক দিনের ব্যবধানেই পূবালী ব্যাংকের শেয়ারের দাম কমেছে ৫.১০ টাকা।
বেনামে থাকা শেয়ার বাজারে ছাড়ার মাধ্যমে প্যানিক সেল বা আতঙ্কজনিত বিক্রি উসকে দিয়ে শেয়ারের দাম কমিয়ে পরে নিজেদের নামে কিনে কোটা পূরণের ছল-চাতুরির সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি বাজার বিশ্লেষকরাও। তাঁরা আরো বলেছেন, শুধু ঘোষণা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করা যাবে না। নির্দেশনা যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না এসইসিকে তা কঠোরভাবে তদারকি করার তাগিদ দিতে হবে। তা না হলে সরকারের উচ্চপর্যায়ের তত্ত্বাবধানে শেয়ারবাজার স্থিতিশীল করার যে ব্যাপক উদ্যোগ তাও ব্যাহত হতে পারে।
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সভাপতি ফখর উদ্দিন আলী আহমেদ বলেন, যদি কেউ কোনো অনিয়ম করে, তবে সেটা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দেখা দরকার এবং সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তবে তিনি বলেন, পরিচালকরা চাইলেই শেয়ার কিনতে পারবেন না। এ জন্য তাঁদের পরিচালনা পর্ষদেও অনুমোদন নেওয়া প্রয়োজন। এর জন্য তাঁদের কিছু সময় দিতে হবে। সিএসই সভাপতি বলেন, উচিত ছিল পতন ঠেকাতে কারো হাল ধরা। কিন্তু সেটা দেখা যায়নি। প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে প্রণোদনা ঘোষণার পর বাজারে কিছুটা আস্থা ফিরেছে। কিন্তু এভাবে আবার পড়তে থাকলে সেই আস্থা একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে।
সাঈদ চৌধুরী নামের এক বিনিয়োগকারী বলেন, কম্পানির পরিচালকরা ইচ্ছে করেই কম দামে শেয়ার বিক্রি করে বাজারকে ফেলে দিচ্ছেন। পরে তাঁরা নিজেরাই এ শেয়ার কম দামে কিনবেন। তাঁর মতে, সূচকের ওপর সার্কিট ব্রেকার দিয়ে দেওয়া প্রয়োজন, যাতে ইচ্ছে করলেই কেউ কম দামে শেয়ার বিক্রি করতে না পারে। নজরুল ইসলাম নামের অন্য এক বিনিয়োগকারী বলেন, এত দিন পরিচালকরা ইচ্ছে করেই বেনামে শেয়ার ধারণ করতেন। এখন যখন নিজেদের নামে শেয়ার কিনতে হবে তখন তাঁরা সেই বেনামের শেয়ারগুলো কম দামে বিক্রি করছেন।
পরিচালকদের শেয়ার কেনার বাধ্যবাধকতা থাকায় যেখানে বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি না করে ধরে রাখবে, সেখানে গতকাল উল্টোটা ঘটছে। বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছে। এর কোনো কারণ জানা নেই বিনিয়োগকারী আকতারুজ্জানের। নিজের বিক্রির সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করিয়ে তিনি বলেন, পুরো পাতিলের ভাত দেখার প্রয়োজন নেই, একটা দেখলেই বোঝা যায় ভাত শক্ত না নরম।
ইমরান নামের আরেক বিনিয়োগকারী বলেন, পরিচালকদের ছয় মাসে শেয়ার কিনতে হবে। তাঁরা আগে দাম ফেলে পরে কম দামে সেই শেয়ার আস্তে আস্তে কিনবেন।
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের তদন্ত প্রতিবেদনে যাঁদের বিষয়ে সাবধান হওয়ার জন্য বলা হয়েছিল, যাঁদের কাছ থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল, তাঁরাই যদি বিভিন্ন পরিচয়ে বাজারে সক্রিয় থাকেন এবং কলকাঠি নাড়ান, তাহলে বাজার ঠিক হবে কী করে_সেই প্রশ্ন করেন আজাদ রহমান নামের অন্য এক বিনিয়োগকারী।
এসব দীর্ঘ মেয়াদে বাজার স্থিতিশীল করার গুচ্ছ ঘোষণার সত্যিকারের বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে আশফাকুর রহমান চৌধুরী নামের এক বিনিয়োগকারী বলেন, হাজার কোটি টাকা যাঁরা বাজার থেকে তুলে নিয়েছেন তাঁরা আবারও সক্রিয় হচ্ছেন।

No comments

Powered by Blogger.