সেনা ছাড়া নির্বাচন নয়-খুলনায় জনসভা, যশোরে পথসভায় খালেদা জিয়া by মোশাররফ বাবলু ও কৌশিক দে,

বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া বলেছেন, সেনাবাহিনী ছাড়া কোনো নির্বাচন নয়। আগামী নির্বাচন সেনাবাহিনীর মাধ্যমেই হতে হবে। কোনো দলীয় সরকারের অধীনে এ দেশে নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না। গতকাল রবিবার সকালে যশোরে পথসভায় তিনি এ কথা বলেন। পরে সন্ধ্যায় খুলনা সার্কিট হাউস ময়দানে জনসভায় খালেদা জিয়া বলেন, 'রোডমার্চে মানুষের চোখে আমি প্রতিরোধের আগুন দেখেছি। সরকারের বিরুদ্ধে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। আগামী


দিনে গণবিস্ফোরণের মাধ্যমে এই সরকারের পতন ঘটানো হবে।' তিনি আরো বলেন, ডা. মিলন হত্যাকারী এরশাদকে পাশে নিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা এবং তাঁকে বিরোধী দলের নেতা বানানোর স্বপ্ন পূরণ হবে না।
খুলনা অভিমুখে রোডমার্চের শেষ দিনে খুলনার সার্কিট হাউস ময়দান এবং যশোরের ঈদগাহে পথসভায় বক্তব্য দেন বিএনপির চেয়ারপারসন। গত শনিবার ঢাকা থেকে খুলনা অভিমুখে রোডমার্চ শুরু করেন তিনি। ওই দিন যশোর সার্কিট হাউসে রাত কাটান। সেখান থেকে গতকাল সকাল সাড়ে ১১টায় খালেদা জিয়িা যশোরের ঈদগাহে পেঁৗছালে দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মী-সমর্থক তুমুল করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানান তাঁকে।
যশোর থেকে খুলনা অভিমুখে রাজারহাট, রূপদিয়া বাজার, বসুন্দিয়া, প্রেমবাগ, চেগুটিয়া, নওয়াপাড়া, ফুলতলা ও দৌলতপুরে সড়কের দুই পাশে হাজার হাজার নারী-পুরুষ দাঁড়িয়ে ফুল ছিটিয়ে খালেদা জিয়াকে শুভেচ্ছা জানায়। পাজেরো জিপ থেকে হাত নেড়ে তিনি কর্মীদের শুভেচ্ছার জবাব দেন। যশোর-খুলনা সড়কের বিভিন্ন স্থানে কয়েক শ তোরণ নির্মাণ করা হয়। বাগেরহাটে হজরত খানজাহান আলী (রহ.) মাজার জিয়ারত করে সরাসরি খুলনা সার্কিট হাউসে পেঁৗছান বিএনপি নেত্রী। দুপুরের খাবার ও বিশ্রামের পর সার্কিট হাউস ময়দানে চারদলীয় জোট আয়োজিত জনসভায় বক্তব্য দেন তিনি। সকাল থেকেই সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, গোপালগঞ্জ, যশোরসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দলীয় নেতা-কর্মীরা সমবেত হন খুলনার জনসভাস্থলে। বিকেল সোয়া ৪টায় খালেদা জিয়া মঞ্চে উঠলে দলের নেতা-কর্মীরা স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করে তোলেন পুরো এলাকা। জনসভা শেষ পর্যন্ত জনসমুদ্রে পরিণত হয়।
লাখো মানুষের উপস্থিতি দেখে প্রধানমন্ত্রী দিশেহারা : সরকারের কঠোর সমালোচনা করে খালেদা জিয়া বলেন, 'দেশের মানুষ চায় স্বৈরাচারী সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে সত্যিকারের জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত করতে। এ জন্য যে কয়েকটি রোডমার্চ করেছি, তাতে লাখো মানুষের ঢল নেমেছিল। লাখো মানুষের উপস্থিতি দেখে প্রধানমন্ত্রী দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। কাগজ-কলম নিয়ে রোডমার্চের গাড়ির নম্বর হিসাব করছেন। প্রধানমন্ত্রী কাঁচি নিয়ে বসে আছেন, বিদ্যুৎ নিয়ে যারা কথা বলবে, তাদের বাড়ির লাইন কেটে দেবেন। প্রধানমন্ত্রী মূলত দেশের সমস্যা সমাধানে নয়, গাড়ির হিসাব, কার বিদ্যুতের লাইন কাটবে, কাকে বাড়ি থেকে বের করবে, তা নিয়ে ব্যস্ত।'
তিন বছরে সরকার কোনো কাজ করেনি : সরকার খুলনার কোনো উন্নয়ন করেনি বলে দাবি করেন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, 'এ অঞ্চলের কোনো রাস্তাঘাটের উন্নয়ন হয়নি। গত তিন বছরে এ সরকার কোনো কাজ করেনি। এ সরকার বলে, তারা নাকি উন্নয়ন করে ভাসিয়ে দিয়েছে। আমি বলব, তারা দুর্নীতির উন্নয়ন করে নিজেরা টাকা বানিয়েছে।'
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে শেয়ারবাজারে ধস নামে : বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, 'আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় আসে, তখনই শেয়ারবাজারে ধস নামে। ১৯৯৬ সালে একই অবস্থা হয়েছিল। কিন্তু বিএনপি সরকারের সময় এটা হয়নি। সরকারের বড় বড় লোক শেয়ারের টাকা নিয়েছে। তদন্ত হয়েছে। অর্থমন্ত্রী ভয়ে নাম প্রকাশ করেননি। কারণ অনেকের নাম বেরিয়ে আসবে।' তিনি বলেন, 'মইন উদ্দিন-ফখরুদ্দীন এ দেশকে যতটা পিছিয়ে দিয়েছিল, এই সরকার আসার পর আরো পিছিয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ নির্বাচনের আগে বলেছিল, ক্ষমতায় গেলে ১০ টাকা কেজিতে চাল খাওয়াবে। ঘরে ঘরে চাকরি দেবে। কিন্তু দেশের মানুষ কিছুই পায়নি, বরং চাকরি থেকে ছাঁটাই হয়েছে। অভিজ্ঞদের ওএসডি করা হয়েছে। ৪৮০ জনকে ওএসডি করে রেখেছে। অথচ নিজেদের দলীয় লোকদের দুইটা, তিনটা করে প্রমোশন দেওয়া হয়েছে।'
বিচার বিভাগ ও সামরিক বাহিনীতেও দলীয়করণ : সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিচার বিভাগ, প্রশাসন, পুলিশ ও সামরিক বাহিনীতেও দলীয়করণ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে যাঁদের ছাঁটাই করা হয়েছে, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তাঁদের সবাইকে চাকরি ফিরিয়ে দেওয়া হবে। যাঁদের অন্যায়ভাবে প্রমোশন দিয়েছে, তাঁদের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হবে।
সরকার দুর্নীতিবাজ : খালেদা জিয়া বলেন, এ সরকার দুর্নীতিবাজ, লুটেরা, তাঁবেদার ও মিথ্যাবাদী। তারা লুটপাট নিয়ে ব্যস্ত। ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে গিয়েই দুর্নীতি করছে। সব দল নিষিদ্ধ করে বাকশাল করার চিন্তাভাবনা করছে এ সরকার। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর তারা ৪০ হাজার মানুষকে হত্যা করেছিল। এবার এসে ২০ হাজার লোককে হত্যা করেছে।
রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টের কাজ বিনা টেন্ডারে দেওয়ার সমালোচনা করে বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, দলীয় লোকদেরই বিনা টেন্ডারে কাজ দেওয়া হচ্ছে। এর পরও কোনো উন্নয়ন হচ্ছে না। তিনি বলেন, দুর্নীতি থেকে রক্ষা পেতে সংসদে ইনডেমনিটি দেওয়া হয়েছে। তিনবার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। বিদ্যুতে ১২ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়েছে। এ টাকা গ্রাহকদের কাছ থেকে তুলবে। সিএনজির দাম বাড়িয়েছে। আবার বাড়াবে।
রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে সুন্দরবন শেষ : বিএনপির প্রধান বলেন, 'রামপালে যৌথভাবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হলে সুন্দরবন শেষ হয়ে যাবে। এখানে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করতে দেওয়া যাবে না। আমি ও পরিবেশবিদরা আপনাদের সঙ্গে থাকব।' তিনি বলেন, আশুগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে গ্যাস ভারত টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এর পরও সরকার নীরব। এসব স্থান দিয়ে গ্যাস যেতে দেওয়া হবে না।
বিএনপি-জামায়াত নেতাদের মুক্তি দাবি : বিএনপি-জামায়াতসহ সব দলের 'রাজবন্দিদের' মুক্তি দেওয়ার দাবি জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, 'আমরা স্বাধীনতার পক্ষে। জনগণের পক্ষে। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ করেনি। মানবতাবিরোধীরা দোষী সাব্যস্ত হলে তাদের সাজা হবে; কিন্তু আগে কেন আটক রাখা হবে? তবে প্রকৃত অপরাধীরা যাতে শাস্তি পায়, সেদিকে আমরা খেয়াল রাখব।'
খুলনার জনসভায় সভাপতিত্ব করেন খুলনা মহানগর বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু এমপি। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক, জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির অধ্যাপক নাজির আহমেদ, এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীরবিক্রম, বিএনপি নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, শামসুজ্জামান দুদু, মসিউর রহমান, মজিবর রহমান সরোয়ার, ইলিয়াস আলী, ইসলামী ঐক্যজোটের মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী, জামায়াতের মিয়া গোলাম পরওয়ার, বিএনপির জেলা সভাপতি অধ্যাপক মাজেদুল ইসলাম, বিজেপি নেতা অ্যাডভোকেট লতিফুর রহমান লাবু প্রমুখ।
ইভিএম হচ্ছে ভোট কারচুপির মেশিন : যশোরের পথসভায় খালেদা জিয়া বলেন, 'দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন আমরা মানি না। এ দেশে এ ধরনের নির্বাচন হতেও দেওয়া হবে না। এখন তারা দুই ফন্দি করেছে, সেনাবাহিনী ছাড়া নির্বাচন এবং ইভিএমের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ। আমরা বলে দিতে চাই, সেনাবাহিনী ছাড়া কোনো নির্বাচন হবে না। আর ইভিএম হচ্ছে ভোট কারচুপির মেশিন। এটা আমরা মানি না।'
খালেদা জিয়া বলেন, 'আওয়ামী লীগ দুর্নীতির কারণে পদ্মা সেতু করতে পারেনি। আমরা ক্ষমতায় গেলে দুটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করব।'
যশোরের পথসভাও হাজার হাজার কর্মী-সমর্থকের উপস্থিতিতে জনসমুদ্রে রূপ নেয়। জেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শামসুল হুদার সভাপতিত্বে পথসভায় বক্তব্য দেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম, খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মওদুদ আহমদ, এম কে আনোয়ার, আ স ম হান্নান শাহ, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, সহসভাপতি আবদুল্লাহ আল নোমান, এলডিপির চেয়ারম্যান অলি আহমদ, জামায়াতে ইসলামীর আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, খেলাফত মজলিসের চেয়ারম্যান মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক, মুফতি মোহাম্মদ ওয়াক্কাস, ইসলামী ঐক্যজোটের আবদুল লতিফ নেজামী, বিজেপির শামীম আল মামুন, সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু, পৌর মেয়র মারুফ উল ইসলাম, কাজী মনিরুল ইসলাম, স্থানীয় জামায়াত নেতা আবদুর রশীদ প্রমুখ।
পথে বাধা দেওয়ার অভিযোগ : রোডমার্চে পথে পথে বাধা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। গতকাল নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দলের যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ এ অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সরকার দিশেহারা হয়ে গেছে। তাই তারা সন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়েছে। তাঁর অভিযোগ, যশোরের শার্শায় রোডমার্চে যোগদানকারী গাড়িবহরে পুলিশ ও র‌্যাবের উপস্থিতিতে হামলা চালায় 'আওয়ামী সন্ত্রাসীরা'। ১০টিরও বেশি গাড়ি তারা ভাঙচুর করে। ওই সময় তাঁদের শতাধিক নেতা-কর্মী আহত হন বলেও তিনি দাবি করেন।
তারেক ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি!

No comments

Powered by Blogger.