অসামরিক-সামরিক সম্পর্ক by এ এম এম শওকত আলী

বিগত এক দশকেরও অধিককাল ধরে অসামরিক-সামরিক সম্পর্ক বিষয়টি বহুল আলোচিত। উন্নয়নশীল দেশে, বিশেষ করে যেসব দেশের সামরিক শাসনের অভিজ্ঞতা রয়েছে, সেসব দেশের জন্য বিষয়টি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। মূলত এসব দেশে অসামরিক ও সামরিক প্রশাসনের সুসম্পর্ক নিঃসন্দেহে প্রয়োজনীয়। ব্রিটিশ আমলে প্রণীত ফৌজদারি কার্যবিধিমালার অসামরিক বা সিভিল প্রশাসন ও সামরিক প্রশাসনের ক্ষেত্রবিশেষে দায়িত্ব পরিধি নির্ধারিত হয়েছিল।


এর কোনো পরিবর্তন না হলেও বাস্তবে এ দায়িত্ব পরিধির কার্যকারিতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধিমালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সামরিক বাহিনীর ব্যবহার করার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। বিধিমালা মতে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবস্থা যদি এমন হয়, যা প্রচলিত পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়, তখনই সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করা আইনসম্মত হবে। পক্ষান্তরে উদাহরণস্বরূপ, সাম্প্রদায়িক বা অন্য কোনো কারণে ব্যাপক দাঙ্গা-হাঙ্গামার আশঙ্কা নিয়ন্ত্রণের জন্য এটা করা যায়। দ্বিতীয়ত, প্রলয়ঙ্করী দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত নাগরিকদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের লক্ষ্যেও সামরিক বাহিনীকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। তৃতীয়ত, বেআইনি কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণের জন্যও সামরিক বাহিনীকে সাময়িকভাবে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। যেমন_ব্যাপক আইন লঙ্ঘনসহ সংশ্লিষ্ট অন্য ক্ষেত্র, যেমন চোরাচালান ও কালোবাজারি প্রতিরোধের জন্য। এ ক্ষেত্রে বলা হয়, সামরিক বাহিনীকে অসামরিক বা সিভিল প্রশাসনকে সাহায্য করার লক্ষ্যেই এ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে পাকিস্তান আমল থেকে 'আর্মি ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার' শীর্ষক একটি পুস্তিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রণয়ন করেছিল। এ পুস্তিকায় উভয় প্রশাসনের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে বিস্তারিত অনুসরণীয় নিয়মাচারের বর্ণনা দেওয়া আছে।
এসব ক্ষেত্রে উভয় প্রশাসনের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ যে উদ্দেশ্য নিয়ে সামরিক বাহিনীকে তলব করা হয়, সে উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য সুসম্পর্ক বিশেষ অবদান রাখতে পারে। নিয়ম অনুযায়ী দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে কিছু অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এর ফলে সরকারের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হয়। প্রতিষ্ঠিত সরকার যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষার অজুহাতে বারবার সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করে, তাহলে বিপদও অনেক। ফলে সামরিক অভ্যুত্থানও হতে পারে, যার মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনও হয়। সাংবিধানিক সুশাসনের জন্য এটি হুমকিস্বরূপ। ১৯৭১-পূর্ববর্তী ও ১৯৭১-পরবর্তী সময়ে সময় সময় অসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করার জন্য সামরিক বাহিনীকে তলব করা হয়।
১৯৭৪ সালে প্রথমবারের মতো অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারসহ চোরাচালান দমনের জন্য সামরিক বাহিনীকে অসামরিক প্রশাসনকে সাহায্য করার জন্য ব্যবহার করা হয়। সামরিক বাহিনী ওই সময় এ অভিযানের নাম দিয়েছিল 'অপারেশন সিলভার লাইনিং'। অর্থাৎ কালোমেঘের পর রুপালি আলো। পরবর্তীকালে আলো যে আসেনি তা সবাই জানে। ২০০২-০৬ সালের মধ্যেও একবার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সফল নিয়ন্ত্রণের জন্য সামরিক বাহিনীকে তলব করা হয়। ওই সময় অনেক ব্যক্তি বিনা বিচারে মৃত্যবরণ করেছে। শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন চারদলীয় জোট সরকার একটি ইনডেমনিটি আইন প্রণয়ন করে সামরিক বাহিনীকে রক্ষা করে। এ নিয়েও মিডিয়ায় বিতর্কের সৃষ্টি হয়। সবশেষ সামরিক বাহিনীকে তলব করা হয় ২০০৭ সালে। দেশের অস্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি উন্নতির লক্ষ্যেই এ পদক্ষেপ গ্রহণ করার প্রধান যুক্তি ছিল। এরপর দুই বছর ধরে পুনর্গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সামরিক বাহিনীর জেলা থেকে রাজধানী পর্যন্ত অবস্থান ছিল। মিডিয়া এ সরকারকে সেনাসমর্থিত সরকার নামে অভিহিত করে। আন্তর্জাতিক মিডিয়াও একই বিশেষণে এ সরকারকে ভূষিত করে। এ বিশেষণ এখনো ব্যবহার করা হয়।
বিগত এক মাসেরও অধিক সময় উইকিলিকস সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে বিস্তর ও চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছে। এসব তথ্য এ দেশের প্রায় সব সংবাদপত্রই কমবেশি প্রকাশ করেছে। এসব তথ্যে অসামরিক প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক ছাড়াও বিভিন্ন রাজনীতিবিদসহ সিভিল সোসাইটির কিছু ব্যক্তি ও ব্যবসায়ী নেতাদের আচরণও স্থান পেয়েছে। এসবের মধ্যে একটি সংবাদের উপশিরোনাম ছিল 'রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক সংকট উত্তরণের জন্য মার্কিন সরকারের সাহায্য প্রার্থনা করে'। মূল শিরোনাম ছিল 'মার্কিন রাষ্ট্রদূত সামরিক হস্তক্ষেপের বিষয় জানার জন্য সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে'। প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন গ্রুপ, নাগরিক সংগঠন ও ব্যবসায়ী নেতারা মার্কিন দূতাবাসসহ অন্যান্য বিদেশি দূতাবাসকে সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে রাজনৈতিক সংকট নিরসনের প্রস্তাব দিয়েছিল। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কারণ, অতীতের অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দেয়, বিবদমান দুই প্রধান রাজনৈতিক দল কখনো সংলাপে রাজি হয়নি। রাজনৈতিক সংকট নিরসনের জন্য তারা রাজপথের আন্দোলনকেই একমাত্র কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছে। এ ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। সার্বিক দৃষ্টিকোণে বলা যায়, উইকিলিকস প্রদত্ত তথ্য এ দেশের অনেক নাগরিকের জন্য নতুন কোনো তথ্য ছিল না। কারণ, এসব প্রস্তাব ওই সময় সংবাদ মাধ্যমেও প্রকাশ হয়েছিল।
এ দেশের সচেতন নাগরিকসহ রাজনৈতিক দলগুলো একনিষ্ঠভাবে গণতন্ত্রকামী হওয়া সত্ত্বেও কেন তারা ওই সময় অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক সংকট নিরসনের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছিল, সে প্রশ্নের উত্তর সহজে পাওয়া যাবে না। একমাত্র সহজ উত্তর হলো, সামরিক হস্তক্ষেপ ব্যতীত সংকট নিরসনের আর কোনো আশু সমাধান নেই। তবে ২০০৭ সালে সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা প্রত্যক্ষভাবে সামরিক শাসন জারি করতে আগ্রহী ছিলেন না। এ বিষয়টি তখনো অনেকেই জানতেন। অন্তত ঢাকায় ব্যক্তিগত আলোচনায় অনেকেই এর কিছু ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যা অনেকটা অপ্রকাশিত। শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তারা সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক ও অসামরিক প্রশাসনের ওপর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে পরোক্ষ বা প্রচ্ছন্ন অথচ পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য আগ্রহী ছিলেন। ব্যক্তিগত আলোচনায় এ কৌশলের মাধ্যমে পরিবর্তিত রাজনৈতিক-প্রশাসনিক দৃশ্যপটকে অনেকেই 'বোরকা পরিহিত সামরিক শাসন' মর্মে আখ্যায়িত করেছেন।
এ পরিস্থিতির জন্য ওই সময় যেসব ব্যাখ্যা পাওয়া যায় তার মধ্যে রয়েছে_এক. আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামরিক শাসনের বিপক্ষে অবস্থান; দুই. প্রত্যক্ষভাবে সামরিক শাসন জারি করা হলে জাতিসংঘের শান্তি মিশনে সামরিক বাহিনীর ব্যবহার বন্ধ হয়ে যাবে। শেষোক্ত বিষয়টি সামরিক বাহিনীর সদস্যদের জন্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এ ধরনের মিশনে কর্মরত অবস্থায় তাঁরা বৈদেশিক মুদ্রায় যে বিপুল আয় করতেন, তা বন্ধ হয়ে যাক, সেটা তাঁদের কাম্য ছিল না।
পাকিস্তানসহ এ দেশের সামরিক শাসনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অতীতেও সামরিক শাসনের প্রথম পর্যায়ে অসামরিক ব্যক্তিকেই প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে নিয়োগ করা হয়। ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের সময় ইসকান্দার মির্জাই ছিলেন সামরিক শাসনব্যবস্থার প্রধান। অতিসত্বর তাঁকে বিদায় নিতে হয়। ১৯৬৯ সালে এর ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয়। রাষ্ট্রপতি আইয়ুব সরাসরি ওই সময় সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়াকে ক্ষমতা অর্পণ করেন। ১৯৭১-পরবর্তী সময়ে ১৯৭৫ সালের প্রথম সামরিক শাসনের প্রাথমিক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদ খন্দকার মোশতাক প্রধান সামরিক শাসক ও রাষ্ট্রপতি হিসেবে অল্প সময়ের জন্য কর্মরত ছিলেন। এর পর একই সালে জেনারেল জিয়াউর রহমান অলিখিতভাবে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও বিচারপতি সায়েমকে প্রধান সামরিক শাসক ও রাষ্ট্রপতি হিসেবে গ্রহণ করেন। এ ক্ষেত্রেও স্বল্পকালীন সময়ের জন্য। ১৯৮২ সালে জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের সময় কিছুটা ব্যতিক্রম হয়।
১৯৮২-পরবর্তী সময়ে, অর্থাৎ ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সামরিক শাসনের নতুন রূপ দৃশ্যমান ছিল। তবে তারা কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রচ্ছন্ন প্রক্রিয়ায় অসামরিক প্রশাসনে নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিল। সে বিষয়টি গবেষণা সাপেক্ষ। উইকিলিকসের তথ্যে যে বিষয়টি এখনো অপ্রকাশিত তা হলো, ২০০৭ সালে সেনাবাহিনী প্রধানের আশপাশে কিছু স্বনিয়োজিত অ্যাডভাইজার দৃশ্যমান ছিলেন। এ দৃশ্য আগে দেখা যায়নি। ব্যবসায়ী মহলের শীর্ষ নেতাদেরও দেখা গিয়েছিল। বিশেষ করে সেনাপ্রধান যখন সিডর ও বন্যা আক্রান্ত এলাকায় ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমের জন্য একটি ত্রাণ তহবিল প্রতিষ্ঠা করেন। এটা ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। অতীতে কখনো এ ধরনের ব্যবস্থা দেখা যায়নি।
সামরিক প্রশাসনকে সহায়তা প্রদান প্রক্রিয়ায় প্রকৃতপক্ষে যে দৃশ্যপট পরিস্ফুট হয় তা হলো, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কর্মকাণ্ড ক্রমান্বয়ে সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক ভূমিকায় পরিণত হয়।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক
উপদেষ্টা ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.