বরিশালে বখাটেদের নৃশংসতা-সমাজকে শ্বাপদমুক্ত করার দায় রাষ্ট্রের

সামাজিক অবক্ষয় আর মূল্যবোধের ধস সমাজদেহে যেসব মর্মন্তুদ চিত্র এঁকে দিচ্ছে, নৃশংসতা-পৈশাচিকতা যেভাবে ক্রম মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, তাতে শান্তিপ্রিয় মানুষের বসবাস মারাত্মকভাবে প্রশ্নের মুখে পড়েছে। গত ২৬ নভেম্বর বরিশালে উত্ত্যক্তকারীর হাত থেকে মেয়েকে রক্ষা করতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা, স্কুলশিক্ষক মো. জিন্নাত আলী প্রাণ হারালেন এক বখাটে ও তার সহযোগীর নৃশংসতার শিকার হয়ে। যে জিন্নাত আলী ১৯৭১ সালে দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মুক্তির
জন্য লড়াই করেছিলেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে, সেই মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীন দেশে প্রাণ হারালেন সমাজবিরোধীদের হাতে। হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ইতিমধ্যে উত্ত্যক্তকারী রূপমের (অনিক) সহযোগী আরিফুর রহমানকে (মিঠু) পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।
বখাটেদের অপকর্ম দীর্ঘদিন ধরে চলছে। ইতিমধ্যে তাদের কারণে অনেকের প্রাণ ঝরে গেছে। অনেকের শিক্ষা কিংবা সামাজিকজীবন গুটিয়ে গেছে, আবার কেউ কেউ অন্যত্র আত্মগোপন করেছেন_এমন প্রতিবেদন গত এক বছরে মিডিয়ায় কম প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়নি। বরিশালের ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, ধারাবাহিকভাবে ঘটে চলা ঘটনাবলিরই অংশ। নিহত মুক্তিযোদ্ধা জিন্নাত আলী এর আগে কয়েকবার উত্ত্যক্তকারীকে মৌখিকভাবে সতর্ক করে দিয়েছিলেন, যাতে তাঁর কলেজপড়ুয়া মেয়েটি তাদের হাত থেকে রক্ষা পায়। কিন্তু তাতে তারা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং একপর্যায়ে তিনি বাধ্য হয়ে প্রায় দেড় মাস আগে কাউনিয়া থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। এরপর রূপম আরো হিংস্র রূপ ধারণ করে। অবশেষে মো. জিন্নাত আলীর জীবনপ্রদীপ নিভিয়ে দেয়। নিহত মো. জিন্নাত আলীর জিডির ব্যাপারে থানা-পুলিশের যে বক্তব্য পাওয়া গেল, তা অত্যন্ত খোঁড়া যুক্তি এবং এখানেও তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে নিষ্ঠ না হওয়ার চিত্রটি অত্যন্ত স্পষ্ট। কোনোভাবেই পুলিশ তাদের ব্যর্থতা ও দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে অবহেলার দায় এড়াতে পারে না। পুলিশ কেন তার পাশে দাঁড়ায়নি_এর ব্যাখ্যা পুলিশকেই দিতে হবে।
আমরা মনে করি, সমাজে ক্ষত যেভাবে ক্রমবিস্তৃত হচ্ছে, এর জন্য দায়িত্বশীলদের জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতার পাট চুকে যাওয়ার বিষয়টি বহুলাংশে দায়ী। সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের চিত্র যদি এত উৎকট হয়, তাহলে সে সমাজ মনুষ্য বসবাসের উপযোগী থাকবে কী করে? এই যে বখাটে ও উত্ত্যক্তকারীদের এত উন্মত্ততা আজ ওখানে, কাল সেখানে পরিলক্ষিত হচ্ছে, শ্বাপদদের সদম্ভ পদচারণের ক্ষেত্র বিস্মৃত হচ্ছে, এর দায় তো রাষ্ট্রশক্তিও এড়াতে পারে না। এসব নিয়ে এ পর্যন্ত কথাবার্তা কম হয়নি, দায়িত্বশীলদের অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতিও কম মেলেনি; কিন্তু কাজের কাজ যে আশানুরূপ নয়, বিদ্যমান বাস্তবতা এরই নির্মম সাক্ষ্যবহ। মো. জিন্নাত আলীর হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক দণ্ড নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাঁর পরিবারকে নিরাপত্তাদানসহ প্রয়োজনীয় সব কিছু রাষ্ট্রকে করতে হবে। দেশের সর্বত্র চিরুনি অভিযান চালিয়ে সমাজবিরোধীদের মূলোৎপাটনে সরকার ও প্রশাসনের অবস্থান হতে হবে দৃঢ়, নির্মোহ।

No comments

Powered by Blogger.