শাইনিং না সাফারিং by জামান সরদার

তাত্তি্বকভাবে কেবল ভোক্তাদের ভোলানোর কথা থাকলেও, বাস্তবে বোধহয় বিজ্ঞাপন তার নির্মাতাদেরও নিমগ্ন রাখে। রোববার ভারতের প্রথম শ্রেণীর দৈনিকগুলোতে সরকারের পক্ষে পূর্ণ পৃষ্ঠা ঝলমলে বিজ্ঞাপন দেখে অন্তত তাই মনে হতে পারে। বহুজাতিক রিটেল কোম্পানিকে নিজ নিজ ব্রান্ডের চেইনশপ খোলার অনুমতি দিয়ে তৃণমূলের মতো কয়েকটি শরিক দলের তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েছে ইউপিএ সরকার। সেটা সামাল দিতেই ওই রবিবাসরীয়


বিজ্ঞাপন। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারের জয়গান প্রচারে বিজ্ঞাপনের দাওয়াই কতটা কার্যকর? রাজনীতি কিংবা অর্থনীতি কি ভোগ্যপণ্যের মতো বিজ্ঞাপনের বিষয়?
অনেকের মনে আছে, বিজেপি ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রচারণায় বহুজাতিক বিজ্ঞাপনী সংস্থার মাধ্যমে বানানো পাঁচশ কোটি রুপি মূল্যের ভারত উদয় বা 'ইন্ডিয়া শাইনিং' নামে যে বিজ্ঞাপন সিরিজ ছেড়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত বুমেরাং হয়েই দাঁড়িয়েছিল। সবুজ ঘাসে মোড়া নিজস্ব লনে ক্রিকেট ব্যাট হাতে তন্বী গৃহবধূ আর উইকেটকিপার হিসেবে তার স্বাস্থ্যোজ্জ্বল শিশুপুত্রের ছবিওয়ালা পোস্টার ও বিলবোর্ডের বিপরীতে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোটের 'সাফারিং ইন্ডিয়া' স্লোগান বরং ভোটারদের বেশি আকর্ষণ করেছিল।
তারও আগে, ১৯৭১ সালের লোকসভা নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস 'গরিবি হটাও' স্লোগান দিয়ে নির্বাচনী প্রচারে নামে। নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের পর ওই স্লোগান এতটাই বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, ইন্দিরা গান্ধীকে শেষ পর্যন্ত ভারতের ইতিহাসের প্রথম জরুরি অবস্থা জারি করতে হয়। এমনকি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অনন্য সামরিক ও রাজনৈতিক নৈপুণ্যের সাফল্যও দারিদ্র্য দূর করতে না পারার ব্যর্থতার কাছে ম্লান হয়ে যায়।
দু'দু'বার বিপর্যয় ডেকে আনার নজির চোখের সামনে জীবন্ত থাকার পরও ভারতের ক্ষমতাসীন জোট ফের ওই পথ ধরেছে। দেশটির শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষে প্রচারিত ওই বিজ্ঞাপনে বলা হচ্ছে, খুচরা ও কাঁচাবাজারে বহুজাতিক কোম্পানি উপস্থিতি_ কৃষককে তার উৎপাদিত পণ্যের ভালো মূল্য দেবে, লাখ লাখ তরুণকে চাকরি দেবে আর ভোক্তাদের স্বস্তি দেবে। প্রসঙ্গত, ২৪ নভেম্বর কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা ওই সিদ্ধান্ত নেয়।
বিরোধীরা বলছে, এতে করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, যারা বিভিন্ন কাঁচাবাজারে, ফুটপাতে দোকানদারি করে পেট ও পরিবার চালায়, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জীবিকা হারাবে। অন্যদিকে উদারীকরণের পক্ষেও যুক্তি কম নয়। সমর্থকরা বলছে, বরং আশঙ্কার উল্টো ফল দেবে। নতুন বাজার ও ন্যায্যমূল্য পাওয়ার ফলে কৃষকের অবস্থার উন্নতি হবে, এখন বড় অংশ কৃষিশস্য মজুদ রাখা যায় না। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সংরক্ষণ ব্যবস্থার কারণে অপচয় কমবে ইত্যাদি। বড় কথা, খুচরা ব্যবসাও বাড়বে। তারা চীনের উদাহরণ দিয়ে বলছে, সেখানে বহুজাতিক চেইনশপের জন্য দরজা খুলে দেওয়ার পর খুচরা ব্যবসা দ্বিগুণ হয়েছে। প্রথম ২০টি চেইনশপ কোম্পানি চীনা মালিকদেরই দখলে।
ভারতেও এর পুনরাবৃত্তি হলে মন্দ কি! কিন্তু চীনে কি বিজ্ঞাপন দিয়ে বিরোধীদের মত পাল্টানো হয়েছিল? রাজনৈতিক ইস্যুতে বিজ্ঞাপনের ব্যবহার সেই গোয়াল পোড়া গরুর কথাই মনে করিয়ে দেয়, যেগুলো সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পায়। শাইনিংয়ের বিজ্ঞাপন না পাছে সাফারিংয়ের নজিরে পরিণত হয়!

No comments

Powered by Blogger.