নিত্যজাতম্‌-জুতায় লুকানো জনতার ক্ষোভ by মহসীন হাবিব

ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশের বর্তমান ধারণাটি মূলত শুরু হয়েছিল ইরাক থেকে। মিসরভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল বাগদাদিয়ার প্রতিনিধি সাংবাদিক মুনতাজার আল-জায়দি সাহসী রিপোর্ট করতে গিয়ে একবার ২০০৭ সালের ১৬ নভেম্বর অপহরণের শিকার হন। এরপর আরো দুবার তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন। অবশেষে ২০০৮ সালের ১৪ নভেম্বর ইরাকের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে একটি সংবাদ সম্মেলনের সময় তৎকালীন মার্কিন


প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাবি্লউ বুশকে লক্ষ করে তিনি জুতা ছুড়ে মারেন। আমাদের দেশের মতোই আরব দেশগুলোতে কাউকে জুতা ছুড়ে মারা চরম অপমানজনক বিষয় বলে বিবেচিত। জুতা ছুড়ে মারার সময় জায়দি মুখে বলেছিলেন, 'ইরাকের জনগণের পক্ষ থেকে এটা তোমাকে বিদায়চুম্বন, কুকুর!' আমরা সবাই জানি, অল্পের জন্য সে আঘাত থেকে মাথা সরিয়ে নেওয়ায় প্রেসিডেন্টের অর্ধেক ইজ্জত রক্ষা পেয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই জায়দি গ্রেপ্তার হন। ইরাকের মন্ত্রী নুরি আল মালিকি বললেন, 'বেটারে শূলে বিঁধে/কারার মাঝে করিয়া রাখো রুদ্ধ।' কেউ কেউ অভিযোগ তোলেন, তাঁকে নাকি সত্যিই শূলে বিঁধানোর মতোই কারাগারে উত্তমমধ্যম দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যতই তা দিক, আরবসহ গোটা বিশ্বে কোটি কোটি যুদ্ধবিরোধী মানুষ জায়দিকে বীর উপাধিতে আখ্যায়িত করল। ছুড়ে দেওয়া জুতা ইরাকের জাদুঘরে রাখার দাবি উঠল। সত্যি সত্যি তা করা হলে হয়তো এ জুতা হয়ে উঠত পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে দামি জুতা। তখনই সৌদি আরবের একজন ব্যবসায়ী জুতাটি কিনে নিতে চাইলেন ১০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে। কিন্তু সে সুযোগ কি আর পাওয়া যায়! যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী এবং ইরাকি নিরাপত্তা বাহিনী সে জুতা ধ্বংস করে দিল, যাতে ওই লজ্জাজনক ঘটনার কোনো আলামতই না থাকে।
কিন্তু বস্তু জুতা ধ্বংস করা গেলেও জায়দির সেই জুতার ইতিহাস ও রাজনীতি ধ্বংস করা যায়নি। ওই ঘটনার পর সারা দুনিয়ায় শুরু হয়ে গেল তীব্র ক্ষোভ প্রকাশে জুতা ছুড়ে মারার কালচার। ওই ঘটনার তিন দিন পর ১৭ ডিসেম্বর নিউ ইয়র্ক শহরে মেট্রোপলিটন ট্রানজিট অথরিটির 'সিইও'কে জুতা ছুড়ে মারলেন স্টিফেন মিলিস নামের এক কর্মচারী। যুদ্ধবিরোধী একটি সংগঠন ওই ১৭ ডিসেম্বরই হোয়াইট হাউসের বাইরে প্রেসিডেন্ট বুশের কুশপুত্তলিকায় জুতা ছুড়ে মারল। ঘটতেই থাকল এসব। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট ওয়েন চিয়াবাও ভাষণদানকালে এক জার্মান প্রতিবাদকারী তাঁর দিকে জুতা ছুড়ে মারলেন। সুইডেনে ২০০৯ সালে ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত গাজা যুদ্ধ নিয়ে কথা বলার সময় একজন প্রতিবাদকারী তাঁকে জুতা ছুড়ে আঘাত করলেন। ২০১০ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারির দিকে জুতা ছুড়ে দিলেন শামীম খান নামের এক পাকিস্তানি। শুধু কি তাই! মজার আরো কাহিনী আছে। জুতার কম্পানি বানাতে শুরু করল বুশ জুতা, বাই বাই নামের বুশ জুতা। এমনকি ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা ডি সিলভা সাংবাদিকদের সঙ্গে জুতা ছুড়ে মারার ভঙ্গি করে মজা করলেন। আর ভারতে তো রীতিমতো রেয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০০৯ সালে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরমকে লক্ষ্য করে জুতা ছুড়ে মারলেন সাংবাদিক জানের্সল সিং। এ বছরই লালকৃষ্ণ আদভানিকে চটি ছুড়ে মারলেন বিজেপিরই এক সদস্য। ২০১০ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর ফারুককে লক্ষ্য করে একজন জুতা ছুড়লেন। আরো অসংখ্য ঘটনা উল্লেখের জায়গা নেই।
এই জুতা ছুড়ে দেওয়া কিন্তু শুধুই কোনো ফ্যাশন, ব্যক্তিগত খ্যাতি বা কুখ্যাতি অর্জনের (কুখ্যাতিও কিন্তু এখন অর্জনের বিষয়) প্রচেষ্টা নয়। এর পেছনে রয়েছে জনগণের বড় একটি অংশের ক্ষোভের প্রতিফলন। সেই বহিঃপ্রকাশই ঘটেছে একটু সংস্করণের মধ্য দিয়ে। গত শুক্রবার ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষিমন্ত্রী, ৭১ বছর বয়সী বর্ষীয়ান নেতা শারদ পাওয়ারকে ঠাস করে চড় মেরে বসেন হরবিন্দর সিং নামের ২৭ বছর বয়সী এক অটোরিকশাচালক যুবক। মন্ত্রী পাওয়ার নয়াদিলি্লতে একটি সাহিত্য অনুষ্ঠান থেকে বের হয়ে আসছিলেন। শুধু চড় মারা নয়, একটি ছোট ছোরা নিয়েও এগিয়ে যান যুবক শারদ পাওয়ারের দিকে। পাওয়ার কোনোক্রমে দেয়াল ধরে নিজেকে সামলে নেন। এই যুবক কিন্তু চমকে দিয়েছেন ভারতবাসীকে একটি কথা বলে। তিনি কৃপাণ বা ছোরা উঁচিয়ে বলতে থাকেন, 'দুর্নীতি ও মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে এবার থেকে এ রকমই জবাব দেওয়া হবে রাজনীতিবিদদের!'
হরবিন্দর সিংয়ের এ ঘটনা আন্না হাজারের আন্দোলনের সঙ্গে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। দ্রব্যমূল্য ও দুর্নীতি নিয়ে সাধারণ জনগণ কতটা ক্ষুব্ধ হয়ে আছে তারই একটি চেহারা এই যুবককে সমর্থন দেওয়ার মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে। অসংখ্য মানুষ ভারতে আওয়াজ তুলছে হরবিন্দর জিন্দাবাদ বলে, পলিটিশিয়ানদের গালি দিচ্ছে মুর্দাবাদ বলে। ইন্টারনেটে তাঁর প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। অবশ্য মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে এবং জাতীয় রাজনীতিতেও শারদ পাওয়ারের দুই ধরনের ইমেজই রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন শারদ পাওয়ার একজন ভেটারান ও নিরেট ভালো মানুষ। আবার কারো কারো বক্তব্য এমন যে শারদ পাওয়ারের সুইস ব্যাংকেই শত শত কোটি টাকা রয়েছে। তিনিও পঙ্কিল রাজনীতিরই অংশ। তবে একটা কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, চড়টি কিন্তু শারদ পাওয়ারের একার জন্য নয়। এ চড় ভারতের ক্ষমতাসীন দলের সবার গালেই লেগেছে। এ ঘটনা থেকে কিন্তু আমাদেরও অনেক কিছু শেখার আছে। ভারতীয় রাজনীতির একটি ইতিবাচক বিষয় দেখা গেছে এ ঘটনায়। সব দল যে কোনো কোনো বিষয়ে এক সুরে কথা বলতে পারে বা সব দলেরই তা বলা উচিত, তা আবারও লোকসভায় এবং লোকসভার বাইরে আমরা দেখতে পেলাম। গণতন্ত্রকে প্রথমে এমন পরিণত জায়গায়ই পেঁৗছতে হয়। হরবিন্দর সিংয়ের ঘটানো এ ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, বিজেপি নেত্রী সুষমা স্বরাজ, সিপিএম নেতা সিতারাম ইয়েচুরি, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা মুলায়ম সিং যাদব বলেছেন, এ ধরনের হিংসার পথ প্রতিবাদের ভাষা হতে পারে না। পারুক বা না পারুক, নিবন্ধকারের আলোকপাতের জায়গা সেটা নয়। আলোকপাতের জায়গা হলো, কংগ্রেস, সিপিএম, বিজেপি, যেকোনো একটি বিষয়ে একই মত দিতে পারে, এক সুরে কথা বলতে পারে_তা যেন আমাদের দেশে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। আমরা কোনো দিন, কোথাও কোনো বিষয়ে দেশের পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে এক ভাষায় কথা বলতে দেখলাম না। কাউকে রাস্তায় ফেলে পেটালে একদল তার নিন্দা করল তো সঙ্গে সঙ্গে লাজলজ্জা সব ভুলে অন্য দল সেই কাজের প্রশংসা শুরু করল।
যাহোক, দেশের জনগণের প্রতি একটি অনুরোধ, দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্য নাগালের বাইরে চলে যাওয়া, নাগরিক সুবিধা থেকে প্রায় সম্পূর্ণ বঞ্চিত হওয়া আমাদের অনেকটা গা-সওয়া হয়ে গেছে; আমরা কেউ কখনো যেন জায়দির মতো, হরবিন্দরের মতো প্রতিবাদ করার সাহস দেখাতে না যাই; প্রতিবাদ আমরা করব, তবে এভাবে নয়। এর বড় কারণ হলো, আমাদের রাজনীতিবিদরা এবং তাঁদের সমর্থকরা এখনো অতটা সহিষ্ণু হয়ে উঠতে পারেননি। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতি দেখে ধারণা করতে কোনোই কষ্ট হয় না যে, এমন স্টাইলে কেউ কোনো প্রতিবাদ করতে গেলে তাকে পিটিয়েই মেরে ফেলবে সমর্থকের দল। সমর্থকদের মধ্যে যে যত বেশি ব্লুটালি আঘাত করতে পারবে, সে তত বেশি কাজ পাবে, লাইসেন্স পাবে। এমনকি পুলিশ কর্তারাও পিটিয়ে মারার সে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারেন। কারণ তাঁদেরও তো পোস্টিং, প্রমোশনসহ বড় বড় নানা বিষয় রয়েছে। হরবিন্দরের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩২৩ (স্বেচ্ছায় কাউকে আঘাত করা), ৩৫৩ (কোনো সরকারি কাজে নিয়োজিতকে আঘাত করা অথবা তাঁকে জোরপূর্বক কাজে বাধা প্রদান করা) এবং ৫০৬ (অপরাধমূলক ভীতি প্রদর্শন) ধারায় মামলা হয়েছে। এতে হরবিন্দরের ফাঁসি বা দীর্ঘ কারাভোগ করতে হবে না। এখানেই আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। দিনে দিনে শক্তিশালী হয়ে উঠছেন আমাদের রাজনীতিবিদরা, শক্তি ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে জনগণের। তার ভূরি ভূরি নজির প্রতিদিন নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্ত ও কার্যকলাপ দেখে আমরা বুঝতে পারছি।
লেখক : সাংবাদিক
Mohshinhabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.