ঢাবির ভর্তি পরীক্ষা : প্রশ্ন ও সুপারিশ by ড. সৌমিত্র শেখর

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা এত দিন মানুষের আলোচনায় ছিল চরম নির্ভরতার কেন্দ্র হিসেবে। পরীক্ষার আগে প্রশ্ন ফাঁসের কলঙ্কে কলঙ্কিত হয়েছে বিসিএস পরীক্ষা, এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাগুলো। অন্য কিছু প্রতিযোগিতামূলক বা চাকরি-পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস হয়েছে এর আগে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ থেকে মুক্ত। এখানে দলমত আছে, শিক্ষক-কর্মকর্তারা নানা গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে নির্বাচনও করেন; কিন্তু


বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে তাঁদের ঐক্যবদ্ধতা প্রশ্নাতীত ও উদাহরণযোগ্য। যে কারণে সারা দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যখন প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন ভর্তি পরীক্ষাসহ অন্যান্য পরীক্ষা ও একাডেমিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে অত্যন্ত নিরপেক্ষতা ও নির্ভরতার সঙ্গে। কিন্তু ২০১১ সালের ভর্তি পরীক্ষায় ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে অর্থাৎ 'গ' ইউনিটে গৃহীত পরীক্ষা বাতিল করে পুনঃপরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ। এই ইউনিটের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় গত ২৮ অক্টোবর; পরীক্ষা পুনঃগ্রহণের তারিখ ঘোষিত হয়েছে ৯ ডিসেম্বর। পরীক্ষা বাতিলের কারণ কী? কারণ হলো এমসিকিউ (বহুনির্বাচনী) পদ্ধতিতে গৃহীত পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নে কর্তৃপক্ষ কিছু ভুল উত্তরকে শুদ্ধ হিসেবে গ্রহণ করেছিল। নিজেদের ফল প্রত্যাশিত না হওয়ায় কয়েকজন পরীক্ষার্থী উত্তরপত্র 'রিভিউ' করানোয় কর্তৃপক্ষের এই মারাত্মক ভুল চিহ্নিত হয়। এর এক পর্যায়ে উপাচার্যের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভা ২৮ অক্টোবরের পরীক্ষা বাতিল করে ৯ ডিসেম্বর পুনঃপরীক্ষা গ্রহণের তারিখ ঘোষণা করে। এ ঘটনা তদন্তের জন্য ২০ নভেম্বর ১০ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। কিন্তু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে অন্যত্র এবং তা ছাত্র(জন)স্বার্থবিষয়ক। ২৮ অক্টোবরের পরীক্ষার ঘোষিত ফলে যেসব পরীক্ষার্থী মেধা তালিকায় ছিল তারা আর কোথাও ভর্তির জন্য পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়নি। পুনঃপরীক্ষা গ্রহণ করলে তারা সবাই যে নির্বাচিত হবে, সে গ্যারান্টি কেউ দিতে পারে না। এদিকে অন্যান্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভর্তির সময়ও অতিক্রান্ত। কী হবে ২৮ অক্টোবরের পরীক্ষার ফলে উত্তীর্ণ মেধা তালিকায় থাকা পরীক্ষার্থীদের? অবশেষে তাদের অনেকে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে। আদালত বিষয়টি আমলে নিয়ে একটা সমাধান খোঁজার আন্তরিক চেষ্টা করছেন। আদালত থেকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জাফর ইকবালকে এ ব্যাপারে পরামর্শ দেওয়ার অনুরোধও জানানো হয়েছে। অবস্থা যে পর্যন্তই গড়াক না কেন, এখন আশা করা যায়, এর একটি সর্বজনগ্রাহ্য সমাধান মিলবে এবং ছাত্র(জন)স্বার্থ রক্ষিত হবে।
আমি ঘটনার সাধারণ বর্ণনা দিয়েই ক্ষান্ত হতে চাই না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যসম্পন্ন ভর্তি পরীক্ষা যে সন্দেহের জালে আবদ্ধ হলো_এ ব্যাপারেই আমার প্রশ্ন। কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করেছে (উল্লেখ্য, বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ঘটনা ঘটলেই তৎক্ষণাৎ তদন্ত কমিটি গঠিত হয় এবং সে কমিটির রিপোর্ট আর কখনোই তৈরি বা প্রকাশ হয় না বলে বিশ্ববিদ্যালয় আঙিনায় একটি কথা প্রচলিত আছে।), তদন্ত কমিটির বাইরে যাঁরা, তাঁদেরও কিছু বক্তব্য আছে নিশ্চয়ই। বাণিজ্য শাখা থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা শিক্ষার্থীদের সামনে উচ্চশিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে এক নম্বর পছন্দ হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিজ্ঞান শাখায় পাস করা শিক্ষার্থীদের জন্য কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিক্যাল ইত্যাদি পছন্দ আগে থাকে, পরে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে চিন্তা করে। সেদিক থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদকে অনেক বেশি দায়িত্বের পরিচয় দিতে হয়। সারা দেশ থেকে বাণিজ্যে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা হাজার হাজার পরীক্ষার্থী আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে। তাদের সামনে মাত্র আটটি বিভাগ_আসনসংখ্যা এক হাজারের বেশি নয়। এমসিকিউ পদ্ধতিতে গৃহীত এ পরীক্ষায় ভুল উত্তরের জন্য নম্বর কর্তনের বিধান আছে। তাই একজন পরীক্ষার্থীকে সুনিশ্চিত হয়ে উত্তর দিতে হয়, তা না হলে ঋণাত্মক নম্বরের কারণে পুঁজি থেকে তার নম্বর কাটা যায়। এই অবস্থায় প্রশ্নকর্তার আগে সাবধান হওয়া জরুরি। 'গ' ইউনিটের প্রশ্ন নিয়ে প্রাথমিকভাবে যে কথাগুলো প্রকাশ পেয়েছে, তাতে প্রশ্নকর্তা প্রশ্নের সঠিক উত্তর সরবরাহের ব্যাপারে দায়িত্বজ্ঞানের পরিপূর্ণ পরিচয় দিতে পারেননি বলেই মনে হয়। যাঁরা এই ইউনিটের প্রশ্ন করেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক। প্রশ্ন করার বিনিময়ে তাঁরা পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন। তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ববোধও তাঁদের আছে বলে এই প্রশ্নের ব্যাপারে তাঁরা সম্পূর্ণ গোপনীয়তা বজায় রাখেন। কিন্তু যে কর্মের পেছনে দায়িত্ব ও পারিশ্রমিকের প্রশ্নটি যুক্ত, সে কর্ম সম্পর্কে প্রশ্নকর্তারা কতটুকু 'প্রফেশনাল'? 'প্রফেশনালিজমের' পরিচয় এখানে মেলেনি। 'গ' ইউনিটের এই ভর্তি পরীক্ষা লেজেগোবরে হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ার জন্য ভুল উত্তরসমেত প্রশ্ন সরবরাহকারী শিক্ষকরা দায় এড়াতে পারেন না। অন্যদিকে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের সম্মানিত ডিনকেও বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে, প্রশ্নকর্তা হিসেবে তিনি যোগ্য ও বিষয়-বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের নির্বাচিত করেছেন। কারণ প্রশ্নকর্তা নির্বাচনের বিষয়টি গোপনীয় এবং তাঁরই এখতিয়ারভুক্ত। 'গ' ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় বাংলা, ইংরেজিসহ বাণিজ্য বিষয়ের প্রশ্ন থাকে। আমরা আশা করব, ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন মহোদয় সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপকদের মাধ্যমেই প্রশ্নগুলো করিয়েছেন। এর ব্যত্যয় হলে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের বাংলা ও ইংরেজি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকদের কাছে যত সহজই মনে হোক না কেন, বিষয়-বিশেষজ্ঞ ছাড়া অন্য বিভাগের শিক্ষকদের এ দুটি বিষয়ের প্রশ্ন করা উচিত নয়।
কিন্তু তাদের অধিকার দিতে হবে সমানভাবে, সব ক্ষেত্রে। যেমন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে তারা মোট ২০০ নম্বরের বাংলা পড়েই (সাধারণ শিক্ষায় ৪০০ নম্বর) সাধারণ শিক্ষায় পাস করা শিক্ষার্থীদের মতো বিষয় দাবি করে। বিভিন্ন বিষয়ের আন্তঃযোগ্যতাবিষয়ক প্রশ্নগুলো তারা মানতে চায় না। তার পরও শিক্ষায় সমানাধিকারের প্রশ্নটি যখন এসে যায়, তখন তা মানবাধিকারের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তাই আদালতের রায়ও তাদের পক্ষেই যায়। এই পরিপ্রক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভর্তির ক্ষেত্রে শুধু এমসিকিউ পরীক্ষাটিকেই গণ্য করতে পারে। এখন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রাপ্ত নম্বরের ওপর যথাক্রমে ৪ ও ৬ শতাংশ নম্বর গণ্য করা হয়। এটা বাদ দেওয়া প্রয়োজন। মনে রাখা উচিত, পরীক্ষার্থীরা বিভিন্ন বোর্ড থেকে পাস করে আসে। এই বোর্ডগুলোর পাসের হার এক নয়। উপরন্তু মাদ্রাসা বোর্ডের পাসের হার সাধারণ বোর্ডের পাসের হারের চেয়ে অনেক বেশি থাকে। ফলে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রাপ্ত নম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে বিবেচনা করলে তা পরীক্ষার্থীদের 'এক মানদণ্ডে' বিবেচনা বোঝায় না। তাই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১০০ নম্বরের একটি পরীক্ষায় সাধারণ ও মাদ্রাসা সব ধারার শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ করাতে পারে। এতে একটি নির্দিষ্ট মানদণ্ডেই সব পরীক্ষার্থীর মূল্যায়ন সম্পন্ন হবে। যেহেতু ঋণাত্মক নম্বর প্রদানের ব্যবস্থা আছে, সেহেতু প্রাপ্ত নম্বরে ভগ্নাংশ হওয়ায় মেধা তালিকা তৈরি করতে কর্তৃপক্ষের মোটেই বেগ পেতে হবে না। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা যদি সেই ১০০ নম্বরের পরীক্ষা দিয়ে মেধা তালিকায় অবস্থান করে তবে তারা ভর্তি হবে। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের ভর্তির প্রশ্নটিও এভাবে বারবার আর আদালত পর্যন্ত গড়াবে না। প্রস্তাবটি ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করতে পারে।
লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
scpcdu@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.