অর্থ বা পেশিশক্তি নয়, জনভিত্তিই হোক মূল্যায়নের চাবিকাঠি-মনোনয়ন by আবু সাঈদ খান

দেশের রাজনীতি কলুষিত ও দুর্বৃত্তায়িত হয়ে পড়েছে। নীতি-আদর্শ, জনসমর্থন বা জনপ্রিয়তা নয় বরং পেশি ও অর্থশক্তিই এখন নেতাকর্মীদের মূল্যায়নের নিয়ামক। দুর্বৃত্তায়িত এ রাজনীতির দায় প্রধানত রাজনৈতিক দলেরই। আমাদের বড় দলগুলো মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও তারা এমন কাণ্ড-কারখানা করছে, যা গণতন্ত্রের প্রতি চরম উপহাস। এ ধারার রাজনীতিতে নতুন সংযোজন মনোনয়ন বাণিজ্য। এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি, আলোচনা-সমালোচনা


হলেও শীর্ষ নেতৃত্ব নির্বিকার। তবে গত ২৩ নভেম্বর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কিশোরগঞ্জের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, পৃথিবীর কোনো দেশেই অর্থের বিনিময়ে মনোনয়ন দেওয়া বা নেতা নির্বাচন করা হয় না। একমাত্র বাংলাদেশেই এটি সম্ভব। ক্ষমতাসীন দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতার এ উপলব্ধি অবশ্যই সাধুবাদযোগ্য।
অর্থের বিনিময়ে নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া বা নেতৃত্বে বসানোর ব্যাপারটি আদর্শহীন রাজনীতিরই পরিচায়ক। ব্রিটিশ ভারতে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জনরাজনীতির উদ্ভব_ সেটি ছিল ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর, আদর্শবাদী রাজনীতি। তবে তখন বিপথগামী ব্রিটিশের চাটুকার ও পোষ্য দালালরাও ছিল, কিন্তু সংখ্যায় নগণ্য। গণজাগরণের ধারায় তারা নির্বাসিত হয়। কেউ কেউ ব্রিটিশের তকমা রায় বাহাদুর ও খান বাহাদুর খেতাব বর্জন করে দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক ধারায় সক্রিয় অবদানও রেখেছেন। তারপর ব্রিটিশের অর্থপুষ্ট হয়ে কাজ করেছেন, এমন মুখোশধারীদের চরিত্র আজ উন্মোচিত। পাকিস্তানের বামপন্থি নেতা খান আবদুল ওয়ালী খান তার 'ফ্যাক্টস আর ফ্যাক্টস' বইয়ে কোন নেতা কখন ব্রিটিশের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করেছেন, সেই নথিপত্রও গেঁথে দিয়েছেন।
সব ক্ষেত্রেই ভালো-মন্দ জড়িয়ে থাকে। ব্রিটিশবিরোধী রাজনীতি ছিল না এর ব্যতিক্রম। কিন্তু আদর্শবাদ, দেশপ্রেমই ছিল তখন মুখ্য। পাকিস্তান আমলের পূর্ব বাংলার রাজনীতি দুই ধারায় বিভক্ত হয়। একদিকে ধর্ম ও পাকিস্তান রক্ষার নামে লেজুড়বৃত্তি, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ-ন্যাপের দেশপ্রেম ও প্রগতিশীল ধারার রাজনীতি।
১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন ও '৭০-এর নির্বাচনে পরীক্ষিত নেতারাই যুক্তফ্রন্টের মনোনয়ন পেয়েছিলেন। বেআইনি ছিল কমিউনিস্ট পার্টি। এর সংগঠক সরদার ফজলুল করীম তখন কারাবন্দি, তাকে যুক্তফ্রন্টের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। কোনো অর্থ ব্যয় না করে তিনি কারাগারে বসেই নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখন মনোনয়ন প্রাপ্তরা সবাই ছিলেন রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী।
সত্তরের নির্বাচনে আমি মাঠ পর্যায়ে কাজ করেছি। দূর থেকে হলেও মনোনয়ন প্রক্রিয়া প্রত্যক্ষ করেছি। ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানায় প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যের (এমপিএ) জন্য একজন সাবেক আমলা মনোনয়ন চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে বলেছিলেন, নির্বাচনে অনেক ব্যয় হবে। আমার সেই সঙ্গতি রয়েছে। বঙ্গবন্ধু জবাবে বলেছিলেন, আমার ইমামউদ্দিন রয়েছে। ওর টাকা-পয়সা নেই। তবে ১০ জনের সাহায্যে নির্বাচন করে জয়ী হবে। সেদিন নবাগত ধনাঢ্য ব্যক্তিকে নয়, নিবেদিতপ্রাণ রাজনৈতিক কর্মীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। সত্তরের নির্বাচনে যারা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন, তারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে উঠে আসা নেতাকর্মী। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটতে পারে। তবে ব্যতিক্রম ব্যতিক্রমই। মুসলিম লীগ, পিডিপি, জামায়াতে ইসলামী রাজনীতির বিপরীত মেরুতে আমার অবস্থান হওয়া সত্ত্বেও স্বীকার করি, '৭০-এর নির্বাচনে সেসব দলেও দলীয় নেতা বা অনুগতরাই মনোনয়ন পেয়েছিলেন।
নির্বাচনী মনোনয়নের ক্ষেত্রে এ ধারার ব্যত্যয় ঘটান দুই জেনারেল_ জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সদ্য প্রতিষ্ঠিত দলে তারা মন্ত্রিত্ব, অর্থ ও মনোনয়ন দিয়ে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের মাথা খরিদ করেছিলেন। আর '৯১ সালের নির্বাচনে দেখা গেল নতুন খেলা। তখন আমলা-ব্যবসায়ীরা টাকার বিনিময়ে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মনোনয়ন খরিদ করে এমপি হলেন। মন্ত্রী হলেন কেউ। সেই যে মনোনয়ন বাণিজ্য শুরু, তা আজও অব্যাহত রয়েছে। এ প্রসঙ্গে আমি একটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী উপজেলার আবদুর রউফ মাস্টার আওয়ামী লীগের পরীক্ষিত নেতা। রাজনীতিতে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। ১৯৯১ সালে দলীয় মনোনয়নে এমপি হন। কিন্তু ১৯৯৬-এ তাকে মনোনয়ন না দিয়ে একজন অরাজনৈতিক স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। তাকে বলা হলো যে, এবার নির্বাচন করতে হলে অনেক টাকা লাগবে। সেই টাকা কি আপনার আছে? বরং অমুকের জন্য কাজ করুন, আপনার কাজের মূল্যায়ন হবে। দলীয় নির্দেশে ওই নেতাকে হতে হলো রাজনীতিতে নবাগত এক ধনাঢ্য ব্যক্তির কর্মী। রাজনৈতিক দলের তহবিল সংগ্রহের মাধ্যম হিসেবে মনোনয়ন বাণিজ্যকে জায়েজ করা হয়েছে। বলা হয় যে, একটি মনোনয়ন বিক্রি করে ১০টা প্রার্থীকে সাহায্য করা হয়। তাছাড়া কেন্দ্রের খরচও রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, '৫৪ ও '৭০ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ও আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ছিলেন অর্থনৈতিকভাবে আজকের প্রার্থীদের তুলনায় কম সম্পদশালী, তখন নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের সিংহভাগই ছিলেন আইনজীবী, শিক্ষক, চিকিৎসক, কৃষিজীবীসহ অতি সাধারণ পেশার মানুষ। সেসব নেতা যদি জনসমর্থন, জনগণের কাছ থেকে অর্থ সাহায্য নিয়ে নির্বাচন করতে পারেন, আজ কেন তা অসম্ভব?
কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, ধনাঢ্য ব্যক্তিরা কি রাজনীতি ও নির্বাচনে অংশ নেবেন না? সেই অধিকার তাদের রয়েছে। তবে অন্যদের মতো তাদেরও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আসতে হবে। হঠাৎ করে মনোনয়ন খরিদ করে এমপি হওয়া বা অর্থের বিনিময়ে নেতা হওয়ার প্রক্রিয়া সমর্থনযোগ্য নয়। ব্যাপারটা সেই গল্পের মতো, আমি বেশি চাঁদা দেব, কিন্তু বিনিময়ে আমার ছেলেকে ফাইনালে খেলতে দিতে হবে।
মনোনয়ন বাণিজ্য রাজনীতিতে বড় অভিশাপ। এ কারণে রাজনীতিতে আমলা, কালো টাকার মালিক ও বসন্তের কোকিলদের আগমন ঘটেছে। তাদের কাছে রাজনীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে বিনিয়োগ। ৫ কোটি দিয়ে মনোনয়ন কিনে আর ৫ কোটি ব্যয় করে নির্বাচনে জিতে ১০ কোটির স্থলে শতকোটি টাকা আয়ের পেছনে ছোটা তাদের কাজ। সংসদে যোগদান, আইন প্রণয়ন, নীতিনির্ধারণ, জনকল্যাণ_ কোনো দিকে মনোনিবেশ নেই তাদের। নির্বাচিত হওয়ার পর বিরোধী দল সংসদ বর্জন, ক্ষমতাসীন দলের সাংসদদের অনুপস্থিতি, ঘন ঘন কোরাম সংকটের পেছনে রয়েছে অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের জয়ী হওয়া। বিরোধী দলে রাজনৈতিক ব্যক্তিরা অধিকমাত্রায় নির্বাচিত হলে তারাও সংসদে যাওয়ার পক্ষে মত দিতেন। একইভাবে ক্ষমতাসীন দলের সাংসদরাও সংসদে না গিয়ে সচিবালয় বা অন্যত্র তদবির বাণিজ্যে ব্যস্ত থাকতেন না। এ পরিস্থিতিতে কখনও কখনও রাজনীতিকরা অক্ষেপ করে বলেন, রাজনীতি রাজনীতিকদের কাছে নেই। এ সর্বনাশের জন্য দায়ী মূলত রাজনীতিকরাই। এ সত্য স্বীকারে কেন অনাগ্রহ।
মনোনয়ন বাণিজ্যের প্রতিক্রিয়া আরও ব্যাপক। এরা নির্বাচনে এসে টাকা ছিটিয়ে রাজনীতি ও সামাজিক পরিবেশ দুই-ই কলুষিত করছেন। রাজনীতিতে যোগ্য সম্মান পেতে অর্থের দরকার_ এ মনোভাব চাঁদাবাজি, দখলবাজি, টেন্ডারবাজিকে উৎসাহিত করেছে। অর্থ ও পেশির দাপটে সৎ ও মেধাবীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। বেড়ে চলেছে অশুভ শক্তির আধিপত্য।
এ অপরাজনীতির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অঙ্গন ও জনমানসে ক্ষোভও ধূমায়িত। এর প্রকাশ ঘটেছে সদ্য সমাপ্ত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে। দল-সমর্থিত মেয়র প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল সেখানকার তৃণমূলের নেতাকর্মী ও জনগণ। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা কেন্দ্রীয় অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। এ বিদ্রোহ ন্যায়ানুগ এবং সত্য ও সুন্দরের প্রতি সমর্থনসূচক। তৃণমূলের রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও নাগরিক সমাজ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার পরও নেতা-নেত্রীদের ঘুম ভাঙবে বলে মনে হয় না। তবে রাজনীতিতে নূ্যনতম নীতি ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত না হলে তা রাজনীতি ও দেশের ভয়ঙ্কর বিপদ ডেকে আনতে পারে, যা আমাদের কাম্য নয়।
যে কোনো মূল্যেই রাজনীতিকে রাজনীতিকদের কাছে ফিরিয়ে আনতে হবে এবং সত্য, ত্যাগী ও মেধাবীদের স্থান করে দিতে হবে। তা করতে হলে নির্বাচনী আইন-বিধি সংস্কার করা দরকার। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, গত ২৩ নভেম্বরের কিশোরগঞ্জের ওই সভায় সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দাবি করেছেন, বিগত সংসদ নির্বাচনে তারা তৃণমূলের মতামত গ্রহণ করেছিলেন। সেটি সত্য। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সেই মতামতকে কতটুকু গ্রাহ্য করা হয়েছে? অনেক ক্ষেত্রেই গ্রহণ করা হয়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তৃণমূলের মতামতকে প্রভাবিত করা হয়েছে। শুনেছি যে, তৃণমূলের সংশ্লিষ্টদেরও মাথা কেনাবেচাও হয়েছে। এ অবক্ষয় থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চা বাড়ানোর পাশাপাশি কিছু পদক্ষেপও দরকার। নির্বাচনী বিধিতে সদস্য লাভের দুই-তিন বছর অতিক্রান্ত হওয়া কিংবা চাকরি থেকে অবসর বা অব্যাহতির নির্দিষ্ট মেয়াদের আগে নির্বাচনে দাঁড়ানোর সুযোগ না থাকার বিষয়গুলো যৌক্তিক। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের 'প্রাইমারি'র মতো জনসমর্থন বিচারের বিধি বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে, রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন। রাজনীতিকে বাণিজ্য হিসেবে নয়, জনসেবার মনোভাব থেকে দেখতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো এ বোধ ধারণ করলে রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন হওয়া সম্ভব। আর এই বোধ যদি নেতৃত্ব ধারণ না করে, তবে নারায়ণগঞ্জের মডেল অনুসরণ করেই তৃণমূলের নেতাকর্মী ও নাগরিক সমাজকে এগোতে হবে।

আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com

No comments

Powered by Blogger.