মেহসুদ কি সত্যিই মারা গেছেন -পাকিস্তান by হামিদ মীর

পাকিস্তানে চালকবিহীন মার্কিন বিমান হামলা জনপ্রিয় নয়। তবে এই প্রথমবারের মতো তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের প্রধান বায়তুল্লাহ মেহসুদের নিহতের খবরে অনেক পাকিস্তানিই খুশি। ৫ আগস্ট পাকিস্তানের দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে মার্কিন বিমান হামলায় তিনি নিহত হন বলে খবরে জানা যায়। বায়তুল্লাহ মেহসুদ ছিলেন পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’। একই সঙ্গে পাকিস্তানিদের কাছে তিনি নৃশংস ব্যক্তি হিসেবেও পরিচিত। দেশজুড়ে কয়েক ডজন আত্মঘাতী হামলার পেছনে তাঁর ভূমিকা রয়েছে। তবে পাকিস্তান সরকারও তাঁর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করার ব্যাপারে দ্বিধায় আছে।
গত শুক্রবার মার্কিন গণমাধ্যমে বায়তুল্লাহর মৃত্যুর খবরটি বের হয়। গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কোরেশিও বায়তুল্লার মৃত্যুর ঘটনা নিশ্চিত করেন। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রেহমান মালিক বক্তব্য দেন সতর্কতার সঙ্গে। গত শনিবার সকালে দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানের একজন জ্যেষ্ঠ সিনেটর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেন, বায়তুল্লাহ নিহত হননি। আর এ কারণে বায়তুল্লার মৃত্যুর ঘটনা এখনো নিশ্চিত করেননি রেহমান মালিক। জ্যেষ্ঠ তালেবান কমান্ডার হাকিমুল্লাহ মেহসুদেরও দাবি, বায়তুল্লাহ নিহত হননি। অনেক পাকিস্তানিরই ধারণা, পাকিস্তানের ৬২তম স্বাধীনতা দিবসের ঠিক কয়েক দিন আগে বায়তুল্লাহ মেহসুদ নিহত হয়ে থাকলে তা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে একটি বড় ধরনের উপহার হবে। তবে একই সঙ্গে সাধারণ কিছু প্রশ্নও সামনে এসেছে।
গত বছর থেকেই পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনী বলা শুরু করে, বায়তুল্লাহ মেহসুদ মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের স্বার্থে কাজ করছিলেন। তাই চালকবিহীন মার্কিন বিমান থেকে তাঁকে লক্ষ্য করে কখনোই হামলা চালানো হয়নি। এ ষড়যন্ত্রতত্ত্বই পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে আত্মঘাতী হামলার সংখ্যা বাড়িয়েছিল। ২০০৭ সালে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা বায়তুল্লাহ মেহসুদকে লক্ষ্য করে হামলা করার জন্য বহুবার মার্কিন বাহিনীকে অনুরোধও করেছিল। কিন্তু তাতে মার্কিন বাহিনীর মন গলেনি। উপরন্তু মার্কিন বাহিনীর ধারণা ছিল, মৌলভী নাজির, হাফিজ গুল ও সিরাজউদ্দিনের মতো জঙ্গিদের খুঁজে বের করতে আইএসআই ঠিকমতো সহযোগিতা করেনি। এসব জঙ্গিনেতা আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনীর ওপর হামলা চালাচ্ছে। আফগানিস্তানে যুদ্ধ করছে এমন জঙ্গিনেতাদের সঙ্গেই কেবল পাকিস্তান শান্তি চুক্তি করেছিল। তবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে শীর্ষস্থানীয় পদে রদবদলের মধ্য দিয়ে পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে শুরু করে।
তালেবান ও আল-কায়েদাবিরোধী সমন্বিত অভিযানের শুরুটা ছিল কয়েক মাস আগে। বায়তুল্লাহর মাথার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ৫০ লাখ ডলার এবং পাকিস্তান পাঁচ কোটি রুপি পুরস্কারও ঘোষণা করে। কয়েক সপ্তাহ আগে দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানের কারি জায়েনউদ্দিন পাকিস্তানি গণমাধ্যমে বক্তব্য দেন। ওই সাক্ষাত্কারে তিনি দাবি করেন, বায়তুল্লাহ যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের পক্ষে কাজ করছেন। বিদ্রোহী জঙ্গিনেতা হিসেবে জায়েনউদ্দিন পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সমর্থনপুষ্ট। তাঁর এমন দাবি বেশ বিভ্রান্তিরও জন্ম দিয়েছিল। ওই সাক্ষাত্কারের কয়েক দিনের মধ্যেই দারা ইসমাইল খানে বায়তুল্লাহ হত্যা করেন জায়েনউদ্দিনকে। সেটা গত ২৩ জুনের ঘটনা। আর এর মধ্য দিয়ে বায়তুল্লাহর বার্তা ছিল, পাকিস্তানে যেকোনো সময়, যেকোনো স্থানে যে কেউ তাঁর লক্ষ্য হতে পারে।
কারি জায়েনউদ্দিনের মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ পর এখন পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা দাবি করছে, চালকবিহীন মার্কিন বিমান হামলায় বায়তুল্লাহ নিহত হয়েছেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকাভুক্ত বায়তুল্লাহকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য পাকিস্তান সরকার কি সিআইএকে পাঁচ কোটি রুপি দেবে? মার্কিন বিমান হামলায় দুর্ঘটনাবশত কি এ নিহতের ঘটনা? পাকিস্তানের গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় ছাড়া সিআইএ এ হামলা চালাতে পারে না। তাই সিআইএর কাছ থেকে পাকিস্তানের কে পাবে ৫০ লাখ ডলার? পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী কি প্রকাশ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে ধন্যবাদ জানাবেন? কিংবা তাঁরা কি পাকিস্তানে চালকবিহীন মার্কিন বিমান হামলার নিন্দা জানাবেন?
অতীতে আস্থার কিছু ঘাটতি থাকলেও এখন এটা স্পষ্ট যে, মার্কিন ও পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা পরস্পর ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে তিন দিক থেকে পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনী বায়তুল্লাহকে ঘিরে ফেলেছিল। আর সিআইএকে কারও দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই তিনি মার্কিন বিমান হামলার শিকার হন। কিছু পাকিস্তানির গোপন সহযোগিতার ভিত্তিতেই যে মার্কিন বিমান হামলা চলছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে সরকার বরাবরই এসব হামলার নিন্দা করে আসছে। সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় পাকিস্তানের এখন প্রয়োজন স্বচ্ছ ও জোরদার নীতি। আমরা যদি মার্কিন বিমান হামলায় সহযোগিতাই করি, তবে প্রকাশ্যে সরকারের এর নিন্দা করা উচিত নয়। এতে কেবল বিভ্রান্তিই তৈরি হয়। আর পাকিস্তান সরকারও বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়। বিশ্বাসযোগ্যতা ছাড়া একটি সরকার সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা করতে পারে না। বায়তুল্লাহ মেহসুদ যদি নিহত হন আর আমাদের সরকার যদি খুশি হয়, তাতে পাকিস্তানে চালকবিহীন মার্কিন বিমান হামলা বৈধতাই পাবে। আর ভবিষ্যতে ওই হামলার নিন্দা জানানোরও সুযোগ হারাবে সরকার। এ কারণেই হয়ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাকে বলেছিলেন, ‘বায়তুল্লাহ মেহসুদ নিহত হলেও আমি পাকিস্তানে চালকবিহীন মার্কিন বিমান হামলাকে নিন্দা করি।’
আমাদের অবশ্যই অতীত থেকে শিক্ষা নিতে হবে। বায়তুল্লাহ মেহসুদ পাকিস্তানি কায়েমি গোষ্ঠীরই তৈরি তা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। ২০০৫ সালে ফেব্রুয়ারিতে আব্দুল্লাহ মেহসুদের বিরুদ্ধে বায়তুল্লাহ মেহসুদের সমর্থন পেতে আমরা ব্রিগেডিয়ার (অব.) কাইয়ুম শেরকে ব্যবহার করেছিলাম। তখন বায়তুল্লাহ মেহসুদের সঙ্গে প্রথম শান্তিচুক্তি অনুমোদন করেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল সফদার হুসাইন। আর সেই চুক্তির ভিত্তিতে বায়তুল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের সেনা প্রত্যাহার করতে সম্মত হয়। সেনা প্রত্যাহারের পাঁচ মাসের মাথায় বায়তুল্লাহ শান্তিচুক্তি ভেঙে দেন। আর পরের মাসেই তিনি ২৪৩ পাকিস্তানি সেনাকে অপহরণ করেন। ২০০৭ সালের ৪ নভেম্বর বায়তুল্লাহর সঙ্গে আরেকটি গোপন সমঝোতার মাধ্যমে ওই সেনাদের ছাড়িয়ে আনতে বাধ্য হন মোশাররফ। পরের বছর জানুয়ারিতে পাকিস্তানি কায়েমি গোষ্ঠীর সঙ্গে বায়তুল্লাহর আবারও সমঝোতা হয়। কিন্তু কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তা ভেঙে যায়। প্রতিটি সমঝোতাই ছিল গোপন। জঙ্গিদের সঙ্গে আমরা আর কোনো গোপন সমঝোতা চাই না। শান্তিচুক্তির যদি প্রয়োজনই হয়, তবে তা প্রথমে পার্লামেন্টেই আলোচনা করতে হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো, নিজেদের দেশে একটি বেসরকারি মিলিশিয়ার বিরুদ্ধে আরেকটি মিলিশিয়া গঠন করা উচিত নয়। পাকিস্তানের সংবিধানের ২৫৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এমন যেকোনো সংস্থা অবৈধ। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমরা আবারও সোয়াত, বুনের ও দিরে বেসরকারি মিলিশিয়া গঠন করছি। এসব মিলিশিয়া আরও বায়তুল্লাহ মেহসুদের জন্ম দেবে।
আমি এখনো বিশ্বাস করি, বায়তুল্লাহ মেহসুদের মৃত্যুর খবরে আমাদের উল্লসিত হওয়া ঠিক হবে না। তাঁর নেটওয়ার্ক এখনো অক্ষত। তিনি নিহত হলে আমাদের শহরগুলোতে শিগগিরই তাঁর বাহিনী হামলা চালাবে। শারীরিকভাবে তাঁকে সরানো কোনো বিজয় নয়। আমি মনে করি, গোটা দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রচলিত বিধান প্রতিষ্ঠার মধ্যেই আছে প্রকৃত বিজয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, ওই এলাকায় আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। বায়তুল্লাহ জীবিত না মৃত তা আমরা নিশ্চিত নই। তবে আমার কাছে তিনি এখনো জীবিত। দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে সব বিদ্যালয় ভবনে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমেই বোঝা যাবে তিনি মৃত। আর এতে কোনো ভয়-ভীতি ছাড়াই শিক্ষার্থীরা ১৪ আগস্ট উদ্যাপন করবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
হামিদ মীর: ইসলামাবাদে জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক।
hamid.mir@geo.tv

No comments

Powered by Blogger.