কবির জন্য, কবিতার জন্য by মৌলি আজাদ

সেদিন ২০০৪ সালের ১২ আগস্ট। আমাদের বাবা লেখক হুমায়ুন আজাদ তখন জার্মানিতে। আমাদের তিন ভাইবোনের প্রতি তাঁর হূদয়-নিংড়ানো ভালোবাসার কথা তিনটি পৃথক চিঠিতে লিখে সেদিন তিনি এক নির্জন কক্ষে ঘুমাতে গিয়েছিলেন। জানি না ঘুমাতে যাওয়ার আগে কী ভাবছিলেন তিনি। হয়তো আমাদের কথা বা তিনি পরবর্তী সময়ে লিখবেন এমন কোনো বইয়ের কথা। সেই ভাবনাই ছিল তাঁর শেষ ভাবনা। না, এরপর আর তাঁকে আর কোনো কিছুই ভাবতে হয়নি। ভাবতে হবেও না কোনো দিন। কারণ সেই নির্জন কক্ষের নিদ্রাই ছিল তাঁর শেষ নিদ্রা। বাবা যে চিরঘুমের দেশে চলে গিয়েছেন তা আমরা জানতে পারি ১৩ আগস্ট। সাত সকালে হতেই জার্মান দূতাবাসের কর্মকর্তাদের নিমীলিত চোখ দেখেই আমরা তিন ভাইবোন বুঝতে পারলাম, হঠাত্ এক অজানা ঝড়ে বাবা হারিয়ে গেছেন। আর আমরা হারালাম আমাদের সবচেয়ে বড় আশ্রয়। তারপর একে একে কেবল সময় বয়ে যাওয়া। কষ্ট আর সান্ত্বনাই হলো আমাদের সম্বল। এর মধ্যেই চলছিল আমাদের ভেতরে ভেতরে লড়াই—একটু উঠে দাঁড়ানোর। নিজেদের জন্য, বাবার জন্য। কারণ বাবার স্মৃতিকে কাজের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখতে হবে যে! চিন্তা করলাম কীভাবে তাঁকে নতুন প্রজন্মের কাছে বাঁচিয়ে রাখা যায়। সে সময় তাঁর লিখিত নানা কবিতা, গল্প, উপন্যাসই কেবল চোখের সামনে ভাসছিল। কিন্তু দেখলাম, শেষ পর্যন্ত তাঁর স্বল্প কিন্তু অমর সৃষ্টি কিছু কবিতার লাইন, যেমন ‘আমি জানি সবকিছু নষ্টদের অধিকার যাবে।/কড়কড়ে রৌদ্র আর গোলগাল পূর্ণিমার রাত/নদীরে পাগল করা ভাটিয়ালি খড়ের গম্বুজ/শ্রাবণের সব বৃষ্টি নষ্টদের অধিকারে যাবে—বারবার মাথায় পেরেক ঠোকার মতো করে বাজতে লাগল। মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিলাম, হ্যাঁ, একমাত্র কবিতাই পারে তাঁকে বাঁচিয়ে রাখতে। কবিতা সব সময়ই ছিল তাঁর প্রাণে। প্রেম, ভালোবাসা, সংগ্রাম, আকাঙ্ক্ষা—সবকিছুই তিনি কবিতার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। কিন্তু কীভাবে কবিতা পারবে তাঁকে বাঁচাতে? হ্যাঁ, পারবে। পারবেই। সিদ্ধান্ত নিলাম, ২০১০ সাল থেকে কবিতার (ড. হুমায়ুন আজাদের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী সামনে রেখে ১১ আগস্ট ২০০৯-এ ঘোষণা দেওয়া হয়েছে) জন্য হুমায়ুন আজাদ পুরস্কার প্রদান করা হবে। এই পুরস্কার বরাদ্দ থাকবে দেশে ও প্রবাসে বসবাসরত অসাধারণ তরুণ কবিদের জন্য। এই পুরস্কারটি হবে এমন, যেখানে লেখকের চেয়ে লেখকের বইটিই বেশি পাদপ্রদীপের আলোয় আসবে। এই পুরস্কারটি হবে একদম স্বচ্ছ, নির্ভেজাল ও দলাদলিমুক্ত। বিচারক হিসেবে কাজ করবেন দেশের স্বনামধন্য কবিরা। সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে শুরু করা এই পুরস্কারটি হয়তো একদিন বুকার পুরস্কারের মতোই পরিগণিত হবে, এই আশা রাখি। দেশে ও প্রবাসে অবস্থানরত তরুণ কবিদের বলছি, আশা করছি কবিতার জন্য হুমায়ুন আজাদ পুরস্কার ঘোষণার পর আপনারা আপনাদের মূল্যবান কবিতার বই/বইগুলো মূল্যয়নের জন্য আমাদের কাছে পাঠাবেন। এভাবেই গড়ে উঠতে পারে একজন প্রথাবিরোধী কবি হুমায়ুন আজাদ থেকে লাখো প্রথাবিরোধী কবি হুমায়ুন আজাদ। আশ করি আপনারা আমাদের পাশে থাকবেন।
মৌলি আজাদ: ড. হুমায়ুন আজাদের কন্যা।

No comments

Powered by Blogger.