শেয়ারবাজারে উল্লাস এবং কেলেঙ্কারি by আবু আহমেদ

২০০১ সালের কথা, যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজার বড়ই চড়া। সবাই শেয়ারবাজার নিয়ে বড় মাতামাতি করছিল। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ঋণের দরজাকে খুলে দিয়েছিল। এমবিএ গ্র্যাজুয়েটরা ওয়ালস্ট্রিটের ব্রোকারেজ ও বিনিয়োগ ফার্মগুলোতে উচ্চ বেতনের চাকরিতে প্রবেশ করছিলেন। ওই সময় ওয়ারেন বাফেটকে কিছু লোক জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি এখন শেয়ার কিনছেন না?’ ওয়ারেন বাফেট মুচকি হেসে বললেন, ‘না, আমি কিনছি না। আগে আপনারা কিনতে কিনতে ক্লান্ত হয়ে পড়ুন, পরে আমি শেয়ার কিনব।’
ওয়ারেন বাফেট সেই কথাগুলো বলেছিলেন ব্যক্তিগত পর্যায়ে। পাবলিকলি বললে ওয়ালস্ট্রিটে বড় রকমের পতন ঘটতে পারত। কিন্তু দেয়ালেরও কান আছে। বাফেটের ওই ভাবনা কয়েক মাস পরই ওয়ালস্ট্রিটে ছড়িয়ে পড়ল। মার্চ-এপ্রিলে ওয়ালস্ট্রিটের শেয়ারবাজারে ধস নামে। ওদের টেকনোলজি শেয়ারমূল্য সূচক নাসদাক-এর (Nasdaq) পতন ঘটে মাত্র এক সপ্তাহে ২০০০ পয়েন্টস। এরপর আরও নিচে পড়ে যায়। সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। শুরু হয়ে যায় দোষারোপের পালা। কংগ্রেসও নড়েচড়ে বসল। তারা পতন ঠেকাতে পারল না বটে, তবে নতুন আইন করল, যাতে সামনে আর কেলেঙ্কারি না ঘটে। মূল্য পতন হলে অনেক দোষ বের হয়ে পড়ে। নামকরা অডিটিং ফার্ম আর্থার এন্ডারসনের দোষ ছিল অন্যতম বৃহত্তম অ্যানার্জি কোম্পানি এনরনের ঋণগুলোকে ওই ফার্ম লুকিয়ে ছিল।
আর্থার এন্ডারসেন চিরতরে অডিটিং পেশা থেকে বিদায় নিয়েছেন। আর এনরনের বড় এক্সিকিউটিভরা জেল খেটেছিলেন। আইন করা হলো, অডিটররা পরামর্শক হিসেবে কাজ করতে পারবেন না। ওয়ারেন বাফেট সব সময়ই একজন সফল বিনিয়োগকারী ছিলেন। বাজার গড় মুনাফা যেখানে ১৬ শতাংশ ছিল, বাফেট তাঁর বিনিয়োগকারীদের ২০ শতাংশ করে দিতেন। বাফেট হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলে ভর্তি হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বয়স কম বলে ওই বিজনেস স্কুল তাঁকে ছাত্র হতে দেয়নি। পরে তিনি বিখ্যাত সিকিউরিটি অ্যানালিস্ট বেনজামিন গ্রাহামের ছাত্র হয়েছিলেন। গ্রাহাম বলতেন, পরিসংখ্যানে কী আছে দেখো। আর বাফেট পরিসংখ্যান গুরুত্বপূর্ণ, তবে ম্যানেজমেন্টের গুণগত মান আরও গুরুত্বপূর্ণ।
বাফেট বলতেন, তিনি শেয়ার কিনলে স্টক এক্সচেঞ্জ বন্ধ হয়ে গেলেও কোনো ক্ষতি নেই। তাঁর চুক্তি ছিল তিনি শেয়ার কিনেছেন সহসা বেচার জন্য নয়। ওই সব শেয়ারই তিনি কিনেছেন যেগুলোর ভ্যালু সময়ে কেবল বাড়বে। বাফেট বিশ্বে শীর্ষস্থানীয় ধনী লোক। বাফেট যখন বলছিলেন, অন্যরা শেয়ার কিনে ক্লান্ত হোক, তারপর উনি শেয়ার কিনবেন— এর দ্বারা তিনি এই কথা বোঝাতে চেয়েছেন যে এখন শেয়ারের অনেক বেশি দাম। একদিন অতি উত্সাহ থেমে যাবে, যখন শেয়ারমূল্য ইতিহাস কর্তৃক দেয় গড় মূল্যের কাছাকাছি এসে যাবে, তখন শেয়ার কেনা যাবে।
বাফেটের কথা সত্য হতে বেশি দিন লাগেনি। টেকনোলজি শেয়ার মূল্যসূচক শেষ পর্যন্ত ঐতিহাসিক গড়ের স্তরে চলে আসে। তবে ততক্ষণে লাখ লাখ আমেরিকাবাসীর সম্পদের মূল্য দুই-তৃতীয়াংশ হাওয়া হয়ে গেল, যাদের মধ্যে সদ্য পাস করা হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের গ্র্যাজুয়েটসরাও ছিলেন। তাঁদের অনেকের ঋণ ছিল। একদিকে মন্দার কারণে তাঁরা চাকরি হারিয়েছেন, অন্যদিকে ঋণের বোঝা কাঁধে নিয়ে তাঁদের আজও ঘুরতে হচ্ছে। তাঁদের চাকরি হয়তো হবে, তবে তাদের ঋণের বোঝা সহজে শেষ হওয়ার নয়।
ওয়ালস্ট্রিট যখন অতি তুঙ্গে, তখন বিনিয়োগবিমুখ অনেক লোককেও শেয়ার কিনে ধনী হওয়ার স্বপ্ন ঘিরে ধরেছিল। বার্নাড মেড্ফ ছিলেন একসময়ে ন্যাসদাকের চেয়ারম্যান। সবাই তাকে জানত একজন টাকা বানানোর জাদুকর হিসেবে। মেডফ যখন অবসরে যান, তখন তিনিও একটি বিনিয়োগ ফার্ম দিয়ে বসলেন। শত শত লোক শুধু মেডফের নামের ওপর তাঁকে অর্থদিতে লাগল, তার মাধ্যমে বিনিয়োগ করে উচ্চ মুনাফা পাওয়ার উদ্দেশে। কিন্তু মেডফ ছিলেন ধুরন্ধর এক ব্যক্তি। সবাইকে বাইরে থেকে জানান দিতেন আপনাদের দেয় অর্থ ঠিকই আছে, সময়ে ফল পাবেন। অবশেষে মেডফ ধরা পড়ে গেলেন। বিনিয়োগকারীরা খোঁজ নিয়ে দেখলেন, মেডফ তাঁদের অর্থকে কোথাও বিনিয়োগ করেননি, বরং তিনি তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে মিলে দুই হাতে খরচ করছেন। মেডফের বিরুদ্ধে মামলা হয়। মেডফ কোর্টে দাঁড়িয়ে বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে বললেন, ‘আমাকে মাফ করবেন, আমি আপনাদের অর্থকে নষ্ট করে ফেলেছি।’
মেডফের যাবজ্জীবন জেল হয়েছে। তাঁর আইনজীবীরা সাজা কমানোর বা মওকুফের জন্য আর কোনো চেষ্টাই করেননি। মেডফকে বিশ্বাস করে বিনিয়োগকারীরা ৬৫ বিলিয়ন হাতে তুলে দিয়েছিলেন। ওই সব বিনিয়োগকারীর মধ্যে সিএনএনের বিখ্যাত ভাষ্যকার ও উপস্থাপক ল্যারি কিংও আছেন।
দেশে দেশে অতীতেও ‘পুঞ্জি স্কিমে’র বা অতি দ্রুত অর্থ বানানোর ভুয়া প্রকল্পের বহু উদাহরণ ছিল, আজও আছে। কিন্তু মানুষ ভুলে গিয়ে অতি দ্রুত ধনী হতে গিয়ে অনেক বেকায়দার পড়ে। প্রত্যেক শেয়ারবাজারেই জুয়া আছে। আমাদের বাজারেও আছে। অনেকেই মনে করে, জুয়া না থাকলে শেয়ারবাজার কেন, বসে বসে এক দামের দ্রব্য বেচলেই তো হলো। অনেকে আবার জুয়া আর স্পেকুলেশনকে গুলিয়ে ফেলে। স্পেকুলেশন সব ব্যবসাতেই আছে। তবে জুয়াকে রোধ করা হয়, কারণ জুয়া বাজারকে দমিয়ে দিতে পারে বা ধ্বংস করে দিতে পারে। রেগুলেশন ভালো। আবার অতি রেগুলেশন ভালো নয়। কিন্তু সঠিক রেগুলেশন এবং অতি রেগুলশনের মধ্যে বৈধ রেখা টানা মুশকিল। রেগুলেশনের মাত্রা নিয়ে বিতর্ক আগেও ছিল, সামনেও থাকবে।
শেয়ারবাজারকে ঘিরে মামলাও প্রচুর হয়। তবে দেখা যায়, বিনিয়োগকারীরাই ‘ঠগবাজদের’ বিরুদ্ধে মামলা করছে। কিন্তু আমাদের এই বাজারে ব্যাপারটা উল্টো। ঠগবাজেরাই মামলা করে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থকে আটকে দিয়েছে। ঢাকার শেয়ারবাজারে বিরাট একটা অংশ এখন কোর্টের এখতিয়ারে। কেউ জানে না ওইসব আটকে পড়া ব্যাংকিং কোম্পানি, বীমা কোম্পানি এবং মিউচুয়াল ফান্ডগুলো কখন কোর্ট থেকে ছাড়া পাবে। বিনিয়োগকারীরা শুধু অপেক্ষায় আছেন। এই ছোট্ট বাজারটার আজ যেটা বড় সমস্যা, সেটা হলো এইখানে ক্রেতা আছে অনেক, কিন্তু শেয়ার বিক্রেতা কম। ফলে শেয়ারবাজারের মূল্যসূচক বাড়লে অনেকের ভয় ধরে যায়। সমাধান হলো শেয়ার সরবরাহ বাড়ানো। আমরা এ ব্যাপারে সরকারকে বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।
আবু আহমেদ: অর্থনীতিবিদ; অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.