আবরার হত্যাকাণ্ড এবং ছাত্র রাজনীতি থেকে শেখ হাসিনার ভারত সফর নিয়ে প্রশ্ন :-বিবিসি বাংলা'র মেইলবক্স

বুয়েট ছাত্রাবাসে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড নিয়ে অনেক কথাবার্তা, বাক-বিতণ্ডা হচ্ছে। ছাত্র রাজনীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলছে। এসবের মধ্যে যোগ হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের লাভ-লোকসানের খতিয়ান নিয়ে আলাপ আলোচনা।
আবার কিছু কিছু লোক দু'টোর মধ্যে যোগসাজশও খুঁজে পাচ্ছেন, বিশেষ করে বিবিসি বাংলার একটি প্রতিবেদন নিয়ে। যেমন লিখেছেন দিনাজপুরের পার্বতীপুর থেকে মিনহাজুল ইসলাম তারেক:
''সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের যে সংবাদ বিবিসি বাংলা প্রথম প্রকাশ করে তাতে বলা হয় - জ্বালানি সঙ্কটের মধ্যে বাংলাদেশ এই প্রথমবারের মতো তাদের প্রাকৃতিক গ্যাস ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে রফতানি করবে। বিষয়টি ভুল হয়েছে বুঝতে পেরে পরে আপনারা সংশোধনীও দেন। তবে এর আগেই বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়!
''অনেকেই বলছেন, বুয়েটের নিহত ছাত্র আবরারও এই খবরটির ওপর ভিত্তি করে নিজের ফেসবুক পেজে একটি স্ট্যাটাস দেন, যেখানে গ্যাস রফতানির বিষয়টি উল্লেখ করেন তিনি। এখানে বিবিসি বাংলা'র কাছে আমার প্রশ্ন, আপনাদের ভুল সংবাদ পরিবেশনের উপরই যদি আবরার স্ট্যাটাস দিয়ে থাকে আর এই স্ট্যাটাসই যদি তার জীবনের কাল হয়ে থাকে, তবে বিবিসি বাংলা কি এক্ষেত্রে তাদের দায় এড়াতে পারে?''
দায় থাকলে না এড়ানো বা না এড়ানোর প্রশ্ন আসবে মি. ইসলাম। কিন্তু এখানে বিবিসি বাংলার দায় কেন থাকবে? আপনি যদি এই চিঠি লেখার আগে একটু রিসার্চ করতেন, তাহলেই দেখতে পেতেন আবরার ফাহাদ কোন ভাবেই বিবিসি বাংলার খবর দেখে কিছু লিখতে পারে না। কারণ, তার সেই স্টেটাস পোস্ট করা হয়েছিল ৫ই অক্টোবর বাংলাদেশ সময় বিকাল ৫টা ৩২ মিনিটে। আর বিবিসি বাংলার রিপোর্টের প্রথম সংস্করণ, যেটায় ভুল তথ্য ছিল, সেটা প্রকাশ করা হয়েছিল ৫ই অক্টোবর রাত ৯টা ৩৮ মিনিটে। অর্থাৎ আবরার তার স্টেটাস বিবিসি বাংলার রিপোর্টের চার ঘণ্টা আগে পোস্ট করেছিল। তাহলে কীভাবে বলবেন আবরারের স্টেটাসের সাথে বিবিসি বাংলার রিপোর্টের কোন সম্পর্ক ছিল? এটা উদ্ভট একটা প্রশ্ন।
এখানে আরেকটি কথা সোজা-সাপটা বলে রাখা ভাল। যেসব ছাত্র বা নেতারা আবরারকে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছে, তারাই এই খুনের জন্য দায়ী। অন্য কারো দায় এখানে নেই। আপনাকে ধন্যবাদ।
দায় অন্যের ঘাড়ে চাপানোর কৌশল নিয়ে লিখেছেন খুলনা থেকে মুনির আহম্মদ:
''একজন মন্ত্রীর কথা উদ্ধৃত করে যখন 'জনকণ্ঠ' পত্রিকায় শিরোনাম হয়, 'বিবিসির প্রচারিত সংবাদের কারণে আবরার ফাহাদের এই নির্মম মৃত্যু' তখন আমরা ব্যথিত হই। এদেশে হলুদ সাংবাদিকতার এ রকম উদাহরণের অভাব নেই। মন্ত্রী মহোদয় হয়তো অনেক কথা বলতে পারেন, তবে বিবিসির ভুল সংবাদের কারণে আবরার ফাহাদ পোস্ট দিয়েছে আর সেই কারণে ছাত্রলীগ দ্বারা নির্মমভাবে হত্যাকে জায়েজ করার এক কূটকৌশল কি কোন সংবাদ মাধ্যম প্রকাশ করতে পারে?
''সত্যিই আমি অবাক হই এদেশ আজ কোথায় চলেছে। শামসুর রাহমানের একটা কবিতার বইয়ের কথা মনে পড়ে গেলো, "উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ।''
আমি একটু আগে এই কথাই বলছিলাম, মি. আহম্মদ। কে কখন পোস্ট দিল সেটা ঠিকমত না দেখেই আবোল-তাবোল বক্তব্য অনেকেই দেন। তবে সাংবাদিক বা রাজনীতিকদের কাছ থেকে আরো দায়িত্বশীল আচরণ আশা করা যায়। আর একটা হত্যাকাণ্ড নিয়ে এরকম কূটকৌশল মোটেই কাম্য নয়। আপনাকে ধন্যবাদ।
বাংলাদেশে ছাত্র সংগঠনগুলোর বর্তমান ভূমিকা নিয়ে লিখেছেন টাঙ্গাইলের সরকারি ম্যাটস থেকে বিলকিস আক্তার:
''বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র দেশের মানুষের জন্য কী কী কল্যাণ অর্জন করেছে? আর ছাত্র সংগঠনগুলো দ্বারা সংগঠিত অকল্যাণগুলোই বা কী? কল্যাণ আর অকল্যাণ দুটির মধ্যে কোনটির পাল্লা ভারী? এসব ভেবে দেখার সময় এখনই। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে, ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়া অত্যন্ত জরুরিও বটে।! কারণ অনেকেই মনে করে, বর্তমান ছাত্র রাজনীতি হচ্ছে আদর্শ-বহির্ভূত রাজনীতি । এ ধরণের রাজনীতির সংস্কার হওয়া অবশ্যই প্রয়োজন।''
একই বিষয়ে লিখেছেন ঢাকার লক্ষ্মীবাজার থেকে জহিন মুমতাহিনাহ:
''আমি মনে করি বাংলাদেশে দ্রুত ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা উচিত, কারণ ছাত্র রাজনীতি এতটাই ভয়ঙ্কর ও বেপরোয়া হয়ে গেছে যে, প্রায়শই কোন না কোন মায়ের বুক খালি হচ্ছে। কলুষিত হচ্ছে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা। ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হলে অনেক অন্যায়, অপরাধ আর সন্ত্রাস স্বয়ংক্রিয়ভাবে কমে যেত।''
আপনাদের দু'জনকেই ধন্যবাদ বিলকিস আক্তার এবং জহিন মুমতাহিনাহ। অনেক বছর ধরেই বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে এবং তার জন্য যে ছাত্র সংগঠনগুলোই দায়ী, তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। তবে অপরাধ রোধ করার জন্য দরকার আইনের প্রয়োগ এবং যথাযথ বিচার। ছাত্র রাজনীতিকে অপরাধ মুক্ত করতে পারলেই ক্যাম্পাসে সুস্থ পরিবেশ ফিরে আসবে বলে আমার মনে হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজনীতি একদম নিষিদ্ধ করার আগে দু'বার ভাবতে হবে।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন ধরণের প্রতিক্রিয়া হয়েছে। যেমন লিখেছেন রাজশাহীর রানীবাজার থেকে হাসান মীর:  
''ভারত আমাদের বন্ধু প্রতিম রাষ্ট্র। 'বন্ধু প্রতিম' অর্থ বন্ধুর মতো, সম্পূর্ণ বন্ধু নয়। বন্ধুত্ব হয় সমানে সমানে, ছোট আর বড়র অসম বন্ধুত্ব প্রকৃত বন্ধুত্ব হয় না। ভারত আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তাই।
''প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর থেকে জানা গেল, বাংলাদেশ ভারতকে ফেনী নদীর পানি দেবে, চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের সুবিধা দেবে, ভারত যাতে বঙ্গোপসাগরে চীনা নৌবাহিনীর আনাগোনার ওপর নজরদারি করতে পারে সেজন্যে বাংলাদেশের উপকূলে রাডার স্থাপন করতে দেবে ইত্যাদি। বিনিময়ে বাংলাদেশ পেয়েছে একগুচ্ছ প্রতিশ্রুতি, যেখানে তিস্তার পানির কথা নেই, গঙ্গার পানি পাওয়া যাবে তবে কেবল বর্ষাকালে, সীমান্ত হত্যা বন্ধ হবে না।
''তারপরেও বলবো , বাংলাদেশ -- ভারত মৈত্রী দীর্ঘজীবী হোক, কারণ ভারতকে বৈরী ভেবে নয়, বন্ধু ভেবেই বাংলাদেশকে টিকে থাকতে হবে।''
বিষয়টি যে জটিল তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই মি. মীর। ভারতের সাথে কূটনৈতিক দর কষাকষিতে বাংলাদেশের হাত তুলনামূলকভাবে দুর্বল এবং বৈরিতা সৃষ্টি করে সে হাতকে শক্তিশালী করা যাবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনা চেষ্টা করছেন ভারত এবং চীনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করতে। কাজটা সহজ না। আপনাকে ধন্যবাদ।
একই বিষয়ে লিখেছেন ঢাকার উত্তরা থেকে শফিকুল, যিনি শুধু একটি নামই ব্যবহার করেছেন:
''এবারের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর ছিল সব দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। আট বছর ধরে ঝুলে থাকা তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির একটি সুরাহা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মানবিক দিক বিবেচনা করে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাবরুম শহরের মানুষের পানীয় জলের চাহিদা মেটাতে ফেনী নদী থেকে ১.৮২ কিউসেক পানি ভারতকে উত্তোলনের সুযোগ দিবে বাংলাদেশ। শুষ্ক মৌসুমে উত্তরাঞ্চলে খরা আর বর্ষা মৌসুমে বন্যা। এই উভয় সংকট নিরসনের জন্য তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি অতীব জরুরি। বাংলাদেশ, ভারতের প্রতি মানবিক আচরণ করলেও ভারত আমাদের প্রতি মানবিক আচরণ করছে না।''
অনেকেই তাই মনে করছেন মি. শফিকুল, এমনকি ভারতের শীর্ষ স্থানীয় পত্রিকাগুলোও ভারতের রাজনীতিকদের প্রতি বাংলাদেশের স্বার্থর কথা ভাবার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। বিশেষ করে আসামের নাগরিক পঞ্জি নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগ দূর করা এবং তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তির কাজ তরান্বিত করার কথা বলা হয়েছে। আপনাকে ধন্যবাদ।
আবার যাচ্ছি বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির বিষয়ে। শুক্রবার আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন নিয়ে লিখেছেন চুয়াডাঙার আলমডাঙ্গা থেকে কাজী সাইদ:
''বিবিসি বাংলার সায়েদুল ইসলামের ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কিত প্রতিবেদনটি খুবই ভাল লেগেছে। সত্যি কথা বলতে, ছাত্র রাজনীতির আসলেই দরকার আছে কিনা, বা থাকলে সেটা ঢেলে সাজানোর দরকার কিনা, তা ভেবে দেখার সময় এখন এসেছে। ভাল রাজনীতিবিদ হতে ছাত্র রাজনীতি করতে হবে, এই যুক্তি আর খাটছেনা। আরেকটি ব্যাপার হল, ছাত্র রাজনীতি শুধু ছাত্রদের উপর প্রভাব ফেলে, তাতো না। এর প্রভাব পরিবারগুলোতে পড়ে মারাত্মক ভাবে। উদাহরণস্বরূপ, আবরার-এর মৃত্যু শুধু আবরার-এর পরিবার নয়, শেষ করবে খুনিদের পরিবার গুলোকেও।''
ছাত্র রাজনীতি এক সময় বাংলাদেশের জন্য গর্বের বিষয় ছিল, কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু ১৯৯১ সালের পর থেকে ছাত্র সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ড যেভাবে চলেছে, তাতে কেউ আর গর্ব করছে বলে মনে হয় না। আজ ছাত্রদের দাবির মুখে বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছে। ঘটনার এখানেই শেষ হবে বলে মনে হচ্ছে না, কারণ সারা দেশে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ না হলেও, ব্যাপক সংস্কারের দাবি যে জোরদার হবে তা নিয়ে সন্দেহ নেই। আপনাকে ধন্যবাদ।
আবরার ফাহাদের পোস্ট, বিকেল ৫টা ৩২ মিনিটে।

No comments

Powered by Blogger.