পিতা-মাতার দ্বন্দ্বে আদর থেকে বঞ্চিত সন্তান: বাড়ছে পারিবারিক মামলা by রাশিম মোল্লা

ছোট্ট সন্তানের সবচেয়ে আপনজন ও নিরাপদ আশ্রয়স্থল পিতামাতা। সন্তানের কষ্ট মা ছাড়া কেউ বুঝতে পারে না। প্রিয় সন্তানের কখন কী লাগবে, না লাগবে তা কেবল মায়ের পক্ষেই বোঝা সম্ভব। কিন্তু বর্তমানে পিতা-মাতার দ্বন্দ্বে বাড়ছে বিচ্ছেদের ঘটনা। পিতামাতার সঙ্গে সঙ্গে সন্তানকেও আলাদা হতে হচ্ছে। সন্তানকে হয় পিতার তত্ত্বাবধানে নয়তো মায়ের তত্ত্বাবধানে থাকতে হয়। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত সাত বছরে রাজধানীতে তালাকের সংখ্যা বেড়েছে শতকরা ৩৪ ভাগ। বিচ্ছেদের আবেদন নিষ্পত্তি করেন এমন কর্মকর্তাদের মতে, স্বামীর বিরুদ্ধে স্ত্রীর করা আবেদনের কারণ হলো, স্বামীর সন্দেহবাতিক মানসিকতা, পরকীয়া, স্বামী প্রবাসে থাকা, যৌতুক, মাদকাসক্তি, ফেসবুকে আসক্তি, ব্যক্তিত্বের সংঘাতে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে।
অপরদিকে, স্বামীর পক্ষে আবেদনের ক্ষেত্রে-স্বামীর ইচ্ছাকে প্রাধান্য না দিয়ে নিজের ইচ্ছায় চলা, বদমেজাজ, সংসারের প্রতি কম মনোযোগ দেয়া, ধর্মকর্মে উদাসীনতা, বন্ধ্যত্বসহ বিভিন্ন কারণে স্ত্রীকে তালাক দিচ্ছে স্বামীরা। উভয়ের মধ্যে তালাক হওয়ার পর শুরু হয় সন্তান কার কাছে থাকবে, তা নিয়ে পিতা-মাতার মধ্যে নতুন দ্বন্দ্ব। সেই দ্বন্দ্ব গড়ায় আদালতে। আর ওই দ্বন্দ্বের শিকার ইসলাম হেজাজী হিসাম, জান্নাতুল ফেরদৌস আরোহী, মায়মুনা ও জান্নাতুল। পারিবারিক আদালতে আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে এমন অনেক মামলা। ঢাকা জেলা জজ প্রশাসনিক শাখা জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ঢাকা জেলা জজ আদালতে (দোহার, নবাবগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, সাভার ও ধামরাই) সিনিয়র সহকারী জজ, ২য় অতিরিক্ত ও পারিবারিক  আদালত সিনিয়র সহকারী জজ, ২য়, ৩য় ও ৫ম অতিরিক্ত ও পারিবারিক  আদালতে  মামলা হয়েছে ২৭৩৩টি। এর মধ্যে সিনিয়র সহকারী জজ, ২য় অতিরিক্ত ও পারিবারিক  আদালতে ৪৪৭টি, সিনিয়র সহকারী জজ, ৩য় অতিরিক্ত ও পারিবারিক  আদালতে ২৮৪ ও সিনিয়র সহকারী জজ, ৫ম অতিরিক্ত ও পারিবারিক  আদালত ২০০২টি। এসব মামলার বেশির ভাগ খোরপোস, দেনমোহর, অভিভাবকত্ব আদায় ও বিবাহ বিচ্ছেদ সংক্রান্ত মামলা। এ ব্যাপারে জেলা লিগ্যাল এইউ অফিসার ও সিনিয়র সহকারী জজ, ঢাকা মো. আলমগীর হোসেন বলেন, বিচ্ছেদের ঘটনা বেড়েই চলছে। কেবল মাত্র চলতি বছরে তাদের মাধ্যমে পারিবারিক আদালতে ১০২২টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৭৪টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এছাড়া বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) হয়েছে ছয়শ’ মামলা।
হিসামের বয়স ১০ বছর। ইংলিশ ভার্সনের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। পিতার সোহাগ আর ভালবাসা দুটো থেকেই বঞ্চিত সে। অর্থের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে তার পড়াশুনা। তাদের পিতামাতা হলেন, তানিয়া আক্তার হিমেল ও রাশেদুল ইসলাম। ২০০৫ সালের ১৪ই নভেম্বরের আগে হিমেল ও রাশেদুল কেউ কাউকে চিনতো না। মোবাইল ফোনে দু’জনের পরিচয়। এরপর চলতে থাকে  প্রেম ভালবাসা। হঠাৎ ২০০৬ সালের ১৪ই মে দুজনে পালিয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। কোনো পরিবারই তাদের এই বিয়ে মেনে নেয় না। বাড্ডায় ভাড়া বাসায় চলে তাদের সংসার জীবন। স্বামী রাশেদুল তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আর হিমেল একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। নিজে পড়ালেখা না করে স্বামীর পড়াশোনায় যাতে ব্যাঘাত না ঘটে সেজন্য হিমেল চাকরির খোঁজে নেমে পরেন। ২০০৭ সালে ইউনিলিভার কোম্পানিতে ২৫০০০ টাকা বেতনের চাকরি শুরু করেন তিনি। এরপর এক দুই বছর পর বিভিন্ন লোকজনের হাতে পায়ে ধরে চাকরি দেন স্বামীকে। কিন্তু এখন স্বামী রাশেদুল সেই স্ত্রীকেই ভুলে গেছেন। তালাক দিয়েছেন। ২০১০ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর তাদের দাম্পত্য জীবনে আসে প্রথম পুত্র সন্তান। পুত্রের নাম রখা হয় ইসলাম হেজাজী হিসাম। বর্তমানে সেই  ছেলের বয়স ১০ বছর। দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে। তবে অর্থের অভাবে এখন তার পড়াশোনা বন্ধ। এরপর ৬ বছর পর ২০১৭ সালের ৫ই ডিসেম্বর জন্ম হয় দ্বিতীয় সন্তানের। তার নাম রাখা হয় জান্নাতুল ফেরদৌস আরোহী। ছোট আরোহীর এখন বয়স দু’বছর। ভালো করে কথা বলতে না পারলেও দরদী কন্ঠে বাবা বাবা বলে ডাকতে পারে। কিন্তু বাবার সঙ্গে তার দেখা নেই বেশ ক’মাস ধরে। 
নথি থেকে জানা যায়, তাহমিনা আক্তার হিমেল বিবাহের পর থেকে স্বামী রাশেদুলের বিভিন্ন ধরনের আর্থিক চাহিদা পূরণের জন্য একাধিক বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন। শুধু তাই নয়। রাশেদুলের পড়াশোনার খরচও বহন করেন। এরই মধ্যে জড়িয়ে পড়েন পর-নারীর সঙ্গে মেলামেশায়। বাড়তে থাকে তার আর্থিক চাহিদা। শুরু হয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। হঠাৎ করেই ২০১৮ সালের ২০শে ডিসেম্বর স্বামী রাশেদুল ইসলাম  শ্বশুর মো. রফিকুল ইসলাম, স্বামীর ভাই মো. রকিবুল ইসলাম ও মো. মনজুরুল ইসলাম, শাশুড়ি মাহবুবা বেগম এর প্ররোচনায় ১০ লাখ টাকা যৌতুক দাবি করে।  এতো টাকা এনে দিতে অস্বীকার করলে বেধড়ক পিটুনি দেয় হিমেলকে। হিমেলের পুরো শরীর মারাত্মকভাবে যখম করা হয়। এ ঘটনায় তিনি মিরপুর মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। জিডির খবর শুনে রাশেদুল সন্তানের উপর চালায় নির্যাতন। কিছুদিন পর ফের হিমেলের কাছে স্বামী রাশেদুলসহ শ্বশুর-শাশুড়ি ও স্বামীর দুই ভাই দশ লাখ টাকা দাবি করে। এবারো হিমেল দিতে অস্বীকার করে। উভয়ের মধ্যে শুরু হয় তুমুল ঝগড়া। এক পর্যায়ে তারা হিমেলকে মারধর করে।
হিমেল জানান, এত কিছুর পরেও তাদের সংসার চলে। একদিন স্বামীর অফিসে গিয়ে জানতে পারি, স্বামী রাশেদুল তারই অফিসের এক কলিগের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে গেছেন। বাসায় এসে স্বামীকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। এক পর্যায়ে তার কুকর্ম ফাঁস করার হুমকি দেন।  পরের দিন জানতে পারি রাশেদুল তাকে ডিভোর্স দিয়েছে। সেই থেকে সন্তানেরও খোঁজ নেয় না রাশেদুল।  
এমনই আরেক ঘটনা ঢাকার দোহারের। জান্নাতুল। বয়স মাত্র দুই বছর। এখনো চোখ দিয়ে পিতাকে দেখতে পারেনি জান্নাতুল। পিতার সোহাগ ভালবাসা থেকে বঞ্চিত জান্নাতুল। ছয়মাস আগে পিতা আবুল হাশেম মা লতিফাকে তালাক দেন। নথি থেকে জানা যায়, ২০১৫ সালের ১৪ই এপ্রিল দোহার উপজেলার জামালচর গ্রামের আবুল হাশেমের সঙ্গে বিবাহ হয় একই এলাকার লতিফার। বিবাহের দেন মোহর ধার্য করা হয় এক লাখ বিশ হাজার টাকা। বিভিন্ন সময় লতিফার পিতা মেয়ের জামাইকে ১ লাখ ৫০ হাজার নগদ  টাকা ও ৫০ হাজার টাকার জিনিস দেন। কিন্তু ফের লতিফার স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি দুই লাখ টাকা যৌতুক দাবি করেন। কিন্তু লতিফা দিতে অস্বীকার করেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় তাদের মধ্যে ঝগড়া, মনোমালিন্য শুরু হয়। এরই মধ্যে সন্তান সম্ভবা লতিফাকে পিতার বাড়িতে দিয়ে যায়। ভূমিষ্ঠ হয় জান্নাতুল। কিন্তু ২ বছরেও তাকে দেখতে আসেনি হাশেম। এমনকি খাওয়া খরচ পর্যন্ত দেন না সন্তানের। দারিদ্র পিতা মেয়েকে নেয়ার জন্য বললেও মেয়ের জামাই কর্ণপাত করছেনা। ছোট্ট শিশুকে একটি নতুন জামা কিনে দিতে পারে না মা লতিফা। ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করাতে পারে না সন্তানকে। এরই মধ্যে লতিফা জানতে পারেন, স্বামী আবুল হাশেম তাকে তালাক দিয়েছে। তাই তিনি আদালতের দারস্থ হয়েছেন। 
ছোট মিশু মায়মুনা। বাবা মায়ের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় জন্মের পর থেকে বেশিরভাগ সময় মায়ের কাছে। মায়মুনার মায়ের নাম আনিকা। পিতার নাম সুমন। ২০০৮ সালের ১৩ই জানুয়ারি উত্তর আদাবরের যুবক সুমনের সঙ্গে বিয়ে হয় আনিকার। কিন্তু মা বাবার সঙ্গে সুসম্পর্ক না থাকায় মায়ের কাছেই থাকে। হঠাৎ করে পিতা সুমন মায়ের কাছ থেকে মায়মুনাকে নিয়ে যায়। আনিকা বলেন, ২০১৪ সালের ৩০শে মার্চ জন্ম নেয় তাদের ফুটফুটে এক কন্যা শিশু। আদর করে মেয়ের নাম রাখেন মায়মুনা। সন্তানকে ঘিরে কাটতে থাকে তার সময়। ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে মেয়ে। বয়স চার বছর। মেয়েকে ভর্তি করা হয় স্কুলে। হঠাৎ চলতি বছরের ২৮শে মে সুমন মেয়ে মায়মুনাকে কারো কাছে কিছু না বলেই নিয়ে যায়। কোথাও খোঁজ মিলে না মায়মুনার। অবশেষে জানতে পারেন, মায়মুনার বাবা মায়মুনাকে নিয়ে গেছে। মেয়েকে আনার জন্য সুমনের বাসায় যায় আনিকা। কিন্তু মায়মুনাকে তারা ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানায়। আজ চার মাস ধরে আদরের সন্তান মায়মুনার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ নেই আনিকার। অপরদিকে, জাওয়াদ ইসলাম। বয়স ৩ বছর। পিতা নাহিদুল ইসলাম ও মা জরিনা মুহাম্মদের মধ্যে বনিবনা নেই। বর্তমানে জাওয়াদ মা জরিনার তত্ত্বাবধানে রয়েছে। পিতা নাহিদ সন্তানের দাবি করে। কিন্তু মা দিতে নারাজ। ফলে, পিতার ভালবাসা থেকে বঞ্চিত জাওয়াদ। এরই মধ্যে গত ৪ঠা ফেব্রুয়ারি মা জরিনা মুহাম্মদ নাবালক সন্তান জাওয়াদ ইসলামের (৩) অভিভাবকত্বের দাবিতে মামলা করেন। মামলার নথি থেকে জানা যায়, ২০১৩ সালের ৮ই মার্চ গুলশানের নাহিদুল ইসলাম নাহিদের সঙ্গে বিয়ে হয় জরিনা মুহাম্মদের। এরপর ২০১৪ সালের ২৯শে জুন জন্ম হয় পুত্র সন্তানের। বনিবনা না হওয়ায় ২০১৭ সালের ৮ই মে তাদের তালাক হয়ে যায়। ফলে প্রতিমাসেই আদালতে আসতে হচ্ছে মা-বাবাকে। একইসঙ্গে আসতে হচ্ছে নাবালক সন্তানকেও।

No comments

Powered by Blogger.