কলকাতার দ্বিতীয় মেট্রোরেল আংশিকভাবে চালু হচ্ছে এ মাসেই by পরিতোষ পাল

ভারতের প্রথম মেট্রোরেল (পাতাল রেল হিসেবে বেশি পরিচিত) যাত্রা শুরু করেছিল কলকাতাতেই। উত্তর ও দক্ষিণের সংযোগকারী এই মেট্রোরেলের প্রথম পর্যায়ের যাত্রার উদ্বোধন হয়েছিল ১৯৮৪ সালের ২৪শে অক্টোবর। এবার সেই দিনটিকেই সামনে রেখে কলকাতার দ্বিতীয় মেট্রোরেল ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর প্রথম পর্যায়ে যাত্রী পরিবহনের উদ্বোধন করার সব ব্যবস্থা পাকা করা হয়েছে। কলকাতার সল্টলেকের সেক্টর ফাইভের সঙ্গে গঙ্গার ওপারে হাওড়া ময়দানের সঙ্গে সংযোগকারী নতুন এই মেট্রোরেলের নাম ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো। এর দৈর্ঘ্য ১৬.৫৫ কিলোমিটার। মোট স্টেশন থাকবে ১২টি। এর মধ্যে ৬টি স্টেশন থাকবে উপরে আর বাকি ৬টি স্টেশন থাকবে মাটির নিচে। দীর্ঘ এই মেট্রোরেলের কাজ ধর্মতলা-শিয়ালদহ অংশের মাত্র কয়েক শ’ মিটার টানেল তৈরির কাজ মাটি ও বাড়ি ধসে যাওয়ার বিপর্যয়ের জন্য বন্ধ রয়েছে।
বাকি অংশের কাজ সম্পূর্ণ হয়ে  গেছে। ভারতে প্রথম পানির নিচ দিয়ে টানেলের মধ্যদিয়ে যাবে এই ট্রেন।  এজন্য গঙ্গার নিচে ৫২০ কিলোমিটার দীর্ঘ টানেল তৈরি হয়েছে। মাত্র দেড় মাসের মধ্যে এই টানেল তৈরি করা হয়েছে আধুনিকতম প্রযুক্তির সহায়তায়। সাম্প্রতিক ধস বিপর্যয়ের ফলে গোটা পথে মেট্রোরেল কবে চালু করা যাবে তা বলতে পারেন নি কলকাতা মেট্রোর রেল করপোরেশনের কর্তারা। আসলে জমি অধিগ্রহণ, পথের পুনর্বিন্যাস এবং লোকালয় সরানোর কাজে নানা বাধার জন্য এই দ্বিতীয় মেট্রো তৈরির কাজ বারে বারে পিছিয়েছে। তবে বার বার তারিখ পরিবর্তনের পর এবার সল্টলেকের সেক্টর ফাইভ থেকে স্টেডিয়াম পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার পথে প্রথম পর্যায়ে মেট্রোর দ্বিতীয় পথে যাত্রা শুরু হবে বলে ঠিক হয়েছে।  এই পথে থাকছে ৬টি স্টেশন। এজন্য একাধিকবার ট্রায়াল রান হয়ে  গেছে। আরেক দফা ট্রায়াল রান হবে আগামী সপ্তাহেই। এসে গেছে আধুনিক রেক। স্টেশনে স্টেশনে আত্মহত্যার প্রবণতা ঠেকাতে বসানো হয়েছে স্বয়ংক্রিয় গেট, যেগুলো গাড়ি এসে স্টেশনে দাঁড়ানোর পর খুলবে। আগামী ২৪শে অক্টোবর কলকাতার দ্বিতীয় এই মেট্রোরেলের প্রথম পর্যায়ে বাণিজ্যিকভাবে যাত্রী চলাচলের সূচনা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হাতেই হবে বলে জানা গেছে। প্রথম পর্যায়ের পর স্টেডিয়াম থেকে ফুলবাগান পর্যন্ত ট্রেন চলাচল চালু হবে আরো কিছুদিনের মধ্যে। এই পর্যায়ের কাজও শেষ হয়ে  গেছে। এর পরের পর্যায়ের ট্রেন চলবে শিয়ালদহ পর্যন্ত। বাকি অংশে ট্রেন চলবে শেষ পর্যায়ে। মেট্রোরেল সূত্রে জানা গেছে, দুই প্রান্তেই পরবর্তী সময়ে আরো কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত প্রসারিত হবে এই ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো। পূর্বদিকে বিমানবন্দরের কাছে তেঘরিয়া পর্যন্ত এবং পশ্চিম প্রান্তে সাতরাগাছি পর্যন্ত এই রেলপথের বিস্তার নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।
দুর্গাপূজা বাণিজ্যে লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান: বিশ্বের বৃহত্তম পথ উৎসব বলে পরিচিতি পেয়েছে বাঙালির দুর্গোৎসব। আসলে বারোয়ারি দুর্গাপূজা মানেই রাস্তায় বা রাস্তার ধারে প্যান্ডেল। আর তাই এর পরিচিতি স্ট্রিট ফেস্টিভ্যাল হিসেবে। তবে এই উৎসবকে ঘিরে যে খরচের মাতামাতি তা নিয়ে অনেকের আপত্তি রয়েছে। কলকাতার পুজোতে কত খরচ হয় তা নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো পূজা কমিটিই মুখ খুলতে চান না। তবে কলকাতার শতাধিক মেগা পূজার বাজেট যে কয়েক কোটির কাছাকাছি তা এই সব পূজার জাঁকজমক দেখলেই বোঝা যায়। তবে পূজা কমিটির কর্তারা এই উৎসব উপলক্ষে আড়ম্বরের জন্য অর্থ ব্যয়কে অপচয় বলতে রাজি নন। বরং তারা মনে করেন, এই অর্থ প্যান্ডেল তৈরির কারিগর, শিল্পী, পুরোহিত, ঢাকি, বিদ্যুৎ সজ্জার কারিগর, মৃৎশিল্পী সহ নানা ক্ষেত্রের এক লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে বছরের ছয় মাস ধরে। পশ্চিমবঙ্গে এ বছর ৩১ হাজারের বেশি দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর অধিকাংশই বারোয়ারি পূজা। তবে বৃহত্তর কলকাতাতে এ বছর প্রায় ৪৫০০ বারোয়ারি পূজা হয়েছে। এর মধ্যে শতাধিক পূজা মেগা পূজা হিসেবে চিহ্নিত। প্রায় ৪০০ পূজা কমিটিকে নিয়ে তৈরি ফোরাম ফর দুর্গোৎসবের প্রেসিডেন্ট কাজল সরকারের মতে, দুর্গাপূজা উপলক্ষে কলকাতাকেন্দ্রিক পূজাগুলোতে প্রায় ৪৫০০ কোটি রুপির লেনদেন হয়। আর গোটা রাজ্যে এর পরিমাণ প্রায় ১৫ হাজার কোটি রুপি। এই অর্থের অনেকটাই আসে করপোরেট সংস্থাগুলো থেকে। কলকাতার প্রায় ১০০০ পূজা কমিটি বিজ্ঞাপন ও ব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে করপোরেট সংস্থার বিশাল পরিমাণ অর্থ  পেয়ে থাকে। তিনি বলেছেন, কলকাতার ৪৫০০ পূজার মধ্যে প্রায় ২০০ পূজার প্রত্যেকটিতে ৫০ জন মানুষের কর্মসংস্থান হয়। বাকিগুলোতে ২০ জন করে। ফলে আর্থিকভাবে প্রকৃত উপকৃত হন এমন মানুষের পরিবারের সদস্যদের ধরে সংখ্যাটি কয়েক লাখ। এদিকে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে তৈরি হচ্ছে গত ছয় দশকে দুর্গাপূজার বাণিজ্যিক বিবর্তনের ধারা নিয়ে একটি আর্কাইভস। যার নেতৃত্বে এই আর্কাইভস তৈরির কাজ চলছে সেই অধ্যাপিকা সুদেষ্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ১৯৬০-এর দশক থেকে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত বিজ্ঞাপনী উপস্থাপনার বিবর্তন এবং ব্যান্ডিংকেই সংগ্রহ করার কাজ চলছে। বাংলার সেরা উৎসবের পরিবর্তনগুলোকে এক ছাতার তলায় আনার চেষ্টা হচ্ছে। এর ফলে গবেষকদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও পূজার বিবর্তন সম্পর্কে ধারণা করতে পারবেন।
বীরাষ্টমী উৎসবের ঐতিহ্য আজও বহমানঃ
পরাধীন ভারতে যুবকদের দেশসেবায় আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে সরলা দেবী চৌধুরাণীর ঐতিহাসিক প্রচেষ্টায় শুরু হয়েছিল বীরাষ্টমী উৎসবের। পরবর্তী সময়ে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর উদ্যোগে তা নতুন মাত্রা পেয়েছিল। কলকাতার পরে ঢাকাতেও জগন্নাথ হল প্রাঙ্গণে আয়োজিত দুর্গাপূজায় ঢাকা অনুশীলন সমিতির প্রতিষ্ঠাতা বিপ্লবী পুলিন বিহারী দাস  বীরাষ্টমী উৎসব করেছিলেন। তিনি নিজেই তার আত্মকথায় বলেছেন, ‘অষ্টমীর দিন বীরাষ্টমী উৎসব হইলো। কতিপয় স্বদেশি সংগীত হইলো,  হেমচন্দ্রের ভারত সংগীত কবিতাটি আবৃত্তি হইলো। লাঠিখেলা ও ছুরি খেলা হইলো। ঢাকায় সেটিই ছিল প্রথম বীরাষ্টমী উৎসব। ওপার বাংলা থেকে কলকাতায় চলে আসার পর তিনি বাগবাজার সার্বজনীন দুর্গোৎসবে নিয়মিত উপস্থিত থেকে বীরাষ্টমী উৎসবে যুবকদের আত্মরক্ষার প্রয়োজনে নানা ধরনের অস্ত্র শিক্ষার কথা বলতেন। শতবর্ষ পার করে আসা বাগবাজার সার্বজনীন দুর্গোৎসবে অষ্টমীর সকালে এই বীরাষ্টমী উৎসবের ঐতিহ্য আজও বহমান। বাগবাজার সার্বজনীন দুর্গোৎসবের অন্যতম কর্ত্রী শিক্ষিকা দেবযানী মুন্সী কথা প্রসঙ্গে বলেছেন, বর্তমান সময়ে এই উৎসবের প্রাসঙ্গিকতা প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু আজও আমরা স্বাধীনতা আন্দোলনের বীরদের স্মরণে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে চলেছি। এখনো অষ্টমীর সকালে পুরনো দিনের মতোই পূজা প্রাঙ্গণে লাঠিখেলা, তরোয়াল খেলাসহ নানা আত্মরক্ষামূলক খেলার প্রদর্শনী হচ্ছে। শুধুই কি ঐতিহ্য ধরে রাখার লক্ষ্যেই বীরাষ্টমী উৎসবের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে? এ প্রসঙ্গে বিপ্লবী পুলিন বিহারী দাসের পৌত্র বিশ্বরঞ্জন দাস জানিয়েছেন, বর্তমান সময়েও নানা অনাচার ও অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য বীরের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু আমরা কি প্রকৃত বীরের সন্ধান  পেয়েছি? বা প্রকৃত বীরকে চিনতে  পেরেছি? এটা ঠিক যে, স্বদেশি আমলে আমাদের সামনে বীরের যে ধারণা ছিল তা আজ প্রযোজ্য হতে পারে না। তখন  দেশমাতৃকাকে মুক্ত করার লক্ষ্যই ছিল প্রধান। এখন প্রেক্ষাপট পাল্টেছে। তবে এখনো যুবকদের সামনে বীরের কর্তব্য রয়ে গেছে। তাই তিনি মনে করেন, বীরাষ্টমী উৎসবের মঞ্চ থেকেই বিপথগামী, আত্মকেন্দ্রিক ও অসহিষ্ণু যুব সমাজকে উদ্ধারের ব্রত নিতে হবে আমাদেরই।
নদী বা জলাশয়ে প্রতিমা ভাসান নিয়ে বিতর্কঃ
গত কয়েক বছর ধরেই পরিবেশবিদরা নদী বা জলাশয়ে প্রতিমা বিসর্জন নিয়ে আপত্তি তুলেছেন। আদালতে মামলা পর্যন্ত হয়েছে। তবে এবার ন্যাশনাল মিশন ফর ক্লিন গঙ্গা’র নির্দেশ ঘিরে প্রতিমার বিসর্জন বা ভাসান নিয়ে তৈরি হয়েছে ফের বিতর্ক। গঙ্গা যে ১১টি রাজ্যের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত সেই রাজ্যগুলোকে এক নির্দেশে গঙ্গা ও তার শাখা-প্রশাখায় প্রতিমা বিসর্জন নিষিদ্ধ করতে বলা হয়েছে। বলা হয়েছিল, নদী বা জলাশয়ের কাছে কৃত্রিম জলাশয় তৈরি করে তার মধ্যে প্লাস্টিকের আস্তরণ দিয়ে প্রতিমা ভাসান দেয়া হোক। পরে প্লাস্টিকের মধ্যে জমা বর্জ্য তুলে নিয়ে নষ্ট করে দেয়া হোক। এই নির্দেশের প্রেক্ষিতে দিল্লিতে যমুনায় এ বছর কোনো প্রতিমা বিসর্জন হয়নি। কিন্তু কলকাতায় গঙ্গায় বিসর্জন এবারও হয়েছে। সরকারি মদতেই হয়েছে এই বিসর্জন। এবারও প্রায় ৫ হাজার দুর্গা প্রতিমা (দুর্গার সন্তানদের ধরে ২০ হাজার) গঙ্গায় বিসর্জন দেয়া হয়েছে। ২০১৭ সালে নদী বা জলাশয়ে প্রতিমা বিসর্জন বন্ধে যিনি জাতীয় পরিবেশ আদালতে মামলা করেছিলেন, সেই সাবেক বিজ্ঞানী অম্বরনাথ সেনগুপ্ত বলেছেন, প্রতিমায় যে রঙ করা হয় তাতে ক্রোমিয়াম, সিসাসহ ক্ষতিকর পদার্থ থাকে। এগুলো পানিতে মিশে জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের ক্ষতি করে। ফলে ক্ষতি হয় জীব বৈচিত্র্যের। অবশ্য নদী বা জলাশয়ে বিসর্জনের বিকল্প নিয়ে পরিবেশবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। কলকাতার এক সরকারি স্কুলের সাবেক শিক্ষিকা তনুশ্রী সেনগুপ্ত বলেছেন, হিন্দু প্রথা অনুযায়ী, আমরা পুজোর প্রতিমা থেকে উপকরণ সবকিছুই পানিতে ফেলি। তবে নদী বা জলাশয়ে প্রতিমা ভাসান কোনো শাস্ত্রের বিষয় নয়। কেননা, দশমীর দিন পুরোহিত মন্ত্র পাঠের মধ্যদিয়ে নিরঞ্জন করার পর সেই প্রতিমা আর চিন্মমী থাকে না। আর প্রকৃত বিসর্জন তো প্রতিমার সামনে থাকা ঘটের পানিতে দর্পণের মাধ্যমে  মুখ ও পায়ের প্রতিফলনের মধ্যদিয়েই সমাপ্ত হয়ে যায়। তাই মৃন্ময়ী প্রতিমার নদী বা জলাশয়ে বিসর্জনে বিতর্কের অবকাশ  নেই। বিষয়টি আসলে বিবেচনার পরিসরে নির্ধারিত হতে পারে প্রতিমা কীভাবে বিলীন করে দেয়া যায়।

No comments

Powered by Blogger.