সুচি কি পারবেন মিয়ানমারকে এক করতে? by এম সাখাওয়াত হোসেন

অং সান সুচি
সপ্তাহ খানেক আগে নিছক ভ্রমণের উদ্দেশ্যে মিয়ানমারের সাবেক রাজধানী, বর্তমানে বাণিজ্যিক নগরী, রেঙ্গুন বা ইয়াঙ্গুনে গিয়েছিলাম। ইয়াঙ্গুনে যাওয়ার উদ্দেশ্যটি ছিল আমাদের আরেক প্রতিবেশী রাষ্ট্রটি দেখা। তবে সংক্ষিপ্ত সফরসূচির কারণে শুধু ইয়াঙ্গুনের নিকটের একসময়ের রাজধানী পেগু বর্তমানে বোগো শহরে গিয়েছিলাম। বোগো শহরে যাওয়ার পথে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তৎকালীন বার্মায় নিহত ব্রিটিশ-ভারত ছাড়াও অন্যান্য দেশের সর্বস্তরের যুদ্ধে হত সৈনিকদের সমাধিক্ষেত্র দেখেছি। সেখানকার তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ২৭ হাজার মৃত সৈনিকের সমাধি রয়েছে ক্ষেত্রটিতে। তবে বেশির ভাগ ছিল নাম না-জানা সৈনিক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিয়ানমারে জাপানিদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি। রেঙ্গুন তথা বার্মা ১৯৪২-৪৫ পর্যন্ত সময়ে জাপানিদের দখলে ছিল। জাপানিদের তত্ত্বাবধানেই তৈরি হয়েছিল বার্মা ইনডিপেনডেন্ট আর্মি। জাপানি বাহিনীকে সহযোগিতা করেছিলেন জেনারেল অং সান এবং বার্মা ইনডিপেনডেন্ট আর্মি। তাদের উদ্দেশ্য ছিল তৎকালীন বার্মা থেকে ব্রিটিশ শাসনের উৎখাত। পরে জাপানিদেরও বিতাড়িত করে বার্মাকে স্বাধীন করা। ওই সময়ে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস কয়েকবার অং সানের সঙ্গে রেঙ্গুনে গোপন বৈঠকও করেছিলেন। দুজনের মধ্যে একধরনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল একযোগে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্ব স্ব দেশকে স্বাধীন করতে কাজ করার। এ দুজনের মধ্যে মধ্যস্থতায় ছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মি. দিনা নাথ, যাঁর বার্মিজ নাম ছিল দত্ত কাহন থেইন থেইয়েন। তিনি তাঁর রেঙ্গুনের বাড়িটির একাংশ ছেড়ে দিয়েছিলেন অং সানকে তাঁর অফিস হিসেবে ব্যবহার করতে। এখানেই গোপন বৈঠক হয় সুভাষ বোস ও অং সানের। ওই বাড়িটি বর্তমানে একটি অভিজাত রেস্তোরাঁ। ‘হাউস অব মেমোরি’ নামে পরিচিত এবং বার্মার তথা ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গিয়েছিলাম ওই বাড়িটি দেখতে, এক বেলা খেয়েওছিলাম রেস্তোরাঁটিতে, যার বর্তমান স্বত্বাধিকারী দিনা নাথের বংশধরেরা। মি. দিনা নাথ পরে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত দিল্লির লাল কেল্লায় এক বছর কারাভোগে ছিলেন। পরে দিনা নাথকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী ভারতের সর্বোচ্চ খেতাবে ভূষিত করেছিলেন। রেঙ্গুন নামটি ১৯৮৯ সালে সামরিক শাসকেরা পরিবর্তন করে রাখেন ইয়াঙ্গুন। নভেম্বর ২০০৫ সালে ইয়াঙ্গুন দেশের রাজধানীর মর্যাদা হারায়। বর্তমানে বার্মা বা মিয়ানমারের রাজধানী ইয়াঙ্গুন থেকে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার দূরে অত্যন্ত পরিকল্পিত নতুন শহর নাইপেডুতে। তবে এখনো বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের দূতাবাসগুলো ইয়াঙ্গুনেই রয়ে গেছে। তৎকালীন বার্মা ভারতের স্বাধীনতার প্রায় এক বছর পর ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি স্বাধীনতা লাভ করে। তবে স্বাধীনতার সূর্য দেখে যেতে পারেননি বার্মার স্বাধীনতার স্থপতি জেনারেল অং সান, যাঁর রাজনৈতিক ও রক্তের উত্তরাধিকারী বর্তমান এনএলডির নেতা অং সান সু চি। জেনারেল অং সান স্বাধীনতার কয়েক মাস আগে জুলাই ১৯৪৭ সালে কথিত বিরোধী আততায়ীর হাতে মৃত্যুবরণ করেন।
আততায়ীর হাতে মৃত্যুর আগে অং সান যে কয়টি কাজ করে গিয়েছিলেন তার মধ্যে প্রধান ছিল বার্মার পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ এবং বিবদমান তিনটি গোষ্ঠীর—শান, কারেন ও চিনাদের সঙ্গে স্বায়ত্তশাসন নিয়ে একটি সমঝোতায় পৌঁছানো। এসব উপজাতীয় অঞ্চল এবং উপজাতীয়রা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির সঙ্গে সহযোগিতায় ছিল, বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, স্বাধীন সত্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশের জন্য। কিন্তু তেমনটা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি করেনি। কেন ওই সব অঞ্চলকে স্বাধীন করেনি তার প্রধান কারণ চীনের সঙ্গে বর্তমানে এই তিন রাজ্যের ভূকৌশলগত অবস্থান।
অং সান পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার যে সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন, তার অন্যতম সহযোগী ছিলেন বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা, যাঁরা নিজেরাও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ছিলেন। যা-ই হোক, ১৯৪৭ সালে অং সান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট এটলির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে বার্মার স্বাধীনতা নিশ্চিত করেন। এর ঠিক দুই সপ্তাহ পরে অং সান প্যানগ্লোনগ কনফারেন্সে তিন গ্রুপের সঙ্গে স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার চুক্তি করেন। কারণ, তিনি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রশাসকদের বার্মা বিভাজনের কোনো অজুহাতই দিতে চাননি। বার্মা স্বাধীন হয়েছিল অং সানের মৃত্যুর পর। ১৯৪৮ থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত বার্মা চারটি বহুদলীয় নির্বাচন দেখেছে কিন্তু অং সানের সঙ্গে সম্পাদিত তিন প্রধান উপজাতীয়দের সঙ্গে চুক্তি বাস্তবায়িত হয়নি। উপরন্তু বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য অঞ্চলে, যার মধ্যে রোহিঙ্গা–অধ্যুষিত আরাকান, যার বর্তমান নাম রাখাইন অঞ্চলও যুক্ত হয়। বর্তমান মিয়ানমারের অন্যতম আন্তর্জাতিক সমস্যা রোহিঙ্গা ইস্যু। রোহিঙ্গারা আগের নির্বাচনে অং সান-কন্যা সু চিকে সমর্থন করেছিল কিন্তু এবারের নির্বাচনে অভিযোগ রয়েছে যে রোহিঙ্গা মুসলমানেরা ভোট দিতেও পারেননি।
বর্তমানে পাঁচটি বৃহৎ অঞ্চলে বিদ্রোহী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে যুদ্ধরত অবস্থায় রয়েছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতময় পরিবেশ আধুনিক বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে লম্বা সময় ধরে চলমান অভ্যন্তরীণ সংঘাত বা সিভিল ওয়ার। বর্তমানে ১৫টি বিভিন্ন গোষ্ঠী মিয়ানমারে যুদ্ধরত অবস্থায় রয়েছে।
১৯৬২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সরাসরি সামরিক শাসন মিয়ানমারে যেমন গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক হয়নি, তেমনি সম্পদের সুষম বণ্টন থেকে বিভিন্ন অঞ্চলের উন্নয়ন একই পর্যায়ে হয়নি। মিয়ানমারের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৫ কোটি ১০ লাখ, যার ৬৮ শতাংশ বার্মিজ। সামরিক জান্তা বার্মিজ–অধ্যুষিত মধ্য মিয়ানমারকেই তাদের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। সিংহভাগ অবকাঠামোগত উন্নতি এই অঞ্চলেই দৃশ্যমান। বার্মিজ ও রাখাইনদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। বর্তমানে মিয়ানমারে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দারুণ প্রভাব রয়েছে রাজনীতি ও সমাজের ওপর। বৌদ্ধ ভিক্ষুরাই প্রথম ইংরেজবিরোধী বৃহৎ আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিল। এখনো এদের প্রভাব সামরিক বাহিনীর এবং রাজনীতির ওপরে রয়েছে, তা সর্বজনবিদিত নেত্রী সু চির কয়েকটি সাক্ষাৎকার এবং রোহিঙ্গা বিষয়ে তাঁর মৌনতা প্রমাণ করে যে তিনি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের প্রভাবমুক্ত নন। এদের প্রভাব আরও বাড়ে ১৯৬২ সাল থেকে সামরিক শাসনামলে। চিরন্তন প্রথামতে, সামরিক সরকার ধর্মীয় অনুভূতিকে দারুণভাবে ব্যবহার করছে। অং সান সু চি পারবেন কি না ধর্মীয় প্রভাবের বাইরে গিয়ে বিবদমান গোষ্ঠীগুলোকে এক পতাকার নিচে আনতে বা তাঁর পিতার স্বাক্ষরিত চুক্তিকে বাস্তবায়ন করতে, তা হবে দেখার বিষয়। রেঙ্গুন বা ইয়াঙ্গুন শহরটি ব্রিটিশ শহর, যার গোড়াপত্তন হয়েছিল দ্বিতীয় অ্যাংলো-বার্মিজ যুদ্ধের পর, ১৮৫২ সালে। অত্যন্ত পরিকল্পিত শহর ইয়াঙ্গুন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শহর। চওড়া রাস্তাঘাট। প্রচুর সবুজের সমারোহ এই শহরে। রাস্তায় প্রচুর ট্রাফিক কিন্তু এই অঞ্চলের অন্যান্য শহরের মতো হর্নের কোনো আওয়াজ নেই। রেঙ্গুন আমার দেখা এই উপমহাদেশ বা অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং ডিসিপ্লিনড পরিবেশবান্ধব শহর। তবে এ পরিবেশ কত দিন থাকবে তা বলা যায় না। কারণ, ইতিমধ্যেই বহুজাতিক কোম্পানির ভিড় যেমন শুরু হয়েছে, তেমনি আকাশচুম্বী দালানকোঠার দাপট শুরু হয়েছে। হয়তো একদিন ঢাকার মতো রেঙ্গুন বা ইয়াঙ্গুনও হারিয়ে যাবে। অর্থনৈতিকভাবে মিয়ানমার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম দরিদ্র দেশ, অথচ সম্পদে ভরপুর। শুধু বনজ, খনিজ সম্পদ এবং কৃষিই এ দেশকে সমৃদ্ধ করতে যথেষ্ট। এখনই মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৪০০ মার্কিন ডলারের ওপরে। তথাপি দারুণ দারিদ্র্যপীড়িত অন্য অঞ্চলগুলো। গ্রামগুলোর হাল অত্যন্ত নাজুক। মাত্র ৪০ শতাংশ মিয়ানমার জনগোষ্ঠী শিক্ষিত। লম্বা সময়ের সামরিক শাসনের কারণে তৈরি হয়েছে কিছু সুবিধাবাদী গোষ্ঠী, যাদের হাতে কুক্ষিগত ব্যবসা-বাণিজ্য ও সম্পদ, যার মধ্যে উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তারাও শামিল। তথাপি মিয়ানমার এক বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দেশ। অবশ্য যদি বহুদলীয় গণতন্ত্র ওই দেশে প্রকৃতরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এখনো মিয়ানমারের সচেতন নাগরিকেরা সন্দেহাতীত নন। এর প্রধান কারণ মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সরকার এবং সংসদে উপস্থিতির সাংবিধানিক এখতিয়ার রয়েছে। প্রায় চার লাখের ওপরের সামরিক বাহিনীর ঘোষিত বাজেট ২ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, জিডিপির ৪ শতাংশ।
মিয়ানমারে বহু প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র ফিরেছে কিন্তু অগণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রভাব বহাল রয়েছে। এই প্রভাব কমানোর কোনো উপায় নেই। ভবিষ্যৎই বলতে পারবে জেনারেল অং সান-কন্যা অং সান সু চি মিয়ানমারকে একটি অবিভাজিত জাতিতে পরিণত করতে প্রকৃত গণতান্ত্রিক পথকে কত দূর এগিয়ে নিতে পারেন।
এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
hhintlbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.