মজার গণিত by আব্দুল কাইয়ুম

গণিত অলিম্পিয়াড
আমরা ক্লাস টু-থ্রিতে পড়ার সময় ধাঁধা ধরতাম, ‘শুভংকরের ফাঁকি, ৩৬ থেকে ৩০০ (তিন শ) গেলে কত থাকে বাকি?’ সবাই হোঁচট খেত। কারণ, একটি ছোট সংখ্যা থেকে এত বড় সংখ্যা আবার বিয়োগ হয় নাকি? আমরা তো তখন ঋণাত্মক সংখ্যা নিয়ে হিসাব করার কথা জানতাম না। কিন্তু এর একটা উত্তর ছিল। বিয়োগ ফল ৩৩! কারণ, ৩০০ আসলে ব্যঞ্জনবর্ণের তিনটি শ, ‘শ, ষ ও স’, আর ৩৬ হলো ব্যঞ্জনবর্ণের সংখ্যা, যা ধাঁধায় ৩৬ বলে ধরা হয়েছে। তাহলে এই ৩৬ থেকে তিনটি শ, অর্থাৎ ৩ বিয়োগ করলে তো ৩৩-ই থাকবে! এই ধাঁধার মধ্যে দুটি বিষয় ছিল। এক হলো, গণিত নিয়ে চালাকির খেলা করা যায়। দ্বিতীয়, গণিতের মধ্যেও মজার অনেক কিছু আছে। কিন্তু এখন গণিত আছে, মজা নেই। কারণ, একে শুধুই পুঁথিগত বিদ্যায় পরিণত করা হয়েছে। অথচ গণিতে আনন্দ পেলে জ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশের দরজা খুলে যায়। ডাচ ব্যাংক-প্রথম আলো গণিত উৎসব ও প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে দেশে শিক্ষার্থীরা গণিতের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। প্রতিবছর আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ ও রুপা-ব্রোঞ্জপদক জিতে আনছে। হার্ভার্ড, এমআইটি, স্ট্যানফোর্ড, কেমব্রিজসহ বিশ্বের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ বৃত্তি দিয়ে তাদের উচ্চশিক্ষার জন্য নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের শিক্ষার্থীরা যে গণিত, তথা বিজ্ঞানে আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছে যাচ্ছে, তা সুবিদিত। গণিতচর্চা মেধার বিকাশ ঘটায়। কিন্তু মজা না পেলে শিক্ষার্থীরা সেদিকে যেতে চায় না। অথচ গণিতে যে কত মজার বিষয় আছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ছোটখাটো অনেক হিসাব-নিকাশ করতে হয়। যেমন দুজনকে বই উপহার দিতে হবে। ৩০০ ও ২৫০ টাকা দামের দুটি বই কিনলাম। দামের ৩০ শতাংশ ছাড়। এই হিসাব কিন্তু মনে মনে করা যায়। প্রতি শ-এ ৩০ টাকা, তাই ৩০০ টাকায় ছাড় ৯০ টাকা। একইভাবে ২৫০ টাকায় ছাড় ৭৫ টাকা। তাহলে ৩০০ টাকা ও ২৫০ টাকার দুটি বইয়ে ৯০ + ৭৫ = ১৬৫ টাকা ছাড় পাওয়া যাবে। ওই টাকায় বাচ্চাদের জন্য ২০০ টাকার বই কিনতে ছাড় পাব ৬০ টাকা, দাম দিতে লাগবে ১৪০ টাকা। হাতে থাকবে আরও ২৬ টাকা। ওই টাকায় মজা করে কফি-টফিও হয়ে যাবে! এই হিসাবটা মুখে মুখে করে ফেলার মধ্যে যে আনন্দ আছে, তা মোবাইলের ক্যালকুলেটর টিপে বের করার মধ্যে পাওয়া যাবে না! অনেকে মনে করেন, গণিত কিছু সংখ্যার জটিল ও দুর্বোধ্য হিসাব। কিন্তু এর মধ্যেও যে সৌন্দর্য আছে, ছন্দ আছে, তা সাধারণ চোখে ধরা পড়ে না। চলুন, আমরা এক হাজার বছর আগের একটি বছর ধরে দেখি গণিত কত ছন্দময় ও মজার হতে পারে। ধরা যাক, সেটি ১০০১ সাল। এই সালের বৈশিষ্ট্য হলো এটি ৭, ১১ ও ১৩—এই তিনটি মৌলিক সংখ্যার (প্রাইম নম্বর) গুণফল। মৌলিক সংখ্যা বা প্রাইম নম্বর হলো এমন সংখ্যা, যাকে ওই সংখ্যা ও ১ ছাড়া অন্য কোনো সংখ্যা দিয়ে নিঃশেষে, অর্থাৎ অবশিষ্টবিহীনভাবে ভাগ করা যায় না। ২, ৩, ৫, ৭, ১১, ১৩, ১৭, ১৯, ২৩...প্রভৃতি একেকটি মৌলিক সংখ্যা। ১০০১ সালটি ছিল এ রকম তিনটি মৌলিক সংখ্যার গুণফল। এই সালের আরও একটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এটি একটি গাণিতিক প্যালিনড্রোম বা প্রতিসম সংখ্যা। সংখ্যাটি ছন্দময়। একে উল্টিয়ে দেখলেও সেই একই থাকে, ১০০১!
এবার দেখি একে কয়েকটি সংখ্যা দিয়ে গুণ করলে কী হয়:
১০০১ × ৩ = ৩০০৩, একটি প্রতিসম সংখ্যা এবং এর উৎপাদকগুলো সবই মৌলিক সংখ্যা। ১০০১ × ৫ = ৫০০৫, এটিও প্রতিসম এবং উৎপাদকগুলো সব মৌলিক সংখ্যা। ১০০১ × ৩১ = ৩১০৩১, এটিও এক অর্থে প্রতিসম, যদি ৩১-কে একটি সংখ্যা হিসাবে বিবেচনা করি, উৎপাদকগুলো মৌলিক। ১০০১ × ১২১ = ১২১১২১, পূর্ণ প্রতিসম সংখ্যা এবং উৎপাদকগুলোও মৌলিক সংখ্যা। ১০০১ × ৫৫৫ = ৫৫৫৫৫৫, পূর্ণ প্রতিসম, উৎপাদকগুলো মৌলিক। ১০০১ × ৩৩৩৩ = ৩৩৩৬৩৩৩, পূর্ণ প্রতিসম, উৎপাদকগুলো মৌলিক। ১০০১ × ৪৪৪৪৪ = ৪৪৪৮৮৪৪৪, পূর্ণ প্রতিসম!
একইভাবে পরের শতাব্দীর একটি বছর, ২০০২ নিয়ে হিসাব করলে চমকপ্রদ প্রতিসম সংখ্যা পাওয়া যাবে। যেমন, ২০০২ × ৩৩৩ = ৬৬৬৬৬৬, ২০০২ × ২২২২ = ৪৪৪৮৪৪৪, ২০০২ × ১১১১১ = ২২২৪৪২২২!
এবার আরও এক শতাব্দী পরের একটি বছর নিই। তখন হয়তো আমাদের অনেকেই এই প্রিয় পৃথিবীতে থাকব না, তাও, দেখি না কী হয়? মজার একটি সংখ্যা পাওয়া যাবে, ৩০০৩ × ৩৩৩ = ৯৯৯৯৯৯!
আরেকটি মজার ছন্দের ছক দেখুন:
১ থেকে ৯ পর্যন্ত ধারাবাহিক ৯টি অঙ্কে গঠিত সংখ্যাকে ৯ ও এর নয়টি পর্যায়ক্রমিক গুণিতক, অর্থাৎ ৯-এর ২, ৩, ৪,...১০ গুণ সংখ্যা দিয়ে গুণ করলে বেশ মজার ছন্দের সংখ্যা পাওয়া যায়। যেমন, ১২৩৪৫৬৭৮৯ × ৯ = ১১১ ১১১ ১১০১! ১২৩৪৫৬৭৮৯ × ১৮ = ২২২ ২২২ ২২০২! ১২৩৪৫৬৭৮৯ × ৮১ = ৯৯৯ ৯৯৯...এবং ১২৩৪৫৬৭৮৯ × ৯০ = ১১১ ১১১ ১১০১০!
এই ছকের গতিময় ছন্দ মনোমুগ্ধকর।
আব্দুল কাইয়ুম: সহযোগী সম্পাদক।
quayum@gmail. com

No comments

Powered by Blogger.