গুদামে সারের পাহাড় ॥ ভর মৌসুমেও চাষীর আগ্রহ নেই- মার্চের বরাদ্দ তুলতে চাইছেন না ডিলার ॥ নিয়ম শিথিলের অনুরোধ জানিয়ে বিসিআইসিকে চিঠি by কাওসার রহমান

'পেছনে ঘুরলেও' সারের প্রতি আগ্রহ নেই কৃষকের। বোরোর এই ভরা মৌসুমে ইউরিয়া সারে বাজার এতটাই সয়লাব যে, কৃষক সার কিনে ঘরে রাখারও প্রয়োজন বোধ করছে না।
হঠাৎ করেই এবার সারের চাহিদা কমে যাওয়ায় বিপুল পরিমাণ মজুদ নিয়ে বিপাকে পড়েছে বিসিআইসি। ফ্যাক্টরি গুদাম, বাফার গোডাউন কোথাও সার রাখার জায়গা নেই। জায়গার অভাবে গুদামের বাইরে সত্মূপ করে সার রাখা হয়েছে। গুদামের বাইরে সার রাখার কারণে তা বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বর্তমানে বিসিআইসির কাছে সাড়ে পাঁচ লাখ ইউরিয়ার মজুদ গড়ে উঠেছে। তার ওপর আরও প্রায় দুই লাখ টন সার আমদানির পথে রয়েছে। ডিলার পর্যায়েও সাড়ে তিন থেকে চার লাখ টন ইউরিয়ার মজুদ গড়ে উঠেছে। অতীতে ভরা মৌসুমে ডিলার পর্যায়ে এত সার কখনও মজুদ থাকতে দেখা যায়নি। জানুয়ারি-ফেব্রম্নয়ারি মাসে উত্তোলন করা এ সব সার দিয়েই ঘর বোঝাই থাকায় তারা মার্চ মাসের বরাদ্দকৃত সার তুলতে অপারগতা প্রকাশ করছে। ফলে সঙ্কট দূরের কথা বিপুল পরিমাণ ইউরিয়া সারের মজুদই এখন চিনত্মার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মাঠ পর্যায়ে পর্যবেৰণ করে দেখা গেছে, হাট বাজারে পর্যাপ্ত ইউরিয়া সার রয়েছে। কিন্তু চাষীরা প্রয়োজন ছাড়া কেউ সার কিনছে না। সার নিয়ে তাদের মধ্যে কোন আতঙ্কও নেই। 'চাইলেই যখন তখন সার পাওয়া যাবে'- চাষীদের মধ্যে এ ধারণা চলে আসায় তারা কেউ অতিরিক্ত সার ক্রয় করছে না। অন্যান্য সারের দাম কমে যাওয়ায় প্রয়োজন ছাড়া কেউ ইউরিয়া সার ব্যবহার করছে না। ফলে মাঠে সুষম সার ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে ইউরিয়ার চাহিদা কমে গেছে। আগে অন্যান্য সারের দাম বেশি থাকায় এবং ইউরিয়ার দাম কম থাকায় চাষীরা ইউরিয়া সার বেশি ব্যবহার করত। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইউরিয়ার দাম বৃ্দ্ধি করায় এ সারের ব্যবহার কমে গেছে। বেড়েছে সুষম সারের ব্যবহার। উলেস্নখ্য, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৮ সালের জুলাই মাসে ইউরিয়ার দাম টনপ্রতি চার হাজার ৮০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে দশ হাজার টাকা নির্ধারণ করে।
এদিকে ইউরিয়ার দাম বৃদ্ধির কারণে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে বর্তমানে এ সারের দাম বেশি। এ কারণে ভারতের সীমানত্মবর্তী এলাকায় ইউরিয়া সার যাচ্ছে না। মিয়ানমারের ইউরিয়া পাচার বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণে এ বছর দুই থেকে আড়াই লাখ টন ইউরিয়া সাশ্রয় হয়েছে। এসব কারণেই বর্তমানে ইউরিয়া সারের বিশাল মজুদ গড়ে উঠেছে।
বিসিআইসির কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে তাদের কাছে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টনের মতো ইউরিয়া সার মজুদ আছে। এছাড়া কারখানাগুলোতে উৎপাদন এবং বিদেশ থেকে আমদানিও অব্যাহত রয়েছে। ফলে সার নিয়ে এ বছর কোন সঙ্কট হবে না। বরং বিপুল পরিমাণ সারের মজুদ জমে যাওয়ার কারণে নতুন করে সার রাখার জায়গা সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বর্তমানে চার হাজার টন ইউরিয়া সার নিয়ে একটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে অবস্থান করছে। আরও প্রায় আড়াই লাখ টন বিদেশ থেকে আমদানির অপেৰায় আছে। ফলে রাখার জায়গার অভাবে এই সার খালাস করা যাচ্ছে না। কর্মকর্তারা অবশ্য দাবি করছেন, বর্তমানে তাদের কাছে যে সার মজুদ আছে তা মার্চ মাসে ব্যবহার হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার এ্যাসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দ জানান, ফেব্রম্নয়ারির জন্য বরাদ্দ পুরো সার এখনও তারা কারখানা থেকে তোলেননি। কারণ মাঠ পর্যায়ে সার বিক্রি কমে গেছে। ডিলারদের কাছে বিপুল পরিমাণ সারের মজুদ থাকা সত্ত্বেও চাষীরা সার কেনায় এবার আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এতে ডিলার পর্যায়ে সাড়ে তিন থেকে চার লাখ টন সারের মজুদ আছে। মাঠ পর্যায়ে বোরো চাষের যে অগ্রগতি তাতে ডিলারদের কাছে যে সার মজুদ আছে তা দিয়েই বোরো মৌসুম চলে যাবে। এ কারণে ডিলাররা কারখানা ও বাফার গুদাম থেকে মার্চ মাসের সার তুলতে অপারগতা প্রকাশ করছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার এ্যাসোসিয়েশন থেকে বিসিআইসিকে চিঠি দেয়া হয়েছে। চিঠিতে বাধ্যতামূলকভাবে সার তোলার নিয়ম শিথিল করার অনুরোধ জানানো হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে সারের প্রয়োজন থাকলে ডিলাররা নিজ গরজেই সার তুলবে।
সার ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, সরকার চীন থেকে যে সার আমদানি করেছে সেগুলোর ব্যাগের অবস্থা খুবই খারাপ। ব্যাগের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ভেতরে সারের অবস্থাও খারাপ হবে। এ কারণে ডিলাররা ওই সার নিতে চাইছে না। তবে কাতার থেকে সরকারী পর্যায়ে যে সার আনা হয়েছে সেগুলোর মান ভাল।
এ বছর দেশে ইউরিয়া সারের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৯ লাখ ৫১ হাজার টন। এর মধ্যে বিসিআইসির কারখানাগুলোতে উৎপাদিত হবে ১৩ লাখ টন এবং আমদানি করা হবে ১৬ লাখ ৫১ হাজার টন। মূলত দুটি মৌসুমে দেশে ইউরিয়া সার ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে আমন মৌসুমকে মিনি পিক মৌসুম এবং বোরো মৌসুমকে পিক মৌসুম বলা হয়। এবার মিনি পিক মৌসুমে সারের চাহিদা ছিল ছয় লাখ ৬৫ হাজার টন পাঁচ লাখ ১২ হাজার টন বিতরণ করা হয়েছে। অন্যদিকে পিক মৌসুমে ইউরিয়ার চাহিদা হচ্ছে ১২ লাখ ৩২ হাজার টন।
এই চাহিদাকে লৰ্য রেখে এবার আগেভাগেই সার আমদানির প্রস্তুতি নিয়েছে বিসিআইসি। ইতোমধ্যে দেশে দশ লাখ টনের ওপর আমদানিকৃত সার চলে এসেছে। বিসিআইসির কারখানাগুলোতেও এ বছর ১২ লাখ টনের মতো সার উৎপাদিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.