বেতনা নদী দখল হয়ে যাচ্ছে, কোথাও পুকুর, কোথাও দীঘি- ভূমি দস্যুতা সমাচার >< অনুসন্ধানী প্রতিবেদন (শেষ) by সাজেদ রহমান

যশোর অফিস শার্শার ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া বেতনা নদীর অধিকাংশ এলাকা দখল হয়ে গেছে। বিভিন্ন বাজার এলাকায় নদীর উপর তৈরি করা হয়েছে দোকান।
আবার অনেক এলাকায় নদীতে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করা হচ্ছে। তৈরি করা হয়েছে পুকুর। নদী কখনও ব্যক্তিগত জমি না হলেও ভূমি অফিসের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে তা ব্যক্তিগত জমি হিসাবে কারও কারও নামে লিখে দেয়া হয়েছে। ফলে প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে শার্শার কয়েকটি বড় বড় বিল এবং বাঁওড়ের পানি বের হতে পারে না এই নদী দিয়ে। সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতার। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় প্রশাসন বেতনা নদীর দখল হয়ে যাওয়া অংশ উদ্ধারে তৎপর হলেও পরে তা আবার দখল হয়ে গেছে। অবিবেচক মানুষের স্বার্থপরতা তার গতিকে সত্মব্ধ করে দিয়েছে।
বর্তমানে ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার কপোতা নদ থেকে এর উৎপত্তি। মহেশপুর থেকেই প্রবেশ করেছে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চবি্বশপরগনা জেলার বাগদা থানায়। এরপর আবার বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে যশোরের শার্শা উপজেলার শিকারপুর সীমানত্ম দিয়ে। সাতীরার কলারোয়া, সাতীরা সদর হয়ে বুধহাটার পাশ দিয়ে আশাশুনির কাছে নাম হয়েছে খোলপেটুয়া। তখন বিশাল নদী। খোলপেটুয়ার সঙ্গে মিশেছে আরও কিছু ছোট-বড় নদী এবং তার গতিপথ গিয়ে শেষ হয়েছে আড়পাঙ্গাশিয়া এবং অবশেষে মালঞ্চ নামে মিশেছে বঙ্গোপসাগরে।
মেজর রেনেল, যিনি প্রথম ওই অঞ্চলের নির্ভরযোগ্য মানচিত্র তৈরি করেছিলেন, তাতে দেখা যায় বেতনা প্রমত্তা নদী। মূলত মাথাভাঙ্গা-ইছামতি পশ্চিমে আর পূর্বে কপোতাী, এই দুই দণিগামী নদীর সমানত্মরালে বেতনা এক সময় বিসত্মীর্ণ ভূ-ভাগকে সতেজ সবুজ উর্বর ভূমিতে পরিণত হতে সাহায্য করেছিল। পদ্মা থেকে মাথাভাঙ্গা-ইছামতির উৎপত্তি। তা থেকে লোয়ার ভৈরব এবং কপোতাী। আর কপোতাীর শাখা হল বেতনা। ফলে পদ্মায় পানি সঙ্কট মানে গোটা অঞ্চলের নদীতেই পানি সঙ্কট। এই সঙ্কট গত দুই দশকের হলেও বেতনার সমস্যা শুরম্ন হয়েছে আরও আগে এবং বলতে গেলে শুধু বেতনা নয় এই সমস্যা দেশের বহু নদীর। আর তা হলো বল প্রয়োগে নদী দখল। সেখানে বসতি স্থাপন, পুকুর খনন প্রভৃতি অবিবেচক কাজ করা। বেতনার উৎপত্তিস্থল মহেশপুর থেকে শুরম্ন করে ভারতের প্রবেশের স্থান পর্যনত্ম আজ নদীর অসত্মিত্ব বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই। সব চলে গেছে মানুষের দখলে। ভারতীয় এলাকায় নদী দখলমুক্ত করে খনন কাজ চালানো হয়েছে দীর্ঘ এলাকায়। সেখানে মাছের চাষ হয়। পানি দিয়ে চলে সেচ কাজ। তবে ভারতীয়রা অনেক হিসাবী। বাংলাদেশে প্রবেশের আগেই নদীর মুখে সস্নুইসগেট দিয়েছে। বর্ষার অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেয় তারা। শুষ্ক মৌসুমে সস্নুইসগেট গলিয়ে এক ফোঁটা পানিও আসে না বাংলাদেশে।
বেতনা যেখানে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে সেই শিকারপুর পয়েন্ট থেকে আরও দেিণ উলশী পর্যনত্ম কার্যত গোটা নদীই দখলে চলে গেছে আশপাশের অধিবাসীদের। অসংখ্য পুকুর নদীতে। দেখা যায়, নদী এক শ' মিটার প্রশসত্ম হলে তার নব্বই মিটার দখল করে পুকুর খনন করা হয়েছে। পানি যাবার জন্য রাখা হয়েছে মাত্র ১০ মিটার প্রশসত্ম এলাকা। আর এই দখল প্রক্রিয়া চলছে গত অর্ধ শতাব্দী ধরে। গত বাংলা শতাব্দীতে বাংলাদেশে দু'টি ভূমি জরিপ সম্পন্ন হয়। একটি ১৩২৭ এবং অন্যটি ১৩৬০ সালে। প্রথম ভূমি জরিপকালে বাংলা ছিল ব্রিটিশ শাসনের অধীন। ওই সময়কার জরিপ এবং তার ভিত্তিতে তৈরি মানচিত্রে দেখা যায়, বেতনা নদীর মূল স্রোতধারাতে কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। ভূমিও দখলে যায়নি কারও। কিংবা জরিপকারীরা কোন ব্যক্তির ব্যক্তিগত খতিয়ানভুক্ত করেননি নদীর অংশ। এটা অবশ্য ঠিক সেই সময় এত জনসংখ্যা ছিল না। ওই অঞ্চলের বিশাল বিশাল জলাভূমি ছিল অনাবাদী এবং সরকারের খাস খতিয়ানভুক্ত। ১৩২৭ সালের জরিপ সম্পর্কে প্রবীণরা অনেক গল্প শোনান। সে সময় জরিপকমর্ীদের ল্য ছিল কতটা খাস জমি ব্যক্তিগত খতিয়ানভুক্ত করা হয়। এর কারণ ছিল সরকারের কতটা রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করা যায়। তখন জরিপকারীরা গাঁয়ে এলে বিত্তবানরা পালিয়ে যেতেন। কেননা তারা সরকারের খাস জমি বিত্তবানদের খতিয়ানভুক্ত করে দিতেন। আর বিত্তবানরা চাইত না খাস জমি নিজের খতিয়ানভুত্ত করে তা বছরের পর বছর ফেলে রাখতে। পাশাপাশি খাজনার টাকা গুনতে। কিন্তু ১৩৬০ সালে এসে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ভূমির গুরম্নত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে আরও বেশি। ওই সময় জরিপকালে দেখা যায়, বেতনা নদীর দু'পাশের অনেক অংশ ব্যক্তিগত খতিয়ানভুক্ত করা হয়েছে। যারা নদী দখল করেছেন তারা অর্থশালী। আর গত ভূমি জরিপে নদীর আরও অংশ চলে গেছে তাদের পেটে। এভাবে এখন বেতনা নদী দখল হয়ে গেছে। নদীর সবচেয়ে করম্নণ অবস্থা ডিহি, লক্ষ্মণপুর, নিজামপুর, নাভারণ এবং উলশী ইউনিয়নে। নদীর এই সব অংশে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। বেতনা নদী ডিহি ইউনিয়নের রাজনগর চক, ডিহি এলাকায় নিজের মতো দখল করে বড় বড় পুকুর, কোথাও দীঘি তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়া গোড়পাড়া বাজার এলাকায় নদী দখল করে তৈরি করা হয়েছে বড় বড় বিল্ডিং। আর এর ফলে শার্শার বিল দুবলা, বিল বনমান্দার, সোনানদীয়াসহ কয়েকটি বড় বিলের পানি বের হতে পারছে না। একই ভাবে বাহাদুরপুর বাঁওড়, পাচুর বাঁওড়সহ কয়েকটি বাঁওড়ের পানি বের হতে পারছে না। গত ২০০০ সালে ভয়াবহ বন্যার পর সময় দেখা গেছে বিলের পানি সহজে নামছে না। কারণে ওই এলাকার বিলসহ অন্যান্য জলাশয়ের পানি নামে বেতনা নদী দিয়ে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, নদীর পাড়ের অধিকাংশ জমি, কোন কোন েেত্র পুরো নদী দখল করে নিয়েছে প্রভাবশালীরা। তারা ভুয়া কাগজপত্রও তৈরি করেছে। এ েেত্র তাদের সহযোগিতা করেছে শার্শা ভূমি অফিসের কতিপয় কর্মকর্তা। দেশে জরম্নরী অবস্থা শুরম্ন হলে শার্শার সড়কের পাশ থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা হলেও বেতনা নদীর দু'পাশ থেকে উচ্ছেদ করা হয়নি দখলদারদের। তারা এখনও বহাল তবিয়তে দখলে রেখেছে বেতনা নদীর অংশ। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় প্রশাসন কিছু এলাকায় নদীর অবৈধ দখল উচ্ছেদ করা হলেও এখন আবার তা দখল হয়ে গেছে।

No comments

Powered by Blogger.