প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও ভাষা আন্দোলন by সরদার সিরাজুল ইসলাম

পিকেটিংয়ের সময় সরকারের এ্যাটর্নি জেনারেল শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক সেক্রেটারিয়েটে প্রবেশের চেষ্টা করেন। তিনি ছাত্রদের বোঝাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।
পুলিশের জুলুমের প্রতিবাদে বেলা দুটোর দিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দিন আহম্মদের সভাপতিত্বে এক বিরাট সভায় বক্তরা পুলিশি জুলুমের তীব্র নিন্দা, কর্মীদের মুক্তি ও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জানান। ১১ই মার্চ ছাত্ররা মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য মিছিল সহকারে অগ্রসর হলে হাইকোর্টের সামনে পুলিশ কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হয়। সেদিন ঢাকায় আংশিক ধর্মঘট হয়। রেল ও সেক্রেটারিয়েট কর্মচারীরা ধর্মঘটে যোগদান করেন। ঢাকায় খাজা পরিবার, হামিদুল হক চৌধুরী, ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিঞা), সর্র্বস্ব গণ করলেন আন্দোলন বন্ধ করার জন্য। ভাড়াটিয়া গুন্ডা লেলিয়ে দেয়া হয়। এছাড়া ছিল পুলিশের লাটি, বেয়নেট, বেটন ও বুট। শতশত ছাত্র ধৃত হলো। অনেকে ভীষণ প্রহারে হাসপাতালে নীত হলো। তা সত্ত্বেও আন্দোলন এগিয়ে চলল প্রদেশব্যাপী। ১১ মার্চের ঘটনার সরকারী প্রেসনোট-এ বলা হয় “বাংলাকে কেন্দ্রীয় ভাষা হবে না বলে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে তার প্রতিবাদে ১১ মার্চে যে সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করা হয়েছিল কতিপয় বিভেদকারী ও একদল ছাত্র তা কার্যকর করার চেষ্টা করে। পুলিশ ৬৫ জনকে গ্রেফতার করে। দু’বার ফাঁকা আওয়াজ করে। শোভা যাত্রায় পুলিশদের হস্তক্ষেপের ফলে ১৪ জন আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলো। কয়েকটি স্থানে খানা তল্লাশির ফলে প্রদেশের মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির জন্য এবং পাকিস্তানের শাসনযন্ত্রে গোলযোগ সৃষ্টি করার এক গভীর ষড়যন্ত্রের তথ্য সরকারের হস্তগত হয়েছে।” ১২ মার্চ ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দিন আহম্মদ এক বিবৃতিতেব ১১ মার্চ সরকারী জুলুমের তীব্র প্রতিবাদ জানান। এতে বলা হয় দেশের শতকরা ৬৮ জন মানুষের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনকে দমানোর জন্য জানানো হয়। এই বিবৃতির মধ্যে ১১ইং মার্চ ঘটনায় আহতের সংখ্যা ২০০, তার মধ্যে ১৮ জন গুরুতর এবং ধৃত ১০০ যার মধ্যে অনেকেই ছেড়ে দেয়ার পর জেলবন্দীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৯ জন।
১২ মার্চ সকালে জগন্নাথ কলেজে পূর্বদিনের ঘটনার প্রতিবাদে সভা অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ১৩ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ শহরের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। ১৫ মার্চ পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় কেননা ঐদিন ছিল পূর্ববংশ ব্যবস্থাপক সভার প্রথম অধিবেশন। ১৩ মার্চ এক সরকারী ঘোষণায় কলকাতার দৈনিক আনন্দ বাজার, অমৃত বাজার ও স্বাধীনতার প্রচার পূর্ববঙ্গে বন্ধ করে দেয়। ১৪ মার্চ পূর্ববাংলায় সর্বত্র ধর্মঘট পালিত হয়। একই দিন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় পরদিন সাধারণ ধর্মঘট পালনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বক্তৃতা দেন তাজউদ্দীন আহমদ ও মোহাম্মদ তোয়াহা। ঘটনাবহুল ও তাৎপর্যপূর্ণ ১৫ মার্চ প্রবল বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে তাজউদ্দীন আহমদ ও মোহাম্মদ তোয়াহার বিশেষ তৎপরতায় ছাত্ররা পিকেটিং এ অংশগ্রহণ করে। রেল ও সেক্রেটারিয়েটের বাঙালী কর্মচারীরা ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করে। অপরদিকে পুলিশ পিকেটারদের ওপর বিভিন্ন স্থানে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ, লাটিচার্জ ও গ্রেফতার করে। সবকিছু উপেক্ষা করে ছাত্র জনতা প্রাদেশিক পরিষদ ভবনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।
১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তানের গবর্নর জেনারেল এম, এ জিন্নাহ ঢাকায় সফরে আসার একটি কর্মসূচী ছিল। সপ্তাহব্যাপী সেই সফরের সময় যাতে ছাত্ররা বিক্ষোভ প্রদর্শন না করে সেজন্য পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ছাত্রদের সঙ্গে আপোস কামনায় ১৪ মার্চ রতে ডাক্তার মালিক, তাফাজ্জেল আলী ও সবুর খানকে একটি চিঠি নিয়ে পাঠানো হয় কমরুদ্দিন আহ¤মদের কাছে। এছাড়া ১৫ মার্চ সকালে খাজা নাজিম উদ্দিনের পক্ষ থেকে বগুড়ার মোহাম্মদ আলী ও খাজা নসরুল্লা কমরুদ্দিন আহম্মদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। খাজা নাজিম উদ্দিন ১৫ মার্চ বেলা এগারোটায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন নিয়ে আলোচানর প্রস্তাব দেন। সকালে ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের এক বৈঠকে খাজা নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাতের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং আবুল কাসেম, কমরুদ্দিন আহম্মদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, নঈমুদ্দিনে আহম্মদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আজিজ আহম্মদ, আব্দুর রহমান চৌধুরী প্রমুখ বর্ধমান হাউসে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হন। আলোচনায় তুমুল বিতর্ক ও উত্তেজনার মধ্যে সংগ্রাম পরিষদের অনমনীয়তার ফলে খাজা নাজিমুদ্দিন সংগ্রাম পরিষদের সব কটি দাবিই মেনে নিতে বাধ্য হন। চুক্তি স্বাক্ষরের পূর্বে সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে কমরুদ্দিন আহম্মদ, আবুল কাসেম জেলে গিয়ে ভাষা আন্দোলনের বন্দীদের চুক্তিগুলোর শর্ত দেখান। রাজবন্দী শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব প্রমুখ চুক্তিটির প্রতি সমর্থন জানালে কমরুদ্দিন আহম্মদ প্রমুখ বর্ধমান হাউসে ফিরে এসে বেলা তিনটায় সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে কমরুদ্দিন আহম্মদ ও মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। ঐতিহাসিক চুক্তিটির ভাষ্য ছিল :
১। অদ্য পাঁচ ঘটিকার মধ্যে সকল রাজন্দীর মুক্তি দেওয়া হইবে। ২। ইত্তেহাদ, স্বাধীনতা ও অন্যান্য খবরের কাগজের উপর হইতে নিষেধাজ্ঞা অদ্যই তুলিয়া নেওয়া হইবে। ৩। অবিলম্বে ব্যবস্থা পরিষদে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের সরকারী ভাষা শিক্ষার মাধ্যম করা হইবে বলিয়া প্রস্তাব গ্রহণ করা হইবে। ৪। অবিলম্বে ব্যবস্থা পরিষদে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য কেন্দ্রের নিকট অনুমোদন সূচক প্রস্তাব গ্রহণ করা হইবে। ৫। পুলিশ কর্তৃপক্ষ যে অমানুষিক জুলুম করিয়াছে তাহার পরিপ্রেক্ষিতে অবিলম্বে একটি ইনকোয়ারী কমিশন গঠন করা হইবে এবং দোষীদের প্রতি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হইবে। ৬। যে সকল গু-া শ্রেণীর লোক ছাত্রদের মারপিট করিয়াছে সরকার তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করিবে। ৭। এই আন্দোলনে অংশ গ্রহণকারী কোন ছাত্র বা অন্য কাহারো বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হইবে না।
সংগ্রাম পরিষদের ৭টি দাবি আগেই তৈরি ছিল। খাজা নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় ছাত্ররা প্রধান মন্ত্রীকে ক্ষমা প্রর্থনা করে একটি বিবৃতি দেয়ার জন্য চাপের মুখে তিনি আরেকটি দফা চুক্তিতে নিজ হাতে সংযোজন করেন। ৮ম দফায় শেষ শর্তটিতে খাজা নাজিমুদ্দিন যা লিখেছিলেন তা হচ্ছে : “প্রধানমন্ত্রী এ আন্দোলনকে যে বিদেশী শক্তি বিশেষ করিয়া ভারতের চর দ্বারা অনুপ্রাণিত বলিয়া আখ্যায়িত করিয়াছেন তাহা প্রত্যাহার করিতেছেন এবং সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে আলোচনার পর আমি নিঃসন্দেহ হয়েছি যে এই আন্দোলন রাষ্ট্রের দুশমনদের দ্বারা অনুপ্রানিত হয় নাই।”
১৫ মার্চ ছাত্রদের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের পরে খাজা নাজিমুদ্দিন প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেন। যে সময় ১৯ মার্চের ঘটনার প্রতিবাদে এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে হাজার হাজার ছাত্র প্রাদেশিক পরিষদের বাইরে বিক্ষোভ প্রকাশ করছিল। পরিষদের মধ্যে কংগ্রেস সদস্য ড. প্রতাপ চন্দ্র গৃহ রায় ১১ মার্চ পুলিশের নির্যাতনের তীব্র নিন্দা করে একটি প্রস্তাব উত্থাপনের চেষ্টা করলে এবং ২৫ জন সদস্য তাকে সমর্থন করলেও মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিনের বিরোধিতার ফলে তা অগ্রাহ্য হয়। অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী ছাত্রদের সঙ্গে তার চুক্তির বিষয়টি পরিষদেকে অবহিত করেন।
১৫ই মার্চের চুক্তি অনুযায়ী ঐ দিন সন্ধ্যায় শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ প্রমুখ রাজবন্দীরা মুক্তিলাভ করেন। তবে মুক্তির সময় জেলগেটে একটি ঘটনা ঘটে যা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সরকার রাজবন্দীদের মুক্তি দিতে রাজি হলেও ধরণী রায়, রণেশ চন্দ্রগুপ্ত, শওকত আলী, জাকির হোসেন ও কাজী গোলাম মাহবুবের বিরুদ্ধে ‘অন্য মামলা আছে’ অজুহাতে মুক্তি দিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলে জেলগেটে বসে শেখ মুুজিবুর রহমান তাদের ছাড়া মুক্তিলাভ করবেন না বলে জেদ ধরলে বাধ্য হয়ে তাদেরও মুক্তি দেয়া হয় তখন জেল গেটে বিরাট এক জনতা অপেক্ষা করছিল। মুক্তি লাভের পরে শেখ মুজিব প্রমুখকে ট্রাকে নিয়ে বিজয় মিছিল শহর প্রদক্ষিণের পরে ফজলুল হক হলে কারামুক্ত নেতাদের সংবর্ধনা দেয়া হয়। পরদিন ১৬ মার্চ দুপুরে ঢাক বিশ্ববিদ্যালয় আহূত এক ছাত্র সভায় সভাপতিত্ব করেন শেখ মুজিবুর রহমান। এই সভায় আগের দিন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির শর্তসমূহের নিম্নরূপ সংশোধনী গৃহীত হয় :
ক) ঢাকা ও অনান্য জেলায় পুলিশী বাড়াবাড়ি সম্পর্কে তদন্তের জন্য সংগ্রাম পরিষদ অনুমোদিত এবং সরকারী ও বেসরকারী সদস্যদের সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি নিয়োগ করিতে হইবে।
খ) বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব গ্রহণের জন্য প্রাদেশিক পরিষদের দিন নির্ধারণ এবং
গ) বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব গণপরিষদ কর্তৃক অনুমোদন করাইতে ব্যর্থ হইলে পূর্ব বাংলার মন্ত্রিপরিষদের পদত্যাগ করিতে হইবে।
এই প্রস্তাবসমূহ অলি আহাদের মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের কাছে প্রেরণ করা হয়। অপরদিকে ১৬ মার্চ সভার পরে কোন মিছিল করার কর্মসূচী না থাকলেও সভাপতির ভাসনে শেখ মুজিবুর রহমান “এক সময় চলো চলো এসেমব্লি চলো” বলে মিটিংকে এক বিরাট মিছিলে পরিণত করে নিজে মিছিলের অগ্রভাবে থেকে পরিষদ ভবন পর্যন্ত যান এবং দাবি মেনে নেয়ার জন্য রাত পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রীসহ পরিষদ সদস্যদের অবরোধ করেন। ভীতসস্ত্রস্ত মুখ্যমন্ত্রী পুলিশ দ্বারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে তৎকালীন জি ও সি আইয়ুব খানকে ডেকে পাঠান। আইয়ুব খানের সহায়তার মুখ্যমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার সদস্যরা রান্নাঘরের মধ্য দিয়ে পলায়ন করতে সমর্থ হয়। সেদিন পুলিশের কাঁদানে গ্যাস, লাঠিচার্জে ১৯ জন আহত হয় যার মধ্যে শওকত আলীর আঘাত ছিল গুরুতর। ১৬ মার্চের ঘটনাবলী সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী রাতে যে বিবৃতি দেন তাতে উলেখ করেন, “৯ জন সদস্যকে অপমানিত করা হয়েছে। (চলবে)

No comments

Powered by Blogger.