মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সেদিন হাতে লিখেও প্রচার হতো লিফলেট- মুক্তিযুদ্ধের ছিন্ন দলিলপত্র-৪৭ by মুনতাসীর মামুন

বর্তমান সংকলনে, এর আগে বেশ কিছু প্রচারপত্র সংকলন করেছি। সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রচারপত্রগুলো বিলি করা হয়েছে। অবরম্নদ্ধ দেশ থেকে মুক্তিকামী অনেক গ্রম্নপও এর সঙ্গে জড়িত ছিল।
প্রচারপত্রগুলোর গুরম্নত্ব এই যে, তৎকালীন সময়ের মানুষের মনোভঙ্গির একটি পরিচয় পাওয়া যায়। বাংলাদেশের কিছু মানুষ ছাড়া বাকি সবাই যে মনেপ্রাণে মুক্তিযুদ্ধের পৰে ছিল ও মুক্তিযুদ্ধের পৰে কাজ করেছে প্রচারপত্রগুলো তা প্রমাণ করে। এ ধরনের একেকটি প্রচারপত্র হাতে হাতে ঘুরত, মানুষের মনোবল বৃদ্ধি করত।
এ রকম একটি প্রচারপত্র প্রচারিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। যদিও বাংলাদেশ সরকারের মনোগ্রাম দিয়ে লেখা হয়েছেজ্জ "বাংলাদেশ গণসাধারণতন্ত্র সরকারের আঞ্চলিক প্রচার দফতর কর্তৃক প্রকাশিত ও প্রচারিত", কিন্তু তা সঠিক না হাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। প্রচারপত্রটি হাতে লিখে সাইকোস্টাইল করা। এবং ভাষা ও বক্তব্য দেখে অনুমান করছি ন্যাপের (মোজাফফর) পৰ থেকে তা প্রকাশ করা হয়েছিল।
এখানে প্রচারপত্রটি উদ্ধৃত করছিজ্জ
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক বিশেষ পর্যায়ে এসে গেছি আমরা। কার্যত : ভারতও আমাদের পরিপূর্ণ স্বীকৃতি দিয়ে ফেলেছে ৪ঠা ডিসেম্বরের এক বেতার প্রচারের মাধ্যমে। আকাশবাণী থেকে বলা হয়েছে, পাকিসত্মানের অত্যধিক বাড়াবাড়ির পরিপ্রেৰিতে ভারত যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে; তবে তার কাজ হবে বাংলাদেশে বাঙালীদের ওপর গত ৮ মাস ধরে অকথ্য নির্যাতনকারী নরপশু পাকবাহিনীকে আত্মসমর্পণ করানো তথা, বাংলাদেশের সরকারের হাতে ৰমতা তুলে দেয়াজ্জ ভারতের নিজস্ব স্বার্থে লড়াই চালিয়ে যাওয়া নয়। এ এক বিরাট সংসংবাদ! বুঝতে হবে আমাদের বিজয়ের সর্বশেষ পর্যায় এটাই। আর সে জন্যেই এত দিনের সংগ্রামী বাঙালীকে এবারে যেতে হবে আরও কঠিন অগি্নপরীৰার মধ্য দিয়ে। বিশ্বমানবতার শত্রম্ন সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা একদিকে এ ক'মাস ধরে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারম্নদ দিয়ে সাহায্য করে এসেছে বর্বর ইয়াহিয়ার জঙ্গী শাহীকে এবং নেহাত দায়ে পড়াভাবে ভারতে আশ্রিত এক কোটি মানুষের জন্য পাঠিয়েছে নামমাত্র সাহায্য দ্রব্য, কিন্তু একবারও 'বাংলার মানুষ আজ কেন বিদেশে শরণাথর্ী হলো?'জ্জ এ বিষয়টির প্রতিকারে এগিয়ে আসেনি? আর যখন আমরা আমাদের চূড়ানত্ম সাফল্য অর্জন করতে চলেছি, আমেরিকা এসেছে শানত্মির বুলি নিয়ে। নিরাপত্তা পরিষদে প্রসত্মাব উত্থাপন করেছে অবিলম্বে যেন পাক-ভারত যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের প্রশ্ন, এটা কি আদৌ পাকিসত্মান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ? এ যুদ্ধ স্বাধীনতাকামী বাঙালীদের বিরম্নদ্ধে অত্যাচারী উপনিবেশবাদী পাকিসত্মানের। কাজেই ভারতের এ থেকে সরে দাঁড়ানোর কোনই মানে হয় না। অবশ্য আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকার এ ধৃষ্টতাকে নাকচ করে দিয়েছে জাতিসংঘের দরবারে। মুনাফেক মার্কিনী দসু্য, যার হাত ভিয়েতনামী মা ও শিশুদের তাজা রক্তে ভেজা, সে চায় আজ নিরাপত্তা পরিষদের মধ্যস্থতা!
দেশবাসীগণ, আপনারা এ চক্রানত্মে কখনও বিভ্রানত্ম হবেন না। বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী চক্রের তাঁবেদার ও পাঞ্জাবী ধনিকদের অস্ত্রধারী-পেয়াদা ইয়াহিয়ার যমজ আইয়ুবের সময়ে পাকিসত্মান থেকে আরও একবার হামলা হয়েছিল শানত্মিপ্রিয় ভারতের উপর; এবং দেশে জারি হয়েছিল জরম্নরী আইন, দেশরৰা বিধি প্রভৃতি কালাকানুনজ্জ সবই জনসাধারণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য। এবারও ইসলামের নামে সেই পুরনো কথাই তোলা হচ্ছে। এ সব অপপ্রচার থেকে সদা সতর্ক থাকুন! এ ছাড়াও রয়েছে তথাকথিত সমাজবাদী গণচীন। যখন গ্রামবাংলার পথে ঘাটে লৰ লৰ নিরীহ জনতা অসহায় শিকার হয়েছে পাক-দসু্যদের অত্যাচারের, তখন চীন বলেছে, এটা নিতানত্ম পাকিসত্মানের আভ্যনত্মরীণ ব্যাপার। সম্প্রতি সে আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র ভারতের বিরম্নদ্ধেও প্রচারণা শুরম্ন করেছে। কিন্তু আমরা ভুলে যাইনি। ১৯৬২ সালে চীনই আকস্মিকভাবে আক্রমণ করেছিল ভারতকে এবং মাত্র গতবছরও সে সোভিয়েত ইউনিয়নের সীমানত্মে শুরম্ন করেছিল ধ্বংসাত্মক অভিযান। অতএব চীন সম্পর্কেও সাবধান থাকুন; বস্তুত: সে আমেরিকারই দোসর!
জনগণের প্রতি নির্দেশাবলী :
গুজবে কান দেবেন না; গুজব রটনাকরীকে ধরিয়ে দিন।
মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনার কথা গোপন রাখুন।
পাক-বাহিনীর গতিবিধির খবর মুক্তিবাহিনীকে জানিয়ে দিন।
শত্রম্নর সরবরাহ সম্পূর্ণ বিপর্যসত্ম করে দিন।
বিমান আক্রমণের সময় নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিন।
মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বতোভাবে সাহায্য করম্নন।
মনে রাখবেন শত্রম্নর প্রতিটি বুলেট আপনার পয়সায় কেনা। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধে ব্যয়িত আপনার প্রতিটি পয়সা স্বাধীনতাকে এগিয়ে নিয়ে আসছে।
বাংলাদেশ গণসাধারণতন্ত্র সরকারের আঞ্চলিক প্রচার দফতর কর্তৃক প্রকাশিত ও প্রচারিত।
সংগ্রহ : মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।

No comments

Powered by Blogger.