নিয়ন্ত্রণ কাঠামো ভেঙ্গে পড়ায় বাড়ছে খুন গুম ছিনতাই ধর্ষণ- সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় by তৌহিদুর রহমান

পরিবার ও সমাজের নিয়ন্ত্রণ কাঠামো ভেঙ্গে পড়ছে। পরিবারের শাসন এখন কেউ মানতে চাইছে না। পাশাপাশি সামাজিক কাঠামোর নিয়মশৃঙ্খলাকেও উপেক্ষা করা হচ্ছে।
এ ছাড়া পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কমে আসছে। পাশাপাশি বাড়ছে ভোগবাদিতা। ফলে সমাজে নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়ও বাড়ছে। আর এ কারণে বাড়ছে খুন, গুম, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ ইত্যাদি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এএসএম আতীকুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, খুন, গুম, চাঁদাাবাজি, ধর্ষণ ইত্যাদি ভয়াবহ ট্রেন্ড। এখনই প্রতিরোধ করতে হবে। অন্যথায় দেশে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। পরিবার ও সমাজের নিয়ন্ত্রণ কাঠামোগুলো ভেঙ্গে পড়ছে। পরিবার, সমাজ, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ কেউ মানতে চাইছে না।
তিনি বলেন, পাঠ্যপুস্তকেও নৈতিক শিক্ষার বিয়ষগুলো উপেক্ষিত হয়ে আছে। সে কারণে পাঠ্যপুস্তকেও এসব গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। গণমাধ্যমে বিনোদনকে অনেক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এই গুরুত্ব কমিয়ে দিতে হবে। অন্যান্য শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে। তবে সেটা হচ্ছে না। সর্বোপরি ভোগবাদী সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অপর অধ্যাপক ড. নুরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, সমাজে দায়িত্ববোধ ও সততা কমছে। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও দায়িত্ববোধও কমছে। এখন মানুষ গোপনে অন্যায় করে। যেটা প্রকাশ হয়ে পড়ে সেটাই আমরা জানতে পারি। মানুষের মধ্যে ধারণা জন্মেছে, যেভাবেই হোক তাকে ধনী হতে হবে। এটা বস্তুতান্ত্রিক মানসিকতারও ফল। সে কারণে খুন, গুম ও ধর্ষণ ইত্যাদি অপরাধ বাড়ছে। তিনি বলেন, এ অবস্থা থেকে উত্তরণে নৈতিকতার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। একই সঙ্গে আইনের প্রয়োগও প্রয়োজন।
নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়ের ফলে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, খুন ইত্যাদির পাশাপাশি বাড়ছে গুম। মানুষই এখন দিনে-রাতে গুম হয়ে যান। গুমের পরে অনেকের লাশ পাওয়া যায়। আবার অনেকের লাশ মেলে না। পরিবারের লোকেরা নিখোঁজ লোকের জন্য প্রহর গোনে। মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান ও শ্রীনগরে একদিনেই মিলেছে তিনটি লাশ। তিনজনেরই লাশ পড়ে ছিল সড়কের পাশে। সবার চোখ ছিল বাঁধা। এর আগেও এই এলাকায় একইভাবে গুলিবিদ্ধ ও হাত মুখ বাঁধা লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গত দুই বছরে মুন্সীগঞ্জে এমন ধরনের অন্তত ৩৩ জনের লাশ মিলেছে। এভাবে হত্যার পরে লাশ গুম হওয়ার ঘটনা ঘটছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত বছর দেশের বিভিন্ন স্থানে গুম ও গুপ্তহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এক বছরে এ ধরনের ঘটনার শিকার হয়েছেন মোট ৫৬। এর মধ্যে মাত্র ৮ জন গুম হয়ে যাওয়ার পর মুক্তি পেয়েছেন। ৪ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে, ৬ জনকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়েছে এবং বাকিদের এখন পর্যন্ত কোন খোঁজ মেলেনি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপহৃত, নিখোঁজ বা নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশেষত র‌্যাবের বিরুদ্ধে এসব ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলেছেন। এ ধরনের ঘটনা খুবই উদ্বেগজনক। একটা নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
গত বছর ১৭ এপ্রিল রাজধানীর মহাখালীর আমতলী ক্রসিং এলাকা থেকে নিখোঁজ হন প্রধান বিরোধী দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী এবং তার গাড়ির ড্রাইভার। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার আগে সিলেট জেলার ছাত্র নেতা ইফতেখার আহমেদ দিনার এবং জুনায়েদ নামে অপর এক ছাত্র নেতা ঢাকা থেকে নিখোঁজ হন। এখন পর্যন্ত এই দুই ছাত্র নেতারও কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। গত ৪ এপ্রিল সন্ধায় শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম ঢাকার আশুলিয়ায় বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির (বিসিডব্লিউএস) অফিস থেকে বের হওয়ার পর নিখোঁজ হন। পরদিন ৫ এপ্রিল সকালে ঘাটাইল থানা এলাকার টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কের পাশে দুই হাঁটুভাঙ্গা, ডান হাঁটুর জয়েন্টে ড্রিল মেশিনের ছিদ্র, দাঁত উঠানো ও নখ উপড়ানো অবস্থায় আমিনুলের মৃতদেহ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। গত বছর ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে সাভারের নবীনগর এলাকা থেকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র নিখোঁজ হয়। ছাত্রদের অভিভাবকরা অভিযোগ করেন, র‌্যাবের পোশাক পরা সাত-আট জন তাদের বাস থেকে নামিয়ে নিয়ে যায়, যা বাস কর্তৃপক্ষও স্বীকার করেছে। এর পর থেকে তাদের আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। গত ১৩ আগস্ট সাভার উপজেলার হেমায়েতপুরে আলমনগর এলাকা থেকে ৫ যুবক অপহৃত হয়। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সাদা পোশাকে কয়েক ব্যক্তি র‌্যাব পরিচয়ে তাদের একটি কালো মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। প্রথমদিকে এই ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা র‌্যাব অস্বীকার করলেও, অপহরণের ২১ দিন পর ৩ সেপ্টেম্বর র‌্যাব তাদেরকে মিরপুর থানায় সন্ত্রাসী হিসেবে থানায় সোপর্দ করে। গত ৫ থেকে ২৩ অক্টোবরের মধ্যবর্তী বিভিন্ন সময়ে সাভারের আমিনবাজার এলাকার বরদেশী ও বেগুনবাড়ী গ্রাম থেকে আরও ৫ যুবক নিখোঁজ হন। এ ঘটনায় ভিকটিম পরিবারগুলোর পক্ষ থেকে সাভার ও দারুস সালাম থানায় মোট ৩টি জিডি করা হলেও এখন পর্যন্ত তাদের কোন খোজ মেলেনি। অনেক সময় দেখা যায়, কেউ নিখোঁজের পর তার পরিবারের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি অভিযোগ তোলে। আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও অভিযোগ অস্বীকার করে। অপরদিকে সন্ত্রাসীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাক পরেও অপহরণ করে। এসবের ফলে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। দেশে বিভিন্ন সময়ে সাভার ও আশুলিয়ার বিভিন্ন স্থানে, গাজীপুর রেললাইনের পাশে এবং ভৈরবের মেঘনা সেতুর আশপাশের নদী থেকে হাত-পা বাধা, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় কয়েকজনের লাশ পাওয়া গেছে। কে বা কারা গোপনে এটি অব্যাহতভাবে করে চলেছে তা আজ অবধি উদঘাটিত হয়নি। কবে যে উদ্ঘাটিত হবে তাও কেউ জানেন না।

No comments

Powered by Blogger.