রাজনীতির ভাষা-গণতন্ত্রের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রত্যাশায় by হায়াৎ মামুদ

৭ মার্চের ভাষণ দীর্ঘস্থায়ী ছিল না। টেলিভিশনের জন্য রেকর্ড করা সচিত্র ভাষণ পরে বারবার দেখেছি। সে সময়ে তার সামনের টেবিলে একটি কাগজ আমাদের নজরে পড়ে। এতে তার বক্তৃতার জন্য কিছু পয়েন্ট হয়তো লেখা ছিল। হতে পারে যে একটু বিস্তৃতও ছিল। কিন্তু তিনি তা পাঠ করেননি।
তার ভাষার ওজস্বিতা, বক্তব্যের নির্দিষ্ট লক্ষ্যাভিমুখিতা, বাচনভঙ্গির স্বতঃস্ফূর্ততা এবং এর সবগুলো অবিশ্বাস্য আত্মবিশ্বাসে পালন করা_ বর্তমান সময়ের নেতারা তা থেকে অনেক কিছু শিখতে পারেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে দল-মত নির্বিশেষে সবার কথাই বলব যে এমন সমন্বয় তাদের মধ্যে অনুপস্থিত

৭ মার্চ বছর ঘুরে আসে। কিন্তু বাঙালির কাছে, বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের কাছে '৭ মার্চ' একটি নির্দিষ্ট দিনকেই বুঝিয়ে দেয়। এ দিনটি সবার কাছেই বিশেষ কিছু, যেখান থেকে মেলে অনন্ত প্রেরণা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চার দশক আগে এই দিনে একটি জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতা ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠেন। জ্বলন্ত সূর্যের মতোই ক্রমাগত আলো ছড়িয়েও যার আবেদন অনিঃশেষ। সেই ইতিহাস রচিত হওয়ার মাহেন্দ্রক্ষণে লাখ লাখ মানুষের ভিড়ে ছিলাম আমিও। অনেক দূর থেকে তাকে সরাসরি ঠিক দেখছিলাম না। কিন্তু ভাষণের শুরু থেকেই তিনি ছিলেন স্বতঃস্ফূর্ত ও সাবলীল। তিনি যা বলতে চাইছিলেন, সাড়ে সাত কোটি মানুষ যা শুনতে চাইছিল এবং যেভাবে তার প্রত্যাশা ছিল ঠিক সেভাবেই প্রতিটি শব্দ ও বাক্য উচ্চারিত হচ্ছিল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র মানুষের এ মহাসমাবেশে হামলা পরিচালনার জন্য সঙ্গিন উঁচিয়ে আছে। আপসের টোপও রয়েছে। এমন কঠিন বাস্তবতার মুখে তিনি শান্ত ও স্থিতধী। কথার মারপ্যাঁচ নেই, কূটনীতি নেই। তিনি মন খুলে কথোপকথন করছিলেন জাতির সঙ্গে এবং এ প্রক্রিয়াতেই সবার কাছে জানিয়ে দিলেন যুগসন্ধিক্ষণে বাঙালির অবস্থান।
আমরা রাজনীতিবিদদের ভাষণ শুনে শুনে অভ্যস্ত। তাদের অনেকেই অনেক কথা বলেন, কিন্তু শেষে মনে হয় কিছুই তো বললেন না। বঙ্গবন্ধু এ ক্ষেত্রে বরাবরই ব্যতিক্রম। ৭ মার্চ তিনি নিজেকে নিয়ে গেলেন আরও আরও উচ্চতায়। সমগ্র জাতির দূরদর্শিতা, স্বপ্ন ও সাহস যেন তার ওপর ভর করে। তিনি বলেন, 'ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল।' এর অর্থ স্পষ্ট_ পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে কোনো আপস নেই। স্বাধীনতাই একমাত্র পথ। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফল অনুযায়ী তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন, এটাই স্বাভাবিক ছিল। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে সামরিক জান্তা এবং জুলফিকার আলি ভুট্টো তাতে বাদ সাধেন। কিন্তু রেসকোর্সের জনসমুদ্রে দেওয়া ভাষণ এ জন্য সৃষ্ট ক্ষোভ-রোষের প্রতিফলন, সেটা ভাবলে ভুল হবে। গদির প্রতি লোভ থাকলে স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন সিদ্ধান্ত দেওয়া যায় না। তার রাজনৈতিক আচরণ ও কথাবার্তায় কখনও পাকিস্তানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলার মনোভাব প্রকাশ পায়নি। যেমন ছিল, চলুক না_ এটাও তিনি চাননি। তিনি স্বাধীনতার পথ দেখালেন, বাঙালি লড়ে তা আদায় করে নিল। তবে পাকিস্তানিরা ২৫ মার্চ রাতে কিংবা পরের কয়েকটি মাসেও তাকে হত্যার সাহস দেখায়নি। কিছু অকৃতজ্ঞ বাঙালি তাকে হত্যা করল। একাত্তরে আমাদের জনগণ তাকে প্রতীক হিসেবে নিয়েছিল। তার অবর্তমানে তার নামেই সবকিছু পরিচালনা হয়েছে। এ মহতী সংগ্রামের পরিচালক ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করার পর বঙ্গবন্ধু নিজে ক্ষমতা না নিয়ে তার হাতেই দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দিলে কেমন হতো, সে বিতর্ক কিন্তু চার দশকেও ফয়সালা হয়নি। তাজউদ্দীন আহমদ জন্মলগ্ন থেকেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। একই সঙ্গে বামপন্থি ধারণা দ্বারাও ছিলেন অনুপ্রাণিত। দু'জনের ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের স্বপ্ন অবিকল এক হওয়ার কথা নয়। তাজউদ্দীন আহমদ কেবল একজন রাজনীতিক ছিলেন না, বিদগ্ধজন হিসেবেও নন্দিত। এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে রাজনীতি ও পাণ্ডিত্য হাত ধরাধরি করে চলে না। তিনি ছিলেন উজ্জ্বল ব্যতিক্রম।
৭ মার্চের প্রসঙ্গে ফিরে যাই। এ দেশের রাজনীতিকদের অনেকেই এ ভাষণ থেকে তেমন শিক্ষা নেননি। এমনকি এটাও বলা যায়, ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের গোড়ার দিকের মুসলিম লীগ নেতাদের সভা-সমাবেশের ভাষাও তারা ঠিক রপ্ত করতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক জীবনের প্রথম থেকেই কথায় কোনো অস্বচ্ছতা রাখেননি। যা বিশ্বাস করেছেন সেটা অকপটে বলার সাহস রাখতেন এবং তা বলতেনও। রাজনীতিকরা জনগণকে উদ্ব্বুদ্ধ করার শক্তি নানাভাবেই রাখতে পারেন। কিন্তু তা চলতে হবে সর্বদা সত্যকে আশ্রয় করে, অভিজ্ঞতার ঝুড়ির দিকে তাকালে এমনটি বলার উপায় নেই। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ কিংবা অন্য কোনো সময়েই জনগণকে মিথ্যা স্বপ্ন দেখাননি। 'তিন বছর কিছুই দিতে পারব না'_ স্বাধীনতার পর স্পষ্ট ভাষায় এ কথা বলেছিলেন। পাকিস্তানের দুই যুগে শোষণ-বঞ্চনা ছিল সীমাহীন। তদুপরি দেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত। কিন্তু জনগণের প্রত্যাশা ও স্বঙ্্ন আকাশছোঁয়া। রাতারাতি পরিস্থিতি বদলে যাবে, এমন আকাঙ্ক্ষাও ছিল অনেকের। অনেক কষ্টকর সময় পার হয়ে আসা অনেক মানুষের মধ্যে ছিল প্রচণ্ড আবেগ। কিন্তু বঙ্গবন্ধু মিথ্যা আশ্বাস দিতে চাননি। যা সম্ভব নয়, তেমন মন ভোলানো কথা বলেননি। যেমন বলেননি একাত্তরের ৭ মার্চ। 'দেখছি কী করা যায়' কিংবা 'সমাস্যার সমাধানের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছি'_ এমন সব আশ্বাসবাণীর পরিবর্তে তিনি বলেন, 'তোমাদের যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক।'
বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে যা সবচেয়ে পর্যবেক্ষণযোগ্য ও অনুধাবনীয় তা হলো সাহস। বাঙালিরা ভীতু_ এ ধারণার এক জ্বলন্ত প্রতিবাদ তিনি। কোনো প্রমাণ হাতের কাছে নেই, এরপরও নিশ্চিত করেই বলতে পারি, পাকিস্তানের কারাগারে অবস্থানকালে ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলি ভুট্টো তাকে পাকিস্তান না ভাঙার জন্য রাজি করাতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। কারণ স্বাধীনতা ছিল বিশ্বাসে। 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'_ এ অবিনাশী উচ্চারণ একেবারেই মনের গহিন থেকে প্রেরণা পাওয়া। তার এ মনোভাব অনুসরণযোগ্য ও অনুকরণীয়।
বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ কত লাখো বার যে বেজেছে তার হিসাব রাখার উপায় নেই। এখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে তা আরও ছড়িয়ে পড়েছে। এ ভাষণের প্রতিটি বাক্য ও শব্দ নিয়ে চলছে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। ইতিহাসের বিচারে চলি্লশ বছর তেমন বেশি সময় নয়। কিন্তু ব্যক্তি ও সমাজের জীবনে একে নিতান্ত অল্প সময় বলেও গণ্য করা চলে না। চলি্লশ বছর মানেই হচ্ছে ৮টি পঞ্চবর্ষ পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দীর্ঘ সময়। পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে মেধা সংযুক্ত হলে সমাজের খোলনলচে পাল্টে দেওয়া সম্ভব। চলি্লশ বছরে ব্যক্তির জীবন শিক্ষা ও কর্মে পূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। তবে কোনো ব্যক্তিই এককভাবে পরিস্থিতি তেমন ওলটপালট করতে পারেন না। এ জন্য দরকার হয় জনগণকে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করা। তাদের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি করা। আত্মবিশ্বাস নিয়ে আসা। আমি ভাবতে প্রলুব্ধ হই_ যদি বঙ্গবন্ধু ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান নেতা মহাত্মা গান্ধীর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতেন, স্বাধীন দেশকে সমৃদ্ধ করার নবপর্যায়ের সংগ্রামে বিজয়ের জন্য সেটা আমাদের জন্য হয়তো সর্বোত্তম হতো। বিজয়ের পর তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ ছিল দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এর গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় তার চোখের আড়ালে সংঘটিত হয়েছিল। তিনি কি অন্যের কাছ থেকে শোনার কারণে শত্রু ও মিত্রকে সঠিকভাবে চিনতে পারেননি? কাকে শাস্তি দিতে হবে, কাকে লঘু দণ্ড দিলেও সমস্যা নেই এবং কাকেই-বা কী মাত্রায় পুরস্কৃত করা দরকার সেটা অনুধাবনের কাজ হয়তো ঠিকভাবে হয়নি। তবে যা ঘটেনি সে জন্য মনস্তাপে দগ্ধ হয়ে লাভ নেই।
এখন দেশে রাজনৈতিক দল অনেক। নেতার সংখ্যা অগুনতি। জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিতের দলও বেশ বড়সড়। মন্ত্রী ও সাবেক মন্ত্রী, সাংসদ ও সাবেক সাংসদ এখন অনেক অনেক। স্থানীয় সরকার যথেষ্ট বিস্তৃত। কিন্তু এই বিপুলসংখ্যক নেতার কাজকর্মের প্রতি জনগণ চূড়ান্তভাবে শ্রদ্ধাশীল_ সেটা কি বলা যাবে? জনগণ তাদের অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝে গেছে, রাজনীতি মানেই দেশপ্রেম নয়। রাজনীতি করলেই কথা ও কাজে মিল থাকতে হবে, এমন আদর্শ অবস্থা মোটেই বিরাজ করে না। রাজনীতিকরা এখন সবার চোখের সামনেই থাকেন। তারা কী করেন এবং কী করেন না সেটা জানায় তেমন কষ্ট করতে হয় না। স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হওয়ায় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ওপর নিপীড়ন বহুলাংশে অনুপস্থিত। বলা যায়, সহজ হয়ে গেছে রাজনীতিকের জীবন। তাদের ভাষাও বোধকরি সহজ হয়ে গেছে। তবে এর অর্থ এই নয় যে, তারা সাজাসাপটা ও স্পষ্ট কথা বলেন। বরং কথার মারপ্যাঁচই যেন বেশি। তারা বাংলা ভাষাতেই কথা বলেন। এ ভাষায় ৭ মার্চ কথা বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জনগণের সর্বদাই থাকে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। রাজনীতিকের ভাষার ব্যবহার, বাচনভঙ্গি, ব্যক্তিগত আচরণ, সামাজিক ব্যবহার ইত্যাদি ব্যক্তি চরিত্র মানুষের কাছে স্পষ্ট তুলে ধরায় এ ইন্দ্রিয় সহায়ক হয়। এখন যারা রাজনৈতিক দল করেন, প্রকাশ্যে কিংবা ঘরোয়া বৈঠকের কথায় তাদের রাজনৈতিক জ্ঞানের পরিচয় থাকলেও ভাষার সংবেদনের বিষয়ে অনুভূতিহীনতার প্রকাশ দেখা যায়। আমরা গণতন্ত্রের চর্চা করি বলে বিশ্বকে বোঝাতে চাই। কিন্তু গণতন্ত্রের ভাষা এখনও আমাদের আয়ত্তে নেই, মজ্জায় তো নেই-ই। ৭ মার্চের ভাষণের চার দশক পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু ওই ভাষণের ছত্রে ছত্রে যে গণতান্ত্রিক মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছিল তা যেন অনুসরণে নেই। গণতন্ত্রের ভাষার অন্যতম লক্ষণ হলো প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতিও শ্রদ্ধাবোধ। বঙ্গবন্ধু সেদিনের ভাষণের শুরুতেই বলেছিলেন, তার মন দুঃখ ভারাক্রান্ত। সামরিক জান্তা রক্তের হোলিখেলা শুরু করেছে। সামনে আরও রক্তপাতের শঙ্কা। আর এ জন্য দায়ী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং তার সহচররা। সেই ইয়াহিয়া খানকে উদ্দেশ করেই তিনি বলেন, 'আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন কীভাবে আমাদের লোকদের হত্যা করা হয়েছে।'
আমাদের দেশের দুর্ভাগ্য হচ্ছে, ১৯৪৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত সময়কালে গণতন্ত্র চর্চার সময় ছিল তুলনামূলক কম। প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ সামরিক শাসন দেশে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্বৈরাচারী শক্তি চোখ রাঙিয়েছে। ফলে গণতন্ত্রের যে প্রধান অবলম্বন মানুষ ও সমাজকে সবচেয়ে বেশি মূল্য ও মর্যাদা দেওয়া এবং নিজেকে কিংবা নিজ দলকে সর্বজ্ঞানী মনে না করা_ তা বহুলাংশে অনুপস্থিত থেকে গেছে। গণতন্ত্রের এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমাদের নতুন করে অর্জন করতে হবে। আরেকটি বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ_ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা তো থাকতেই হবে। মেধাও থাকা চাই। একইসঙ্গে হাতে-কলমে বিদ্যাচর্চা তথা শিক্ষিত লোক হয়ে ওঠাও খুব জরুরি বিষয়। অনেকে রাগ করতে পারেন কিন্তু এ কথা না বলে পারছি না যে, পুরনো আমলের মুসলিম লীগাররাও এখনকার অনেক ডান-বামপন্থির তুলনায় বেশি সহিষ্ণুতা দেখাতে পেরেছেন। কি পড়াশোনা, কি বোধশক্তি ও মূল্যবোধ সবকিছুতেই যেন আমাদের অনেক রাজনীতিক পিছিয়ে পড়া। এই অধঃপতনের মূল কারণ বিদ্যাচর্চায় অবহেলা। রাজনীতিসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। আপনি যে পেশায় থাকুন না কেন যোগ্যতা ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হলে ক্রমাগত নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে হবে। পণ্ডিতজনদের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা ও দুর্বলতা রয়েছে, ব্যক্তিগত বিদ্যাচর্চায় আগ্রহ রয়েছে এমন ব্যক্তির সংখ্যা নিতান্তই বিরল। এই বাস্তবতায় রাজনীতিকরা মানুষের মনে নিজের জন্য শ্রদ্ধা ও সম্মানের আসন করতে পারছেন না। বঙ্গবন্ধুকে কেউ পণ্ডিত বলবেন_ এমন ইচ্ছা তিনি কদাপি পোষণ করতেন বলে মনে হয় না। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে যে, তার বিভিন্ন ভাষণে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানের উদ্ধৃতি থাকতই। এতে তার বিস্ময়কর স্মরণশক্তির প্রকাশ অবশ্যই রয়েছে। একই সঙ্গে তা আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতার প্রতিও গভীর শ্রদ্ধাবোধের পরিচায়ক। ৭ মার্চের ভাষণ দীর্ঘস্থায়ী ছিল না। টেলিভিশনের জন্য রেকর্ড করা সচিত্র ভাষণ পরে বারবার দেখেছি। সে সময়ে তার সামনের টেবিলে একটি কাগজ আমাদের নজরে পড়ে। এতে তার বক্তৃতার জন্য কিছু পয়েন্ট হয়তো লেখা ছিল। হতে পারে যে একটু বিস্তৃতও ছিল। কিন্তু তিনি তা পাঠ করেননি। তার ভাষার ওজস্বিতা, বক্তব্যের নির্দিষ্ট লক্ষ্যাভিমুখিতা, বাচনভঙ্গির স্বতঃস্ফূর্ততা এবং এর সবগুলো অবিশ্বাস্য আত্মবিশ্বাসে পালন করা_ বর্তমান সময়ের নেতারা তা থেকে অনেক কিছু শিখতে পারেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে দল-মত নির্বিশেষে সবার কথাই বলব যে এমন সমন্বয় তাদের মধ্যে অনুপস্থিত। সবাই বঙ্গবন্ধুর মতো ভাষণ দেবেন এবং মানুষকে জাগিয়ে তুলবেন এটা বিশ্বাস্য নয়, কাম্যও নয়। কিন্তু যিনি বক্তৃতা দিচ্ছেন তিনি তার মাতৃভাষা বাংলায় বলেই তো জনগণকে হৃদয়ে টানবেন। সেটা তো ঘটে উঠতে দেখছি না।

হায়াৎ মামুদ : শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক
 

No comments

Powered by Blogger.